জলবায়ু পরিবর্তনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে কৃত্রিম সারের ব্যবহার
গত মাসের চার তারিখে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে গুদামজাত রাসায়নিক সার অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের একটি বড় চালান বিস্ফোরিত হয়। ওই ঘটনায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় বৈরুত বন্দরসহ আশেপাশের এলাকা। ১০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত বাড়িঘর ও অন্যান্য স্থাপনাও ক্ষতির শিকার হয়। মুহূর্তেই গৃহহীন হয়ে পড়েন তিন লাখ মানুষ। সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল আনুমানিক ১৫শ' কোটি ডলার। প্রাণ হারান কমপক্ষে ১৯০ জন।
শুধু বৈরুতে নয়, এর আগেও অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট রাসায়নিক সারের উৎপাদন ও সংরক্ষণের চক্রে দুর্ঘটনা ঘটেছে অজস্রবার। উল্লেখযোগ্য হলো; ২০১৫ সালে চীনের তিয়ানজেনের বিস্ফোরণ, এতে প্রাণ হারান ১৭৩ জন। ২০১৩ সালে পশ্চিম টেক্সাসে প্রাণ হারান ১৫ জন। ফরাসের তুঁলো শহরে ২০০১ সালে নিহত হন ৩১ জন।
এতো গেল সাম্প্রতিক সময়ের কথা। দুর্ঘটনা সুদূর অতীতেও কম হয়নি। ১৯৪৭ সালে টেক্সাস সিটিতে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিলেন ৫৮১ জন।
বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোও একে ধবংসাত্মক কাজে ব্যবহার করে আসছে। ১৯৯৫ সালে মার্কিন সরকারবিরোধী এক সন্ত্রাসী টিমোথি ম্যাক-ভেইগ অ্যামনিয়াম নাইট্রেট সার থেকে প্রস্তুতকৃত বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ওকলাহোমা শহরে ১৬৮ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়।
কৃত্রিম বা রাসায়নিক উপায়ে প্রস্তুতকৃত সারের নিরাপত্তা ঝুঁকি উঠে আসে এসকল ঘটনায়। তবে বিজ্ঞানী ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, শুধু মানুষের সরাসরি প্রাণহানির জন্য নয়, বরং অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট এবং তার মতো রাসায়নিক গঠনের অন্যান্য সার, যেমন; অ্যামোনিয়াম সালফেট, সোডিয়াম নাইট্রেট এবং পটাশিয়াম নাইট্রেট জলবায়ু পরিবর্তনের চক্রে উল্লেখযোগ্য হারে নেতিবাচক প্রভাব যুক্ত করছে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন:
শুরুটা হয় উৎপাদন থেকেই। এসব সারের উৎপাদনে প্রয়োজন হয় বিপুল পরিমাণ শক্তির। আর এজন্য পোড়ানো হয় জীবাশ্ম জ্বালানি।
তাছাড়া, কৃষকেরা কৃত্রিম সার ফসলী জমিতে দেওয়ার পর, সেখান থেকে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় নাইট্রোস অক্সাইড (N2O) গ্যাস। এটি একটি গ্রিনহাউজ গ্যাস, যা বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা শোষণের জন্যও দায়ি।
আন্তর্জাতিক সার উৎপাদকদের জোট দাবি করে, শিল্পটি বিশ্বের মোট গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের মাত্র ২.৫% উৎপন্ন করে। তবে এটা মনে রাখতে হবে, সকল গ্রিনহাউজ সমান প্রভাব ফেলে না। মিথেন বা কার্বন ডাই-অক্সাইডের (CO2) মতো গ্রিনহাউজ গ্যাসের চাইতে অনেকবেশি পরিমাণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে ভূমিকা রাখে N2O। ভরের দিক থেকে এর আনবিক গঠনও CO2-র চাইতে ২৬৫ গুণ ভারি।
আরও দুঃসংবাদ হলো, '' নাইট্রোস অক্সাইডের নির্গমন সম্পর্কে আগে যা ধারণা করা হয়েছিল, দেখা যাচ্ছে বর্তমানে তার চাইতে অনেক বেশি এটি নিঃসরিত হচ্ছে' বলছিলেন নরওয়ের ইনস্টিটিউড অব এয়ার রিসার্চের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক রোনা থম্পসন।
পরিবেশবাদী গোষ্ঠীগুলো বছরের পর বছর ধরে কৃষকদের প্রতি রাসায়নিক সার ব্যবহার কমানোর অনুরোধ করে আসছে। অনেকেই তা শুনেছেন।
থম্পসন বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে রাসায়নিক ব্যবহার কিছুটা স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। অনেকক্ষেত্রে তা কমার লক্ষ্মণও দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া, নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ জৈব সার ব্যবহার করে অনেক চাষি ভালো ফলন লাভ করেছেন।'
বাজারের অন্যান্য পরিচালক শক্তিও এ হ্রাসের জন্য দায়ি। তবে এখনও, উন্নয়নশীল বিশ্ব এবং উদীয়মান অর্থনীতির দেশে কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় রাসায়নিক সার। এসব জায়গায় এখন উন্নতিটা আসা দরকার বলে, মনে করছেন এ বৈজ্ঞানিক।
বিশেষ করে, চীনে। সেখানে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট 'যত বেশি ব্যবহার করা যাবে- তত ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব' এমন একটা মনোভাব আছে। অধিকাংশ সময়েই চাষিরা ইচ্ছে করেই বেশি সার দেন, যাতে শস্যের চারা অধিক পরিমাণে তা টেনে নিতে পারে। বেশি সার দিলেই অধিক ফলন পাওয়া যায়- নির্ভরযোগ্য এমন কোনো তথ্য না থাকলেও, এই বিশ্বাস জলবায়ুর বৈরিতা সৃষ্টিতে নিঃসন্দেহে বড় ভূমিকা রাখছে।
বিকল্প কী:
বিকল্প হিসেবে জৈব সার যেমন; গোবর ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। এছাড়া, মূল শস্য রোপণের আগে সয়া'র মতো বাতাস থেকে নাইট্রোজেন টেনে নেওয়া ফসল লাগিয়ে তা হালচাষের মাধ্যমে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলার পদ্ধতির কথা বলা হচ্ছে। তবে সমস্যা হচ্ছে, এসব পদ্ধতিতে বিশ্ববাজার চাহিদা ও মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে ফসল উৎপাদন বেশ কঠিন।
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, রাসায়নিক সারের সস্তা বিকল্প না থাকলে পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যার ৪০ থেকে ৫০% অনাহারে মারা যেতো।
বিশ্বজুড়েই কৃষিখাতের অন্যতম প্রধান পরিচালনা ব্যয়- সারের পেছনে করা খরচ। মাটিতে প্রয়োগ করার জন্য পর্যাপ্ত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট জাতীয় সার কিনতে এর একটা বড় অংশ ব্যয় হয়। নেদারল্যান্ড-ভিত্তিক এগ্রোকেয়ার এই সমস্যা সমাধানে কাজ করছে।
তারা ফ্ল্যাশলাইটের সমান একটি ডিভাইস তৈরি করেছে, যা নানা স্থানের মাটির জটিল গঠন বিশ্লেষণ করে- তার নাইট্রোজেন চাহিদা নির্ণয় করতে পারে। এজন্য যন্ত্রটি একটি বড় তথ্যকোষ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় পরিচালিত মেশিন লার্নিং পদ্ধতির সাহায্য নেয়। কৃষকেরা এটিকে তাদের স্মার্টফোনের সঙ্গেও যুক্ত করতে পারেন।
ইউরোপের অন্যান্য দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রেও কৃষকেরা এধরনের কিছু ডিভাইস ব্যবহার করছেন। তবে প্রযুক্তিটি এতদিন শুধু উন্নত বিশ্বেই সীমাবদ্ধ ছিল। নেদারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠানটি এখন উন্নয়নশীল দেশের চাষিদের জন্য এটি কম খরচে উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে।
এগ্রোকেয়ারের প্রকল্প ফ্লোরেন্ট মৌরেন্টাস বলেন, আফ্রিকার অনেক দেশে চাষিরা মাটির পুষ্টি ভারসাম্য না জেনেই রাসায়নিক সার দেন। অথচ, ভালো ফলনের জন্য দরকার নাইট্রোজেন, ফসফেট এবং পটাশিয়ামের ভারসাম্য। আপনি যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত নাইট্রেট দেন তাহলে মাটির অন্য পুষ্টি উপাদান শুষে নিয়ে তা নিঃশেষ করে ফেলবে শস্যের শেকড়।
'তাই তাঞ্জেনিয়া বা কেনিয়ার কৃষকেরা সারের বস্তাপিছু ৬০ ডলারের বেশি খরচ করেও আশানুরুপ ফলন পাচ্ছেন না। অথচ এ পরিমাণ অর্থ তাদের জন্য অনেক বড় অংক। সেই তুলনায় মাত্র ১০ ডলার বিনিয়োগ করেই তারা এখন থেকে মাটির পুষ্টিমান যাচাইয়ের স্থায়ী উপকরণ পেয়ে যাবেন। এটা তাদের সারের পেছনে অতিরিক্ত ব্যয় অনেকাংশে হ্রাস করবে। ফলন বাড়িয়ে তাদের আর্থিকভাবে স্বচ্ছল করেও তুলবে।'
'সত্যিকার অর্থেই নতুন এ প্রযুক্তি জলবায়ু পরিবর্তন সৃষ্টিকারী অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের মতো রাসায়নিক সার ব্যবহার কমাতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে' তিনি যোগ করেন।
জীববিজ্ঞান সমাধান পাচ্ছে প্রাকৃতিক ব্যবস্থায়:
ব্যাপক গবেষণা যুক্তরাষ্ট্রেও চলছে। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে শুরু করে সেন্ট লুইস পর্যন্ত নানা মার্কিন জৈব-প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান রাসায়নিক সার প্রতিস্থাপনে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিকারী আণুবীক্ষণিক প্রাণ নিয়ে গবেষণা করছেন। অণুজীব বা ব্যাকটেরিয়ার মিশ্রণ; গম এবং ভুট্টার মতো অধিক পুষ্টিচাহিদার শস্যের খাদ্য যোগান দিতে সক্ষম হবে, বলে আশা প্রকাশ করছেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞান প্রকৃতির আদি-অবস্থাকেই আদর্শ বলে মনে করছে। অ্যামনিয়াম নাইট্রেটের ব্যবহার সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ার আগে, কৃষিজমির উর্বরতা সম্পূর্ণভাবে মাটির জৈবপ্রাণ নির্ধারণ করতো। নির্দিষ্ট মাত্রায় ফসলের শেকড়ে প্রাকৃতিক নাইট্রোজেন সরবরাহও করতো এসব অণুজীবের বিক্রিয়া। কিন্তু, এখন মাটিতে বিপুল পরিমাণ নাইট্রোজেন দেওয়ার ফলে, এসব অণুজীবের সক্ষমতা অনেক কমে গেছে। চারপাশের বিপুল উপস্থিতির কারণে, তারা নতুন করে নাইট্রোজেন উৎপাদনের উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
ডাল, মটর অথবা বুট জাতীয় শস্য এই চক্র ভাঙ্গার সমাধান দেখায় গবেষকদের। এসব শস্য রাসায়নিকের প্রভাব এড়িয়ে নিজ শেকড়ের মধ্যে মাটির অণুজীবকে আশ্রয় দেয় বা ঘিরে রাখে। ফলে অণুজীবের কাছে মনে হয়, সে নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ মাটিতে নেই। ফলে তারা প্রাকৃতিকভাবে নাইট্রোজেন নিঃসরণের চেষ্টা করে।
''মাটিতে রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে বিদ্যমান নাইট্রোজেনের পরিমাণ কমানোর কোনো বিকল্প নেই। তবে এতে কৃষক যাতে ক্ষতির শিকার না হন, সেটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। ধীরে ধীরে মাটিতে বিশেষ অণুজীবের সংখ্যা বাড়াতে চাই আমরা। এজন্য অণুজীবের দেহে নাইট্রোজেন শনাক্ত করার মাইক্রোব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চলছে। এতে সে কৃষকের জন্য প্রাকৃতিক উপায়ে নাইট্রোজেন সরবরাহের উৎস হয়ে উঠবে'' বলছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলি-ভিত্তিক জৈবপ্রযুক্তি সংস্থা পিভট বায়ো'র প্রধান নির্বাহী কার্সটেন টেম্মে।
'আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ধীরে ধীরে সারের ব্যবহার কমানো' তিনি যোগ করেন।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ