জ্বালানি তেল রিফাইনারি স্থাপনে এস আলম গ্রুপের প্রস্তাবে বিপিসির সায়
দেশের একমাত্র জ্বালানি তেল পরিশোধনকারী কোম্পানি ইষ্টার্ন রিফাইনারী লিমিটেডের (ইআরএল) দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনে বেসরকারি খাতের এস আলম গ্রুপের বিনিয়োগ প্রস্তাবে ইতিবাচক সায় দিয়েছে ইআরএলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)।
ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনে এস আলম গ্রুপের প্রস্তাবটি ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করা যেতে পারে, এমন মন্তব্য করে একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন জ্বালানি বিভাগে পাঠিয়েছে বিপিসি। বিপিসি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জ্বালানি বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে বলেন, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতামতের ভিত্তিতে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিলে ইআরএল ও এস আলমের মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হবে।
জ্বালানি তেল আমদানি কমানোর জন্য ইআরএলের পরিশোধন সক্ষমতা বাড়াতে ২০১২ সাল থেকে ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিপিসি ১৩ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করেছে।
১৯৬৮ সালে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করা ইষ্টার্ন রিফাইনারি বছরে ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধনে সক্ষম। আর দেশের বার্ষিক জ্বালানি তেলের চাহিদা ৬৫-৭০ লাখ টন।
বিপিসি সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রতি বছরই একটু একটু করে জ্বালানি তেলের চাহিদা বাড়ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট জ্বালানি তলের ব্যবহার ৫৫ লাখ টনের বেশি ছিল।
ইষ্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান টিবিএসকে ৯ জুলাই বলেন, 'ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট একসময় সরকারি অর্থায়নে করার পরিকল্পনা ছিল। সে অনুযায়ী একটি ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে বেশ আগে জমা দেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন কারণে সেটা এগোয়নি।'
এদিকে জ্বালানি বিভাগ গত বছরের নভেম্বরে বেসরকারি পর্যায়ে রিফাইনারি স্থাপন, অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিপূর্বক মজুত, প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন ও বিপনন নীতিমালা করে। এ নীতিমালা ঘোষণার পর গত জানুয়ারিতে এস আলম গ্রুপ ইষ্টার্ন রিফাইনারীর সঙ্গে যৌথভাবে রিফাইনারি স্থাপনের আগ্রহ দেখিয়ে জ্বালানি বিভাগের কাছে প্রস্তাব দেয়। জ্বালানি বিভাগ প্রস্তাবটি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য বিপিসিতে পাঠায় বলে জানান তিনি।
সূত্র জানায়, বিপিসি এস আলম গ্রুপের প্রস্তাব যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সাত সদস্যের একটি কমিটি করে দিয়েছিল। কমিটির কাজ ছিল দ্রুত এস আলমের প্রস্তাব পর্যালোচনা করে সুপারিশ করবে যে প্রস্তাবটি গ্রহণ করা যায় কি না। কমিটি তাদের পর্যালোচনা প্রতিবেদন চুড়ান্ত করে ৮ জুলাই বিপিসির চেয়ারম্যান বরাবর জমা দিয়েছে। ৯ জুলাই বিপিসির চেয়ারম্যান ওই পর্যালোচনা প্রতিবেদন জ্বালানি বিভাগে পাঠিয়েছেন।
এ বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান ১০ জুলাই টিবিএসকে বলেন, 'বিষয়টি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। আলোচনা হচ্ছে। এখন মন্ত্রণালয় বা সরকার এস আলম গ্রুপের প্রস্তাব উপযুক্ত মনে করলে পরবর্তী ধাপে যাবে। এজন্য অবশ্য বেশ সময় লাগবে। কারণ এটি বেশ বড় ধরনের বিনিয়োগ।'
তিনি বলেন, 'এখন সরকার সম্মত হলে দুই পক্ষের মধ্যে নন-বাইন্ডিং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে। এরপর ফিজিবিলিটি স্টাডি হবে।'
বিনিয়োগটি কি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) আওতায় হবে নাকি বেসরকারি পর্যায়ে হবে, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এখন পর্যন্ত বলা যাবে, পার্টনারশিপ হবে। তবে বিস্তারিত খুঁটিনাটি দুই পক্ষের আলোচনার বিষয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে কী হবে, সে বিষয়ে এখনই মন্তব্য করার সময় হয়নি।'
চুক্তি স্বাক্ষর হবে কবে?
জ্বালানি বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে বলেন, এস আলম গ্রুপের প্রস্তাব বিষয়ে বিপিসির পাঠানো প্রতিবেদন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের কাছে উপস্থাপন করা হবে। এরপর এ বিভাগের মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতামতের ভিত্তিতে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, 'এখন জ্বালানি বিভাগ যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেই অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে বিপিসি। জ্বালানি বিভাগ এই প্রস্তাবে সম্মতি দিলে দ্রুতই ইআরএল ও এস আলম গ্রুপের মধ্যে নন-বাইংডিং এমওইউ সই হবে। এই এমওইউর অর্থ হচ্ছে, উভয়পক্ষ যৌথভাবে ইআরএল দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনে সম্মত।'
এরপর কোন পক্ষের শেয়ার বা ইক্যুইটি কত, কীভাবে পরিচালনা হবে, লভ্যাংশ ভাগ হবে, এসব উল্লেখ করে চূড়ান্ত চুক্তি হবে। এস আলম গ্রুপ তাদের প্রস্তাবে প্রস্তাবিত রিফাইনারির ৮০ শতাংশ মালিকানা চেয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
সূত্রমতে, ফ্রান্সের কোম্পানি টেকনিপ-কে দিয়ে ইতিমধ্যে ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের ডিজাইন তৈরি করা হয়েছে। ডিজাইন অনুযায়ী, প্রস্তাবিত রিফাইনারির বার্ষিক পরিশোধন সক্ষমতা ৩০ লাখ টন। এই পরিশোধনাগারে কয়েক ধরনের অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন করার সুযোগ রাখা হবে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে।
ইষ্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান বলেন, 'জ্বালানি তেল পরিশোধন খাতে বিনিয়োগের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের জ্বালানি তেলের চাহিদা বিবেচনায় বলা যেতে পারে এ ধরনের প্রকল্পের বিনিয়োগ চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে উঠে আসবে। কারণ অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে রিফাইন করলে প্রতি লিটারে ১১ টাকা সাশ্রয় হয়।'