টিকটকের কথা ভুলে যান, চীনের আসল শক্তি উইচ্যাট
২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর জোয়ান লি বুঝতে পারেন, অন্যান্য চীনা অভিবাসীর সঙ্গে তিনি যে অ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখেন, তা তাকে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে।
চীনা অ্যাপ উইচ্যাটে তিনি যেসব তথ্য পান, তা বলছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন প্রশংসনীয় নেতা ও ব্যবসায়ী। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন এটি একদমই প্রশ্নের উর্ধ্বে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত।
'তবে আমি যখন চীন ছাড়া অন্যান্য দেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলা শুরু করি, পুরো বিভ্রান্ত হয়ে যাই।'
মিস লি তখন কানাডার টরেন্টোতে বাস করতেন। তিনি তখন এ ব্যাপারে আরও পড়াশোনা শুরু করেন। তিনি খেয়াল করেন, উইচ্যাট অসংখ্য গুজব, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভরপুর। একটি আর্টিকেলে বলা হয়, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো হার্ড ড্রাগ অনুমোদন দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। কিছু সংবাদে বলা হয়, কানাডা মুদি দোকানে গাঁজা বিক্রি শুরু করেছে। এর সবই মিথ্যা।
চীন সম্পর্কিত সংবাদ নিয়েও প্রশ্ন জাগে তার মনে। ২০১৮ সালে কানাডায় হুয়াওয়ের একজন কার্যনির্বাহী গ্রেপ্তার হন, বিদেশি সংবাদ মাধ্যমগুলোর এ সম্পর্কিত সব সংবাদ সেন্সর করে দেওয়া হয় উইচ্যাটে। তার সব চীনা বন্ধুরা এ বিষয়ের আলোচনায় বলা শুরু করেন, কানাডায় কোনো ন্যায়বিচার নেই। যেসব বক্তব্য তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একদমই ভিন্ন ছিল।
'হঠাৎ করেই আমি আবিষ্কার করলাম, এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনায় কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। বুঝতে পারি, আমি শুধু চীনা গণমাধ্যমের খবর দেখলে, আমার চিন্তাও আলাদা হতো।'
যোগাযোগের জন্য উইচ্যাট অপরিহার্য হওয়ায় তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নিজে সতর্ক থেকেই এটি ব্যবহার করতে হবে। চীনের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই উইচ্যাট একটি 'একের মধ্যে সব' ধরনের অ্যাপ।
সামাজিক নিয়ন্ত্রণের জন্য উইচ্যাট একটি শক্তিশালী অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমেই চীন সরকার মানুষ কী পড়বে, কী বলবে, কার সঙ্গে কথা বলবে- এসব নজরদারি করে। চীনের বাইরেও চীন সরকার তাদের কাজে অ্যাপটি ব্যবহার করছে।
সামরিক গবেষকরা গুপ্তচর হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করার সময়, উইচ্যাটের মাধ্যমেই চীনের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে।
যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে এই অ্যাপকে জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ ধরা হয়। চীনের ভিডিও অ্যপ টিকটকের পাশাপাশি উইচ্যাট ব্যান করার প্রস্তাব রেখেছে ট্রাম্প প্রশাসন।
ওই প্রশাসন অ্যাপ দুটিকে একই তালিকাভুক্ত করলেও, অ্যাপ দুটির কার্যপন্থা একদমই আলাদা। বৈশ্বিক অন্য অ্যাপের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যই টিকটক গড়ে তোলে বাইটড্যান্স প্রতিষ্ঠান। চীনের ভেতরে ও বাইরে আলাদা নেটওয়ার্ক ভিত্তিক অ্যাপ বানানো হয় বৈশ্বিক জনপ্রিয়তা পেতে।
অন্যদিকে, উইচ্যাটে চীন ও বহির্বিশ্বের জন্য আলাদা নিয়ম থাকলেও, একই নেটওয়ার্কের অধীন একক অ্যাপ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চীন ও চীনের বাইরে অ্যাপটির যে পার্থক্য ছিল, তা কমে আসে। চীনে অবস্থানকালীন অ্যাপটি ব্যবহার করার পর, কোনো নাগরিক দেশের বাইরে গেলেও তার অ্যাকাউন্ট নজরদারিতেই থাকে। ভিনদেশি কেউ চীনে গিয়ে অ্যাপটি ব্যবহার করলেও, তাদের পোস্ট সেন্সর করা হতে পারে।
উইচ্যাটের বেশিরভাগ গুজব ও সংবাদই চীন থেকে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে বেশিরভাগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পক্ষপাতদুষ্টতা এড়ানোর জন্য অসংখ্য ফিল্টার বাবল আছে, উইচ্যাট একটিমাত্র সুপার-ফিল্টার বাবল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের স্কুল অব জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশনের অধ্যাপক ফাঙ কেচেঙ বলেন, 'উইচ্যাটের ফিল্টার-বাবলের সঙ্গে অ্যালগরিদমের কোনো সম্পর্ক নেই; এটি সম্পূর্ণই চীনের নিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট ব্যবস্থা ও সেন্সরশিপের ফসল।'
২০১৮ সালে গণমাধ্যম ও স্বাক্ষরতা অনলাইন কোর্স নেওয়ার সময় তিনি ব্যাপারটি প্রথম খেয়াল করেন। তিনি খেয়াল করেন, চীনের বাইরে থাকা শিক্ষার্থীরা তখনো সংবাদ ও তথ্যের জন্য উইচ্যাটের ওপর নির্ভরশীল।
তিনি উইচ্যাটে নিউজল্যাব নামের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সাংবাদিকতা শেখাতেন, তথ্যের সত্যতা নিরূপণের ব্যাপারে শেখাতেন। তার শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কিন্তু এ বছরই তার নিউজল্যাব অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তবু তিনি মনে করেন, অ্যাপ নিষিদ্ধ করে দেওয়া এর কার্যকর সমাধান নয়। তথ্যের সত্যতার ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কিছু নিয়ম নির্ধারণ করে দেওয়াই তুলনামূলক কার্যকর সমাধান বলে জানান তিনি। কারণ, একটি অ্যাপ বন্ধ করলেও ব্যবহারকারীরা অন্য অ্যাপ ব্যবহার শুরু করবেন। গুজব, মিথ্যা তথ্য ছড়াবেন।
তিনি বলেন, 'তথ্যের সঙ্গে পানির মিল আছে, এর গুণাগুণ বৃদ্ধি করা যায়। তবে এর স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ বন্ধ করে দিলে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।'
চীন সরকার তাদের কাজে যেকোনো চ্যাট অ্যাপ ব্যবহার করতে পারলেও, উইচ্যাটের আলাদা কিছু সুবিধা আছে। চীনের ভেতরে বেশিরভাগ ব্যবহারকারীই আসল পরিচয়ে অ্যাপটি ব্যবহার করেন। পুলিশও অ্যাপটির নজরদারির ক্ষমতার সঙ্গে পরিচিত।
উইচ্যাট অ্যাপ চীনের জনসাধারণের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে কেনাকাটা, যানবাহন ব্যবহার, সুস্থতার ছাড়পত্র সব কাজেই অ্যাপটি ব্যবহার করতে হচ্ছে। তাই অনেকেই বিকল্প অ্যাপ ব্যবহার করতে চাইলেই সম্ভব হয়ে ওঠে না।
- সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস