পার্টনারের ছেলে যেভাবে দুর্ধর্ষ মাদকসম্রাট এল মায়োকে এফবিআই’র কাছে ধরিয়ে দিল
মেক্সিকোর সিনালোয়া কার্টেলের প্রধান 'এল মায়ো' জামবাদা এবং আলোচিত মাদকসম্রাট 'এল চ্যাপো'র ছেলে জোয়াকিন গুজমান লোপেজকে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের এল পাসো থেকে গ্রেফতার করেছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ।
বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) তাদের বহনকারী একটি প্রপেলার বিমান অবৈধভাবে মার্কিন-মেক্সিকো সীমানা অতিক্রম করে টেক্সাসের এল পাসোর নিকটবর্তী একটি ছোট বিমানবন্দরে অবতরণ করলে, আগে থেকে ওত পেতে থাকা মার্কিন এজেন্টরা সাথে সাথে হানা দিয়ে গ্রেফতার করেন কার্টেলের অন্যতম এই দুই সদস্যকে।
ঘটনার সাথে জড়িত বর্তমান ও সাবেক মার্কিন কর্মকর্তারা জানান, কারাবন্দি প্রাক্তন সিনালোয়া কার্টেল কিংপিন জোয়াকিন এল চ্যাপোর ছেলে লোপেজ আগে থেকেই আত্মসমর্পণের বিষয়ে মার্কিন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে রেখেছিলেন। কিন্তু এল মায়ো এব্যাপারে কিছুই জানতেন না। এল চাপোর ছেলে এল মায়োকে ধরিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে ছলে কৌশলে বিমানে করে তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসেন।
সূত্র জানায়, মার্কিন কর্তৃপক্ষ এবং এল চ্যাপোর ছেলে জোয়াকিন গুজম্যান লোপেজের মধ্যে দীর্ঘ আত্মসমর্পণ আলোচনার পর এল মায়ো জাম্বাদাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, 'এল মায়োকে ধরতে পারা একটা বিরাট ব্যাপার। এটা মোটেও প্রত্যাশিত ছিল না'।
এল চাপোর ছেলেকে আত্মসমর্পণের বিষয়ে চাপ দিতে থাকলেও মার্কিন কর্মকর্তারা আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে লোপেজের এল মায়োকে নিয়ে আসার একটি বার্তা তাদের চার দশকের অপেক্ষার অবসান ঘটায়। তার বার্তা পাওয়ার পরপরই এফবিআই এবং হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ইনভেস্টিগেশনস (এইচএসআই) বিমানবন্দরে পৌঁছায়।
উত্তর মেক্সিকোতে একটি রিয়েল এস্টেট পরিদর্শনের কথা বলে এল মায়ো জামবাদাকে বিমানে তোলেন লোপেজ। কিন্তু বিমান উত্তর মেক্সিকোতে না গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডোনা আনা কাউন্টি ইন্টারন্যাশনাল জেট পোর্টে অবতরণ করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানবন্দরের এক কর্মী রয়টার্সকে বলেন, বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনি বিচক্র্যাফট কিং এয়ারের একটি বিমানকে রানওয়েতে অবতরণ করতে দেখেছেন, যেখানে ফেডারেল এজেন্টরা আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল।
তিনি বলেন, 'বিমান থেকে দুই ব্যক্তি নামেন এবং কোনো ঝামেলা ছাড়াই কর্মকর্তারা তাদেরকে গ্রেফতার করেন'।
২০১৭ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছেন এল চাপো। কারাগার থেকেই বসেই এল চাপো, এল মায়োর সহযোগিতায় বিশ্বের অন্যতম কুখ্যাত মাদক চক্র সিনালোয়া কার্টেলের কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। বিশ্বের অন্তত ৫০টি দেশে 'ফেনটালিন' নামক মাদক পাচার করে সিনালোয়া কার্টেল।
ঠিক কী কারণে লোপেজ তার বাবার দীর্ঘ দিনের মিত্র এল মায়োর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তা জানা না গেলেও, মার্কিন কর্মকর্তারা দাবি করছেন, এল চাপোর আরেক ছেলে ওভিদিওর সাজা কমাতেই মার্কিন কর্তৃপক্ষের সাথে সমঝোতায় পৌঁছান তার ছোট ভাই লোপেজ।
উল্লেখ্য, ওভিদিওকে ২০২৩ সালে গ্রেফতার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ করা হয়েছিল।
৭০ বছর বয়সি এল মায়ো জামবাদার অপ্রত্যাশিত গ্রেফতার ও এল চাপোর ছেলের বিশ্বাসঘাতকতা, সিনালোয়া কার্টেলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে।
মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে গুজম্যান লোপেজের নেপথ্য যোগাযোগ আইনজীবীদের মাধ্যমে হয়েছে বলে জানিয়েছেন এক মার্কিন কর্মকর্তা। তবে দুই ভাইয়ের আইনজীবী জেফ্রি লিচটম্যান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
হুইলচেয়ারে বসা এল মায়ো জামবাদা শুক্রবার টেক্সাসের একটি আদালতে মাদক ব্যবসা, মাদক আমদানির ষড়যন্ত্র এবং অর্থ পাচারসহ সকল অভিযোগে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন।
তার আইনজীবী ফ্রাঙ্ক পেরেজ শুক্রবার বলেন, জামবাদা স্বেচ্ছায় যুক্তরাষ্ট্রে আসেননি। এবং শনিবার পেরেজ বলেন, গুজম্যান লোপেজ এল মায়োকে 'জোর করে অপহরণ' করেছেন এবং তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে এসেছেন।
গুজম্যান লোপেজকে অবশ্য আগামী সপ্তাহে শিকাগোর আদালতে হাজির করা হবে, যেখানে প্রায় ছয় বছর আগে তাকে প্রথম মাদকের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে ফেনটানিলের সবচেয়ে বড় পাচারকারী সিনালোয়া কার্টেল। ফেনটানিল ওভারডোজ ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সি আমেরিকানদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে।
শুক্রবার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই গ্রেফতারের প্রশংসা করেছেন এবং ফেনটালিনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
একজন মার্কিন কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন যে অত্যন্ত সতর্ক এবং অভিজ্ঞ কার্টেল নেতা জামবাদা কীভাবে সেই বিমানে উঠলেন তা নিয়ে এখনও অনেক প্রশ্ন রয়েছে।
মেক্সিকোর নিরাপত্তামন্ত্রী রোসা রদ্রিগেজ বলেছেন, মেক্সিকোকে এল মায়োকে গ্রেফতারের বিষয়ে আগে থেকে অবহিত করা হয়েছিল, কিন্তু মেক্সিকো সরাসরি এই অভিযানে অংশ নেয়নি।
বিদায়ী প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাদর কার্টেলদের ব্যাপারে বেশ সতর্ক এখন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতাও কিছুটা সীমিত করে দিয়েছেন, কারণ শক্তিশালী কিংপিনদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার ফলে মেক্সিকোতে প্রায়ই সহিংসতা বাড়ে।
২০১৯ সালের অক্টোবরে, মেক্সিকোর সামরিক বাহিনী এল চাপোর ছেলে ওভিদিওকে গ্রেফতার করেছিল কিন্তু সিনালোয়ার রাজধানী কুলিয়াকান শহর অবরোধ করে রাখা সিনালোয়া কার্টেল সৈন্যদের সাথে বন্দুক যুদ্ধে লড়াই করার পর শেষে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল।
অবশ্য ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ওভিদিওকে আবার গ্রেফতার করা হয় এবং সেপ্টেম্বরে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ করা হয়।
গুজম্যান লোপেজ এবং অন্যান্য সিনালোয়া কার্টেল সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে কাজ করা প্রাক্তন এইচএসআই এজেন্ট ম্যাথিউ অ্যালেন বলেছেন, জামবাদা এবং গুজম্যান লোপেজ উভয়ই বছরের পর বছর ধরে আত্মসমর্পণের বিষয়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা চালিয়ে আসছিলেন।
তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে অনেক মাদক চোরা কারবারিরা, বিশেষত অল্প বয়সীরা, আত্মসমর্পণ করা এবং কিছু সময় কারাগারে কাটানোকে মৃত্যু বা যাবজ্জীবন কারাবাসের ঝুঁকির চেয়ে ভালো বলে মনে করে। এই চিন্তা থেকেই অনেকেই আত্মসমর্পণ চুক্তিতে রাজি হচ্ছেন, যাদেরকে অনেককেই পরে সাক্ষী সুরক্ষা প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন