আফ্রিকায় কেন বাঘ নেই?
আফ্রিকা মহাদেশে সিংহ, চিতা ও লেপার্ডের মতো প্রাণীগুলো দেখা গেলেও উল্লেখজনকভাবে সেখানে কোনো বাঘ দেখা যায় না। বাঘের বিচরণ কেবল এশিয়াতেই। যদিও আফ্রিকার বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক পরিবেশ বাঘের বসবাসের জন্য উপযুক্ত বলেই মনে করা হয়, তারপরও এ অঞ্চলে প্রাণীটি অনুপস্থিত। কিন্তু কেন?
এ বিষয়ে বলা হচ্ছে- আফ্রিকায় বাঘের অনুপস্থিতির পেছনে প্রাণীটির বিবর্তনের ইতিহাস, ভৌগোলিক ও পরিবেশগত বিষয়গুলো জড়িত।
বাঘের আবির্ভাবের শুরু মূলত এশিয়াতেই। জীবাশ্মের রেকর্ড থেকে জানা যায়, প্রায় ২০ লাখ বছর আগে এশিয়া মহাদেশে এ প্রাণীর পূর্বপুরুষদের আবির্ভাব ঘটেছিল। প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম প্যানথেরা প্যালেওসিনেনসিস (Panthera palaeosinensis)। এরা আধুনিক সময়ের বাঘের তুলনায় ছোট ছিল। এশিয়ার বনাঞ্চল ও তৃণভূমিতে ছিল এদের বিচরণ। ধীরে ধীরে এদের বিকাশ ঘটে এবং এরা এশিয়ার পরিবেশের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছিল।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এদের থেকে বিভিন্ন উপ-প্রজাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। এসব উপ-প্রজাতিও তাদের নির্দিষ্ট আবাসস্থলের সাথে অভিযোজিত হয়েছিল।
যেমন- রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। এদের বেড়ে ওঠা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে। অন্যদিকে সাইবেরিয়ান বাঘের বিচরণ তুষারাবৃত অঞ্চলে।
বাঘের বিবর্তনের বিষয়ে বলা হচ্ছে- ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতার কারণে বাঘের বিবর্তন মূলত এশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। এক্ষেত্রে হিমালয় পর্বতমালা একটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে কাজ করেছিল। এ পর্বতমালার কারণে বাঘের এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে স্থানান্তর বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।
এছাড়াও প্লাইস্টোসিন যুগে স্থলপথের সংযোগের জন্য বহু সেতু তৈরি হয়েছিল। এতে এক মহাদেশের সঙ্গে অন্য মহাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সহজ হয়েছিল। সে সময় এসব সেতু দিয়ে বহু প্রজাতির প্রাণীর এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে চলে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হলেও বাঘ আফ্রিকামুখী হয়নি।
এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে- ওই সময়ে আফ্রিকা যেহেতু সিংহ, লেপার্ড ও চিতার মতো বিভিন্ন ধরনের শিকারি প্রাণীর আবাসস্থল ছিল, তাই হয়ত সেখানে বাঘের বিকাশ হয়নি। এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক বর্জন নীতির সাহায্যে বিষয়টি সহজভাবে বলা যায়। এ নীতি অনুযায়ী- সম্পদ সীমিত থাকলে দুটি প্রজাতি একই জায়গায় অনির্দিষ্টকালের জন্য সহাবস্থান করতে পারে না। সম্ভবত এটি আফ্রিকায় বাঘের বসতি গড়ে না ওঠার অন্যতম কারণ।
আফ্রিকায় বাঘের বসতি গড়ে না ওঠার আরেকটি কারণ হলো শিকার। অর্থাৎ, শিকারের জন্য বাঘের কাছে এশিয়ার পরিবেশ অত্যন্ত যুৎসই। বাঘের অভিযোজন পুরোপুরি এশিয়ার বাস্তুতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত, যা আফ্রিকার থেকে বেশ আলাদা।
যেমন- এশিয়ায় বাঘের আবাসস্থল ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ। এখানে এরাই বনের শীর্ষ শিকারি। এরা বনের গাছপালার আড়ালে লুকিয়ে কিংবা ছদ্মবেশে ওৎ পেতে শিকার করে থাকে।
অন্যদিকে আফ্রিকার সাভানা অঞ্চল উন্মুক্ত। এখানে শিকারের কৌশল ও অভিযোজন প্রক্রিয়া এশিয়া অঞ্চলের চেয়ে ভিন্ন। এখানে কোনো প্রাণীকে শিকারের জন্য তাদের পিছু তাড়া করতে হয়, প্রচণ্ড দৌড়াতে হয়।
এছাড়াও এ অঞ্চলে সিংহ, চিতা বা লেপার্ড যে প্রাণীগুলো শিকার করে থাকে, সেসব প্রাণীর প্রজাতিও এশিয়ার প্রজাতিগুলোর চেয়ে আলাদা। প্রায়শই আফ্রিকার তৃণভোজী প্রাণীরা জোটবদ্ধ হয়ে থাকে। এ কারণে এসব প্রাণী শিকারের কৌশলও এশিয়ার জঙ্গলের চেয়ে সাভানায় আলাদা।
এদিকে মানুষের কার্যকলাপের কারণেও বিভিন্ন অঞ্চলে বাঘের বিচরণ প্রভাবিত হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে তুরস্কের আনাতোলিয়া থেকে রাশিয়ার পূর্ব উপকূল পর্যন্ত এশিয়ার বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে বাঘের বিচরণ ছিল।
ধীরে ধীরে পৃথিবীতে জনসংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে মানববসতি। সেইসঙ্গে বন উজারের হারও বেড়েছে। যে কারণে বাঘেদের আবাসস্থল সংকুচিত হয়েছে এবং মানুষের সঙ্গে এদের সংঘাতও বেড়েছে। এর ফলে বাঘের জনসংখ্যা ব্যাপকভাবে কমেছে।
অন্যদিকে আফ্রিকাতেও বিড়াল জাতীয় বড় এই প্রাণীগুলো একই চাপের সম্মুখীন হয়েছে ঠিকই, তবে এরা মহাদেশটিতে নিজেদের টিকিয়ে রেখেছে।
বর্তমানে সবচেয়ে বেশি তিন হাজার ৬৮২টি বাঘ রয়েছে ভারতে, রাশিয়ায় রয়েছে প্রায় ৫৪০টি। এছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডেও কিছু সংখ্যক বাঘ রয়েছে।
ভারতের প্রজেক্ট টাইগার, রাশিয়ার ল্যান্ড অব দ্য লেপার্ড ন্যাশনাল পার্ক এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিভিন্ন শিকারবিরোধী পদক্ষেপের মতো উদ্যোগ নেওয়ার মাধ্যমে বাঘেদের এ অবশিষ্ট জনসংখ্যা ও তাদের আবাসস্থল সংরক্ষণের প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক