ইরানের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট কে এই মাসুদ পেজেশকিয়ান?
সংস্কারপন্থী মাসুদ পেজেশকিয়ান ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। দ্বিতীয় দফায় অনুষ্ঠিত ভোটে কট্টরপন্থী সাইদ জালিলিকে হারিয়ে তিনি ইরানের ১৪ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। আজ শনিবার (৬ জুলাই) ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম সূত্র এমন তথ্য জানিয়েছে।
২০২২ সালে মাশা আমিনির মৃত্যুর পরে ইরানের আইনপ্রণেতা মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছিলেন, একটি মেয়েকে তার হিজাবের জন্য গ্রেপ্তার করা এবং পরবর্তীতে তার মৃতদেহ পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া ইসলামী প্রজাতন্ত্রে অগ্রহণযোগ্য।
কয়েকদিন পরেই দেশব্যাপী বিক্ষোভ এবং ভিন্নমতের বিরুদ্ধে কঠোর ক্র্যাকডাউনের মধ্যে মাসুদ পেজেশকিয়ান ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে অপমান করার বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, এটি কেবলমাত্র সমাজে স্থায়ী ক্রোধ এবং বিভাজন ঘটাবে।
৬৯ বছর বয়সী হৃদ্রোগবিষয়ক সার্জন পেজেশকিয়ানের এ ধরণের অবস্থান ইরানের শিয়া ধর্মতন্ত্রের সংস্কারবাদী রাজনীতিবিদ হওয়ার জটিলতাগুলোকে চিহ্নিত করে— যেখানে পরিবর্তনের কথা বলা হলেও সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ খামেনির তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠা কাঠামোকে কখনোই চ্যালেঞ্জ জানানোর কথা বলা হয় না।
ইরানের ২৮ জুনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ঐতিহাসিকভাবে কম ভোটার দেখা গেছে, ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪০ শতাংশ। তিন কোটির বেশি ভোট গণনার পর মাসুদ পেজেশকিয়ান পেয়েছেন ১ কোটি ৭০ লাখের বেশি ভোট। আর সাইদ জালিলি পেয়েছেন ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি ভোট।
ইরানে আগামী বছরের জুনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও গত ১৯ মে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট পদটি শূন্য হয়ে যায়। সংবিধান অনুযায়ী ৫০ দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা থাকায় আগাম নির্বাচন ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।
রাজনৈতিক অস্পষ্টতা থেকে বেরিয়ে আসার পর ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট খাতামির নেতৃত্বে সংস্কারপন্থী দল মে মাসে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর পর পেজেশকিয়ানকে সমর্থন জানিয়েছিল।
পেজেশকিয়ানের অবস্থান রাইসির অবস্থান থেকে বিপরীত ছিল। আয়াতুল্লাহ খামেনির আস্থাভাজন থাকা রাইসি ইরানে নারীদের সীমিত অধিকার তৈরি এবং পারমাণবিক চুক্তি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছিলেন।
তাই পেজেশকিয়ান অর্থনৈতিক সংকট এবং দমন-নিপীড়ন থেকে ক্লান্ত ইরানের জনগণকে সংস্কারের কথা বললেও সেটি বাস্তবায়ন করা তার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
পেজেশকিয়ান জন্ম ১৯৫৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইরানের মাহাবাদে। তারা বাবা একজন আজেরি এবং মা একজন কুর্দি। তিনি বহুভাষী, আজেরি ভাষায় কথা বলেন এবং ইরানের বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর বিষয়ে তিনি নিবেদিতপ্রাণ। পেজেশকিয়ান ইরান-ইরাক যুদ্ধে কাজ করেছিলেন, মেডিকেল দলগুলোকে সামনের সারিতে প্রেরণ করেছিলেন।
প্রাথমিকভাবে হার্ট সার্জন হিসেবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেজেশকিয়ান পরে তাব্রিজ ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সায়েন্সের প্রধান হন। ১৯৯৪ সালে তার জীবন একটি মর্মান্তিক মোড় নেয় যখন এক গাড়ি দুর্ঘটনায় তার স্ত্রী এবং কন্যা প্রাণ হারায়। তিনি তার অবশিষ্ট সন্তানদের নিজে থেকেই বড় করেন এবং আর কখনো বিয়ে করেননি।
রাজনীতিতে প্রবেশ করে পেজেশকিয়ান ইরানের উপ-স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং পরে সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামির প্রশাসনের অধীনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কানাডিয়ান-ইরানি ফটোগ্রাফার জাহরা কাজেমির মৃত্যুর পরের ময়নাতদন্তের ঘটনায় উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যায় জড়িত হয়েছিলেন। কাজেমি তেহরানের এভিন জেলের একটি বিক্ষোভের ছবি তোলার দায়ে আটক হওয়ার পর নির্যাতিত হয়েছিলেন এবং হেফাজতে মারা গিয়েছিলেন।
পেজেশকিয়ান পরবর্তীতে আইনপ্রণেতা ভূমিকায় আসেন। তিনি তাব্রিজের একজন আইনপ্রণেতা হিসেবে নির্বাচিত হন এবং পরে সংসদের ডেপুটি স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি তার স্বাধীন অবস্থানের জন্য পরিচিত এবং সংস্কারবাদী ও মধ্যপন্থী দাবিকেও সমর্থন করেন। তিনি ইরানের বিপ্লবী গার্ডের প্রশংসাও করেছিলেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও সমালোচনা করেছিলেন।
মাসুদ পেজেশকিয়ান ২০০৮ সাল থেকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় তাবরিজ শহরের হয়ে ইরানের পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন। নির্বাচনের আগে ইরানের প্রধান সংস্কারপন্থী জোটের সমর্থন পাওয়ার পাশাপাশি সাবেক দুই সংস্কারপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি ও হাসান রুহানিরও সমর্থন পেয়েছিলেন তিনি।
২০১১ সালে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য নিবন্ধন করলেও পেজেশকিয়ান তা প্রত্যাহার করে নেন। ২০২১ সালের নির্বাচনে তিনি সে সকল প্রার্থীদের মধ্যে ছিলেন, যাদের ওপর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার নিষেধাজ্ঞা ছিল।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়