২০৩২ সাল পর্যন্ত ভ্যাট মওকুফ চায় মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ
মেট্রোরেলের ভাড়ার ওপর ২০৩২ সাল পর্যন্ত মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আরোপ না করতে বলেছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। এর আগে ভ্যাট আরোপ করা হলে মেট্রোরেলের ১৬টি স্টেশনে ব্যবহৃত ৮৪ কোটি টাকা মূল্যের টিকিট ভেন্ডিং মেশিন (টিভিএম) প্রতিস্থাপন করতে হবে।
এদিকে, চলতি অর্থবছরের বাজেটে আরোপিত মেট্রোরেলের টিকিট মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, যা এখনও আদায় শুরু করেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
বর্তমান ভাড়ার সঙ্গে এই ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করতে গেলে খুচরা টাকার হিসাব যুক্ত হবে। কিন্তু মেট্রো স্টেশনগুলোতে স্থাপন করা কোটি টাকা দামের টিকিট ভেন্ডিং মেশিন দিয়ে খুচরা টাকা আদায় করা সম্ভব নয়। তাই টিকিটের মূল্যের ওপর ভ্যাট আদায় করতে হলে এসব মেশিন প্রতিস্থাপন করতে হবে— যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার বলে মনে করছে মেট্ররেল কর্তৃপক্ষ।
এর বিকল্প হিসেবে মেট্রোরেলের টিকিটের দাম অপরিবর্তিত রেখে বিদ্যমান ভাড়া থেকে পরোক্ষ ভ্যাট আদায়ের চিন্তা করেও সরকারের কোনো লাভ হচ্ছে না। এই পদ্ধতিতে এখনকার দামে টিকিট বিক্রি করে পাওয়া অর্থ থেকে ভ্যাট পরিশোধ করবে ডিএমটিসিএল। এতে কোম্পানি যে পরিমাণ ভ্যাট পরিশোধ করবে, সরকারকে ওই পরিমাণ অর্থ অতিরিক্ত ভর্তুকি পরিশোধ করতে হবে।
গত ৪ জুলাই সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী'র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় মেট্রোরেলের ভাড়া থেকে ভ্যাট আদায়ে এসব সমস্যা উঠে এসেছে। সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে এসব তথ্য। সভায় অংশ নেওয়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রতিনিধিরাও ভ্যাট আরোপের মাধ্যমে জনগণের ওপর বাড়তি ভাড়া আরোপ না করার পক্ষে মতামত দেন।
এদিকে, ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক সভায় জানান, "বর্তমান ভাড়ার সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট যুক্ত হলে খুচরা টাকা লাগবে। কিন্তু মেট্রোরেলের ১৬টি স্টেশনে ৮৪টি টিভিএম দিয়ে খুচরা টাকা আদায় করা সম্ভব হবে না। ৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এই ৮৪টি মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। এখন টিকিটের মূল্যের ওপর ভ্যাট আদায় করতে হলে এসব মেশিন প্রতিস্থাপন করতে হবে, যা খুবই ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ।"
তাই ২০৩২ সাল পর্যন্ত মেট্রোরেল সেবার ওপর কোনো ধরনের ভ্যাট আরোপ না করার অনুরোধ করেন তিনি।
এমএএন সিদ্দিক জানান, "প্রতিদিন সকাল ৭টা ১০ মিনিট থেকে রাত ১০টা ১৪ মিনিট পর্যন্ত ১৯৬ বার মেট্রোরেল চলাচল করে, এতে দৈনিক প্রায় ৩ লাখ যাত্রী চলাচল করছেন। জনগণের ট্রাভেল টাইম কস্ট বাবদ দৈনিক ৮.৩৮ কোটি টাকা এবং ভেইকেল অপারেশন কস্ট বাবদ দৈনিক ১.১৮ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে।"
ডিএমটিসিএল জানিয়েছে, ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন-৬) প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হবে। প্রকল্পটি এখনও চলমান থাকায় এবং পূর্ণ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে না যাওয়ায় অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বাংলাদেশের জন্য মেট্রোরেল একটি ইনফ্যান্ট ইন্ডাস্ট্রি।
"বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সকল ধরনের ইনফ্যান্ট ইন্ডাস্ট্রিকে দীর্ঘমেয়াদী রেয়াত সুবিধা দিয়ে থাকে। এ বিবেচনাতেও মেট্রোরেলের সেবার ওপর কোনো ধরনের ভ্যাট আরোপ না করা সমীচীন," বলেন এমএএন সিদ্দিক।
এদিকে এনবিআরের কমিশনার (কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা দক্ষিণ) শওকত আলী সাদী বলেন, "মেট্রোরেলের ভ্যাট আদায়ে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়ে সরকারের কোনোরূপ সিদ্ধান্ত না থাকায় ভ্যাট আদায় করা হবে।"
এক্ষেত্রে এনবিআরের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় টেকনিক্যাল সাপোর্ট দেওয়ার বিষয়ে আশ্বাস দেন তিনি।
এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন-২০১২ এর বিদ্যমান ধারা অনুযায়ী মেট্রোরেল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গণপরিবহন বিবেচনায় বাংলাদেশ রেলওয়ের তাপানুকুল সার্ভিসের মতো মেট্রোরেলের যাত্রী সেবার ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে।
এদিকে, এনবিআরের এই যুক্তি খণ্ডন করে ডিএমটিসিএল জানায়, বাংলাদেশ রেলওয়ের যাত্রীদের শ্রেণিবিন্যাস থাকলেও মেট্রোরেলের যাত্রীদের কোনো শ্রেণিবিন্যাস নেই। তাই ওই আইন অনুযায়ী মেট্রোরেলের সেবার ওপর ভ্যাট আরোপের সুযোগ নেই।
এর আগে, এক বছরের জন্য মেট্রোরেল সেবার ওপর ভ্যাট মওকুফ করে সরকার, যার মেয়াদ চলতি ২০২৪ সালের ৩০ জুন তারিখে শেষ হয়েছে।
সিদ্ধান্ত নিতে কমিটি গঠন
এ অবস্থায় মেট্রোরেলের ভাড়া হতে ভ্যাট আদায়ের বিষয়ে সুপারিশ দেওয়ার জন্য ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটির নির্বাহী পরিচালক নিলীমা আখতারকে প্রধান করে ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার। আগামী এক মাস, অর্থাৎ ২৮ আগস্টের মধ্যে কমিটিকে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
কমিটির কার্যবিবরীতে বলা হয়েছে, 'জনগণের সামর্থ্য ও মেট্রোরেলের পরিচালন ব্যয়ের বর্তমান অবস্থা এবং মেট্রোরেল ব্যবহারে মানুষের মধ্যে যে উৎসাহ, উদ্দীপনা ও প্রয়োজনীয়তা আছে, তা অক্ষুন্ন রেখে মেট্রোরেলের ১৬টি স্টেশনে চালুরত মোট ৮৪টি টিভিএম এর টেকনিক্যাল ও ব্যয়ের বিষয় বিবেচনা করে মেট্রোরেলের যাত্রীসেবার উপর ১৫% ভ্যাট আরোপ বিষয়ে সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন দেবে।'
সভায় ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটির নির্বাহী পরিচালক নিলীমা আখতার বলেন, "জনগণের সামর্থ্য ও মেট্রোরেলের পরিচালন ব্যয় বিবেচনা করে এর ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। মেট্রোরেলের ভাড়া থেকে ভ্যাট আদায়ের বিষয়ে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত অবশ্যই প্রতিপালন করতে হবে। তবে মেট্রোরেল ২০৩৪ সালে লাভজনক হবে বিধায় এর আগে ভ্যাট আদায় করতে হলে ব্যাপক স্টাডি করা প্রয়োজন।"
সভায় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুবের রহমান বলেন, "এমআরটি-১, এমআরটি-৫ ও এমআরটি-৫ প্রকল্প এখনও চলমান। এই লাইনগুলো সম্পন্ন হওয়ার পর ডিএমটিসিএল এর আয় বাড়বে এবং কোম্পানির নন-ফেয়ার বিজনেস বাড়ার পর ভ্যাট আদায়ের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া যৌক্তিক হবে।"