ফাহিম, আদুরে ভাইটি আমার (তৃতীয় কিস্তি)
[গত মাসে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে নিজ অ্যাপার্টমেন্টে নৃশংসভাবে খুন হন বাংলাদেশের জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং অ্যাপ 'পাঠাও'-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহ। তার বড় বোনের এই শোকগাথা এখানে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ প্রকাশ পেল তৃতীয় ও শেষ কিস্তি]
তেত্রিশে পা দেওয়ার পর চিন্তায়-মননে পরিণত হয়ে ওঠে ফাহিম। এতদিন ও ঠাট্টা-তামাশার মধ্য দিয়ে মানুষের জন্য ভালোবাসা প্রকাশ করত। এবার সিদ্ধান্ত নিলো সেই ভালোবাসা প্রকাশ করবে ক্রমউন্নয়নশীল বিশ্বে প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের জীবন বদলে দিয়ে। যেসব পয়সাওয়ালা উদ্যোক্তা কেবল অন্য পয়সাওয়ালা উদ্যোক্তাদের সঙ্গে মজা করে সময় কাটায়, তাদের মতো ধনী ব্যবসায়ী হওয়ার কোনো আগ্রহ ছিল না শূন্য থেকে শুরু করা ফাহিমের।
অভাবী মানুষের জন্য প্রাণ কাঁদত ওর। নাইজেরিয়ায় চালু করা মোটরবাইক রাইডিং অ্যাপ গোকাদা নিয়ে আলাপ করার সময় বলত, 'এই ড্রাইভাররা আমার ওপর নির্ভরশীল।' ছোটবেলায় যেমন বাবার কষ্ট কমানোর প্রতিজ্ঞা করেছিল, বড় হয়ে তেমনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিল আরও অগণিত মানুষের কষ্ট কমাবার কাজে।
গত কয়েক বছরে কেবল পেশাজীবনেই নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও পরিণত হয়ে উঠছিল ও। নিজের নতুন অ্যাপার্টমেন্ট সাজানো নিয়ে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ছিল আমার ভাই। এ নিয়ে প্রায়ই ফেসটাইমে কথা বলত মায়ের সঙ্গে। রান্নার প্রতি ভালোবাসা বাড়ছিল ওর। আগের চেয়েও মনোযোগ দিয়ে তিন বছর বয়সি পমস্কি, লায়লার যত্ন নিচ্ছিল। জীবনটাকে একটা ছন্দোবদ্ধ কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসছিল ও, ধীরে ধীরে থিতু হচ্ছিল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এ দুটো জিনিস আনতে হয়েছিল ওকে। অসংখ্য পরিকল্পনা করে যাচ্ছিল ভবিষ্যৎ নিয়ে।
কিন্তু ২০২০ সালের জুলাইয়ের ১৯ তারিখে, হাডসন ভ্যালিতে চিরনিদ্রায় শুইয়ে দিয়ে আসতে হয়েছে আমার মিষ্টি ভাইটাকে। আমার সুন্দর বাচ্চাটার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করতে হয়েছে আমাকে। এর তিন দিন আগে ফিউনারেল হোম থেকে ফোন করে জানানো হয়েছিল, কবর দেওয়ার আগ মুহূর্তে ছাড়া ওর খণ্ডিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আর মাথা জায়গামতো বসিয়ে সেলাই করা যাবে না। খবরটা শুনেই চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম আমি। ফারাওয়ের মতো দুই হাত ভাঁজ করে রেখেছিলাম বুকের ওপর।
ফোনটা সর্বশক্তিতে চেপে ধরেছিলাম শরীরের সাথে। অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করার জন্য হাত দুটো মুঠো পাকিয়ে প্রচণ্ড জোরে চেপে ধরেছিলাম বুকের ওপর। তারপর ফিউনারেল হোমের লোকটাকে অনুরোধ করেছিলাম আমার আদরের ভাইটার সবগুলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন যথাস্থানে থাকে।
কবর দেওয়ার আগের দিন আবার ফোন করল লোকটা। বলল, 'কাজটা সহজ হয়নি, তবে ওকে আবার ঠিকমতো জোড়া দিতে পেরেছি আমরা।'
শেষকৃত্যের দিন ভোর তিনটা। বোনের বিছানায় শুয়ে আছি নিস্তেজ আমি, মনটা ভীষণ অস্থির। ফাহিমের ঘর থেকে বাবা-মার ফোঁপানোর আওয়াজ ভেসে আসছে। ঘরটায় আমাদের ছোটবেলার ছবি টাঙানো আছে। বাবা-মার চাপা গলার কথা বোঝার চেষ্টা করছিলাম আমি।
প্রচণ্ড গরম পড়ল সেদিন। দূর থেকে, ক্যামেরার চোখে দেখলে মনে হবে সবুজ ঘাসের গালিচার ওপর দাঁড়িয়ে আছি আমরা। চারদিক থেকে আকাশচুম্বী গাছেরা ঘিরে রেখেছে আমাদের। ঝিরঝিরি বাতাসে দুলছে পত্র-পল্লব। আমার পরিবার আর আমি স্থির তাকিয়ে আছি শবাধারে শায়িত আমাদের মিষ্টি ছেলেটার দিকে। দেখে মনে হচ্ছে প্রশান্তির নিদ্রা দিচ্ছে বাচ্চাটা।
ওর শরীর একটা সাদা কাপড়ে মোড়ানো, ধড়ের ওপর বরফের প্যাক রাখা। ওর সুন্দর চোখের পাতা লেপটে রয়েছে ত্বকের সাথে। মাথার চুলগুলো সবসময়ের মতো খাড়া হয়ে নেই, লেপটে রয়েছে খুলির সাথে। রোদে ঝিকমিক করছে সোনালি চুলের ডগা।
শবাধারের কাছে এগিয়ে গেলেন বাবা। বরাবরের মতো স্নেহমাখা কণ্ঠে বলতে লাগলেন, 'ফাহিম সালেহ, তোকে চুলে রং করতে মানা করেছিলাম না? মানা করিনি আমি?' বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি।
মা বারবার বলতে লাগলেন, 'ঠিক আছে, এবার তুই ঘুমা, সোনা। একটু বিশ্রাম নে। এবার ঘুমিয়ে পড়।'
কবরস্থানের কর্মীরা আমার ভাইয়ের শবাধার নিচে নামাতে উদ্যত হতেই, কবরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন বাবা, 'ফাহিম, যাসনে। ফাহিম, যাসনে। ফাহিম, ফাহিম রে, ফাহিম, ফাহিম…।'
এক মাস আগে, ২০২০-এর জুলাইয়ের ১৩ তারিখে, বাইরে থেকে তিন মাইল দৌড়ে এসে অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকতেই খুন করা হয় আমার ভাইকে। এখনো মাঝে মাঝে মনে হয় ফাহিমের চলে যাওয়াটা সত্যি হতে পারে না। কখনো কখনো আবার ওর চলে যাওয়ার সত্যটা নিষ্ঠুর, অসহ্য বাস্তবতা হয়ে বুকটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়। চোখের সামনে তখন অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখি না। হৃদয়ের প্রতিটা ইঞ্চি অসহ্য যন্ত্রণায় অসাড় হয়ে আসে।
আমাদের জীবনে ফাহিমের চেয়ে বিশেষ উপহার আর একটাও ছিল না। সেই উপহারটিকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এখন আমাদের বাবার দিন কাটে ফাহিমের কুকুর লায়লার পাশে বসে, তার সঙ্গে কথা বলে। আমার ভাইয়ের সঙ্গে যে স্নেহমাখা কণ্ঠে কথা বলতেন, ঠিক সেই সুরে কথা বলেন কুকুরটার সঙ্গে। বাকি সময়টা কাটান মৃত ছেলের অর্জন নিয়ে পড়াশোনা করে আর তার ভিডিও দেখে।
আমার মায়ের দিন কাটে কেঁদে কেঁদে। রাতে মা ঘুমাতে পারেন না।
থ্যাঙ্কসগিভিং আমাদের পরিবারের সবচেয়ে প্রিয় ছুটি। এ বছর এই ছুটিতে বড় কঠিন সময় যাবে আমাদের। থ্যাঙ্কসগিভিংয়ের ছুটিতে ফাহিম সবসময় গার্লিক ম্যাশড পটেটো বানাত। গত সপ্তাহে ভাবছিলাম, বরাবরের মতো বাবা-মার ওখানে না করে এ বছরের থ্যাঙ্কসগিভিংটা আমার এখানেই আয়োজন করব। আমি যেখানে থাকি, সে জায়গাটা বছরভর উষ্ণ থাকে। এই নতুন পরিবেশে আমাদের শোকের বোঝা হয়তো খানিকটা কমবে। এখানকার রান্নাঘরের দরজা দিয়ে অনবরত আসা-যাওয়া করবে না আমাদের ফাহিম, ওর জ্যাকেট আর ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলবে না মেঝের ওপর, পরিবারের সবাইকে নিয়ে বসে গার্লিক ম্যাশড পটেটোর রেসিপিও গুগল করবে না ওর ফোনে।
- অনুবাদ: মারুফ হোসেন
সূত্র: মিডিয়াম ডটকম