রংপুরে আবু সাঈদ হত্যা মামলা: ১৬ বছর বয়সি সেই কিশোরের জামিন
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদের বুক ও পেটে গুলিতে মৃত্যু ঘটনায় হওয়া মামলায় একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. আলফি শাহরিয়ার মাহিমের জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) রংপুর শিশু আদালতের বিচারক মোস্তফা কামাল মাহিমের জামিন মঞ্জুর করেছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কোর্ট ইন্সপেক্টর প্রিত্তিশ কুমার সরকার। তিনি বলেন, দুপুর একটার দিকে শুনানি শেষে আদালত মাহিমের জামিন মঞ্জুর করেছেন।
মাহিমকে গত ১৬ জুলাই আটক করা হয়। পরের দিন ১৭ জুলাই আবু সাঈদ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। মামলার বাদী ওই থানার উপপরিদর্শক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বিভূতি ভূষণ রায়।
মাহিমের পরিবারের লোকজনের দাবি, তার বর্তমান বয়স ১৬ বছর ১০ মাস। সে রংপুর পুলিশ লাইন্স স্কুল এন্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী।
মামলার সংক্ষিপ্ত এজাহারে উল্লেখ করা হয়, 'বেলা ২টা ১৫ মিনিটের দিকে ছাত্র নামধারী সুবিধাভোগী রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনরত দুর্বৃত্তগণ বিভিন্ন দিক থেকে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ও তাদের নিকটে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র হতে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশও এপিসি গাড়ির মধ্য হতে কং/ ১১৮৬ সোহেল তার নামীয় সরকারি ইস্যুকৃত শটগান হইতে ১৬৯ রাউন্ড রাবার বুলেট ফায়ার করে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।'
সাঈদের মৃত্যুর বিষয়ে বলা হয়, 'বিভিন্ন দিক থেকে আন্দোলনকারীদের ছোড়া গোলাগুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের এক পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। সহপাঠীরা ধরাধরি করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা দুই থেকে তিন হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।'
এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় আলফিকে। তাকে গ্রেপ্তার ও কারাগারে আটকের ঘটনা নিয়ে তার বোন সানজানা আক্তার স্নেহা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে বিষয়টি আলোচনায় আসে।
ফেসবুকে স্নেহা লেখেন, গত ১৮ জুলাই তার ভাই কলেজের উদ্দেশ্যে বের হলে জানতে পারে পরীক্ষা স্থগিত। তখন বন্ধুদের সাথে মিছিলের মাঝে জড়িয়ে পড়ে। এবং পুলিশের টিয়ারশেলে বন্ধুদের থেকে আলাদা হয়ে যায়। পরবর্তীতে আমরা ১৮ তারিখ আনুমানিক বিকেল ৪টায় ওর বন্ধুদের থেকে জানতে পারি, তার পায়ে রাবার বুলেট লেগেছে। সেখানকার লোকজন স্থানীয় কোনো হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে।
'রাত ১০টা পর্যন্ত সব হসপিটাল-ক্লিনিক খুঁজেও যখন পাচ্ছিলাম না– তখন বাবার কাছে একটা কল আসে। তারা জানায়, আপনার ছেলে আমাদের হেফাজতে আছে। জানাজানি করবেন না। তাতে ছেলের ক্ষতি হবে। তাকে আগামীকাল (১৮ জুলাই) সকালে ছেড়ে দেয়া হবে। চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু, পরের দিন ১৯ জুলাই সকালে আমরা খোঁজ নিলে তারা অস্বীকার করে বলে, তাদের কাছে এই নামে কেউ নেই। এরপর আনুমানিক বিকেল সাড়ে চারটায় কোর্ট থেকে কল আসে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।'
তিনি আরও লেখেন, "আমরা কোর্ট থেকে নথিপত্র নিয়ে জানলাম, তাকে (আলফি) আবু সাইদ ভাইয়ের হত্যা মামলা দেয়া হয়েছে। সেদিন থেকে বারবার কারাগারের দরজা থেকে ফিরে এসেছি। একটাবার দেখা তো দূর; তার কণ্ঠও শুনতে দেয়নি কেউ। মেট্রোপলিটন কোর্ট তার মামলা কিছুতেই শিশু আদালতে (জুভেনাইল কোর্ট) দিতে চায়নি। অনেক চেষ্টা করে গত ৩০ জুলাই শিশু কোর্টে নেয়া হলে– ডেট দেয় আগামী ৪ আগস্ট। ৪ তারিখ কি রায় দিবে আমার জানা নেই। তবে আমি আমার ভাইকে ফিরে চাই। বেকসুর খালাস দেওয়া হোক এটা চাই।"
সানজানা আক্তার বলেছেন, 'যে ছেলেটা লিগ্যাল ডকুমেন্টস অনুযায়ী শিশু; তাকে তারা কোন হিসেবে এভাবে হ্যারাস (হয়রানি) করাচ্ছে? সব থেকে বড় কথা তার গায়ে কলেজ ড্রেস ছিল। আইডি ছিল। সে পুলিশদের ইনস্টিটিউটেরই ছাত্র। এক্ষেত্রে কি তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, সহপাঠী, আইনজীবী কারো কিছুই করার নেই? আমার ভাইকে কোন লজিকে তারা আটকে রেখেছে, দেখাও করতে দিচ্ছে না!'
আলফিকে যে মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে- তার তদন্তকারী কর্মকর্তা রংপুরের তাজহাট থানার এসআই জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, 'ওইদিন (১৭ জুলাই) আমাদের তাজহাট থানায় যখন আগুন দেয়, তখন সে পিকেটিং করছিল। ওই সময় ঘটনাস্থলে পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, বিজিবির টিম ছিল। ওই সময় সে (আলফি) বিজিবির হাতে ধরা পড়ে।'
জিল্লুর রহমান আরও বলেন, 'ঘটনার দিন তো পুরো রংপুর উত্তপ্ত। পরে আলফি আমাদের হেফাজতে ছিল। পরদিন সকালে তাকে এই মামলায় আদালতে চালান দেওয়া হয়। কিন্তু পরের দিনেও উত্তপ্ত ছিল রংপুর। এ কারণে ওই সময় তার বয়স যাচাই করা সম্ভব হয়নি। মানে তার সম্পর্কে এত যাচাই করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু, আইন অনুযায়ী তো তাকে ২৪ ঘণ্টার বেশি আমরা রাখতেও পারি না। এই কারণে তাড়াহুড়ো করে তাকে চালান দেওয়া হয়'।