গুলিবিদ্ধ অন্দোলনকারীদের পানি খাওয়াতে গিয়ে প্রাণ হারান কুষ্টিয়ার আলমগীর
সংসারের হাল ধরতে নিজ এলাকায় থাকা অবস্থায় গাড়ি চালানো শেখেন কুষ্টিয়ার মো. আলমগীর শেখ (৩৬)। এরপর জীবিকার তাগিদে ২০ বছর আগে তিনি ঢাকায় পাড়ি জমান। গত আট বছর ধরে ঢাকার রামপুরা এলাকায় হেলথকেয়ার ফার্মাসিটিক্যাল লিমিটেডে গাড়িচালকের চাকরি করতেন তিনি। বেতন যা পেতেন, তা দিয়ে ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা, বাসাভাড়া ও সংসারের খরচ চলত না। তাই অবসরে অ্যাপসভিত্তিক পাঠাও মোটরবাইক চালাতেন আলমগীর।
গত ১৯ জুলাই বিকেলে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে রামপুরা বিটিভি ভবন এলাকায় সংঘর্ষে গুলিতে নিহত হন আলমগীর। তার গুলিবিদ্ধ মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই গত রবিবার গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়। সেখানেই তাকে দাফন করা হয়।
আলমগীর কুমারখালীর উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নের কসবা গ্রামের মুদি দোকানি মো. ইজারুল হকের ছেলে। পাঁচ ছেলের মধ্যে তিনিই বড়। গত শনিবার গভীর রাতে অ্যাম্বুলেন্সে করে গ্রামের বাড়িতে লাশ পৌঁছে দেয় আলমগীরের কোম্পানির লোকজন।
আলমগীরের পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠ বাবা-মা ছাড়া আছেন স্ত্রী রিমা খাতুন (৩০), মেয়ে তুলি খাতুন (১১), ছেলে আব্দুল আওলাদ (৭) ও ছোট ভাই আজাদ হক (১৮)।
আলমগীরে পরিবার জানায়, গত ১৯ জুলাই জুমার নামাজ শেষে স্ত্রীকে রান্নার কথা বলে রামপুরা এলাকায় অফিসের উদ্দেশে বেরিয়েছিলেন আলমগীর। ওই সময় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত কয়েকজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সড়কে দেখতে পান তিনি। তাই তাদের বোতল থেকে পানি পান করাতে যান তিনি। তখনই ওপর থেকে ছোঁড়া তিনটি গুলিতে আহত হন আলমগীর।
পরে আহত আলমগীরকে ঢাকার একটি হাসপাতালে নিয়ে যান তার কোম্পানির লোকজন। কিন্তু উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে সেদিন হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক ছিল না। ওই অবস্থায় আলমগীরকে মৃত ভেবে হাসপাতাল থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
ঘটনার সপ্তাহখানেক পেরিয়ে গেলেও শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি আলমগীরের পরিবার। বাড়িতে কেউ এলেই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন মা। আলমগীরকে হারিয়ে অসহায়-দিশেহারা তার স্ত্রী, সন্তান ও ভাই।
বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) দুপুরে আলমগীরের বাড়িতে গেলে তার মা আলেয়া খাতুন জানান, আলমগীর ধার্মিক ছেলে ছিল। গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা অন্দোলনকারীদের পানি খাওয়াতে গিয়েছিলেন তিনি। তখন উপর থেকে তিনটি গুলি এসে তার শরীরে লাগে।
আলেয়া খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, 'আমার বেটা তো আর ফিরে আসবে না। এখন ওর বউ, ছোয়ালপালের দেখবি কিডা? বাড়িছাড়া জাগাজমি কিচ্ছু নাই। ক্যাম্বা (কীভাবে) চলব? সরকার যদি একটু দেখতে তবেগা বাঁচতাম।'
স্ত্রী রিমা খাতুন বলেন, 'চাকরির টাকায় সংসার চলত না। তাই ও (স্বামী) অবসরে পাঠাও মোটরবাইক চালাত। এখন তো সব শ্যাষ।'
শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, ছেলেমেয়ে নিয়ে কীভাবে চলবেন এই ভাবনাতেই দিশেহারা রিমা খাতুন। কোম্পানি ও সরকারের কাছে সহযোগিতার প্রত্যাশা করেছেন তিনি।
ছোট ভাই আজাদ হক জানান, তার ভাইকে হাসপাতালে নেওয়া হলেও ডাক্তার ছিল না। তার ভাই চিকিৎসা পায়নি। শরীর থেকে গুলিও বের করা হয়নি। গুলিসহ তার ভাইকে দাফন করা হয়েছে।
বাবা ইজারুল হক বলেন, 'আমি বুড়ো মানুষ। বড় ছেলেই ছিল সবার ভরসা। ঘরের সাথে ছোট দোকানে তেমন বেচাকেনা হয় না। দুশ্চিন্তায় আছি পরিবার নিয়ে।'
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম বলেন, 'ক্ষতিগ্রস্থ স্বজনদের খোঁজ-খবর নেওয়াসহ তালিকা করা হচ্ছে। সরকারিভাবে কোনো নির্দেশনা আসলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'