প্রায় অর্ধশতাব্দী পর খালাস পেলেন বিশ্বের দীর্ঘতম সময়ের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি
অবশেষে খালাস পেলেন বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘসময় ধরে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হয়ে থাকা ৮৮ বছর বয়সী ইওয়াও হাকামাদা। ১৯৬৮ সালে তার বস, বসের স্ত্রী ও তাদের দুই কিশোর সন্তানকে হত্যার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। কিন্তু মামলার রায়ের অর্ধশতাব্দী পর মামলার সাক্ষাগুলো বানোয়াট বলে প্রমাণিত হয়। খবর বিবিসি'র।
সম্প্রতি তার মামলাটি পুনর্বিচারের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কারণ সন্দেহ জেগেছিল, তদন্তকারীরা হয়ত সাক্ষ্য মিটিয়ে দিয়ে তাকে চারখুনের মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এ সন্দেহ থেকেই মামলাটি পুনরায় বিচারের আওতায় আনা হয়।
মৃত্যুদণ্ডের রায় নিয়ে জেলখানায় ৪৬ বছর কাটানো হাকামাদার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব পড়েছে। তিনি শারীরিকভাবেও সুস্থ ছিলেন না। যার কারণে তার বেকসুর খালাসের রায়ের দিন তিনি আদালতে উপস্থিত হতে পারেননি।
হাকামাদার মামলাটি জাপানের অন্যতম দীর্ঘ এবং বিখ্যাত আইনি কাহিনি হওয়ায় জনসাধারণের এর প্রতি ব্যাপক আগ্রহ ছিল। যার কারণে রায়ের দিন আদালতে ৫০০ জন আসন পাওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছিল। আর যখন রায় ঘোষণা করা হয় তখন আদালতের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা হাকমাদার সমর্থকরা 'বানজাই' বলে উল্লাস করেন। বানজাই একটি জাপানি উচ্ছ্বাসসূচক শব্দ, যার অর্থ 'হুররে'।
২০১৪ সালে মানসিক অবস্থার অবনতির কারণে হাকামাদাকে সব ধরনের শুনানি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। সেসময় থেকে জেলাখানা থেকে মুক্তি পেয়ে পুনর্বিচারের সময় তার ৯১ বছর বয়সী বোন হিদেকোর সঙ্গেই থাকতেন হাকামাদা।
বোন হিদেকো কয়েক দশক ধরে তার ভাইয়ের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছিলেন। অবশেষে তিনি আদালত থেকে 'নির্দোষ' শব্দটি শুনতে পেলেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, "যখন আমি শব্দটি শুনলাম, তখন এতোটাই আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম যে নিজের কান্না থামাতে পারছিলাম না।"
তিনি আরও বলেন, "তার ভাই তাকে আগে বলে ছিলেন যে তার লড়াই ছিল 'প্রতিদিনের যুদ্ধের মতো'।" ২০১৮ সালে তিনি সংবাদ সংস্থা এএফপিকে বলেছিলেন, "একবার আপনি ভাবেন যে আপনি জিততে পারবেন না, তখন আসলে বিজয়ের আর কোনো পথ থাকে না।"
মিসোর ট্যাংকে ছিল 'রক্তমাখা' কাপড়
হাকামাদা ছিলেন একজন প্রাক্তন পেশাদার বক্সার। ১৯৬৬ সালে টোকিওর পশ্চিমে শিজুওকায় একটি মিসো প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখায় কাজ করছিলেন তিনি। সেসময়ই তার নিয়োগকর্তা, সেই ব্যক্তির স্ত্রী এবং দুই সন্তানের মরদেহ তাদের বাড়িতে আগুনের মধ্য থেকে উদ্ধার করা হয়। তাদের সবাইকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছিল।
কারখানা কর্তৃপক্ষ সেসময় ওই চারজনকে হত্যা, তাদের বাড়িতে আগুন দেওয়া ও দুই লাখ ইয়েন চুরির অভিযোগ আনে হাকামাদার বিরুদ্ধে।
হাকামাদা প্রথমে এ ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন। কিন্তু পরে তার কাছ থেকে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়। হাকামাদা অভিযোগ করেছিলেন, মারধর এবং ১২ ঘণ্টা যাবত জিজ্ঞাসাবাদের কারণে তিনি ওই স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন।
১৯৬৮ সালে তাকে হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ড দেওয়ায় হয়। সেসময় হাকামাদা গ্রেপ্তারের এক বছর পর মিসোর একটি ট্যাংক থেকে রক্তমাখা কাপড় উদ্ধার করা হয়েছিল আর সেগুলো ব্যবহার করে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল।
তবে বছরের পর বছর হাকামাদার আইনজীবীরা দাবি করে আসিছিলেন, সেই কাপড়ের ডিএনএ'র সঙ্গে তার ডিএনএ মিলেনি। তারা আরও বলেন, "পুলিশ প্রমাণ জাল করেছে, এ ডিএনএ অন্য কারও হতে পারে।"
আইনজীবীদের তাদের যুক্তি বিচারক হিরোআকি মুরায়ামাকে প্রভাবিত করতে যথেষ্ট ছিল। তিনি ২০১৪ সালে মন্তব্য করেছিলেন, "কাপড়গুলো আসামির ছিল না।"
মুরায়ামা তখন বলেন, "আসামিকে আটক রাখা অন্যায়, কারণ তার নির্দোষ হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।"
এরপর হাকামাদাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং তাকে পুনর্বিচারের অনুমতি দেওয়া হয়।
দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার কারণে তার পুনর্বিচার শুরু হতে গত বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায় এবং আজ বৃহস্পতিবার সকালে আদালত তার রায় ঘোষণা হয়।
তার পুনর্বিচার এবং চূড়ান্ত খালাসের মূল বিষয় ছিল সেই লাল দাগের চিহ্ন যা প্রসিকিউশন দাবি করেছিল তার কাপড়ে ছিল। প্রতিরক্ষা পক্ষ প্রশ্ন তুলেছিল যে কীভাবে এই দাগগুলো সময়ের সাথে বিবর্ণ না হয়ে লালই রয়ে গেছে। তারা বলেছিল যে দাগগুলো দীর্ঘ সময় ধরে সয়াবিন পেস্টে ডুবে থাকার পরও লাল থাকার অর্থ, প্রমাণগুলো বানোয়াট।
বৃহস্পতিবারের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, "তদন্তকারীরা রক্ত মাখিয়ে কাপড়গুলোকে প্রভাবিত করেছিল এবং সেগুলো মিসোর ট্যাংকে লুকিয়ে রেখেছিল।"
হাকামাদার আইনজীবী এবং পরিবার জানিয়েছে যে দশকের পর দশক ধরে আটক থাকায় একাকীত্বের কারণে হাকামাদা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।
তার বোন দীর্ঘদিন ধরে তার মুক্তির পক্ষে কথা বলেছেন। গত বছর যখন পুনর্বিচার শুরু হয় হিদেকো স্বস্তি প্রকাশ করে বলেছিলেন, "অবশেষে আমার কাঁধ থেকে একটি ভার নেমে গেছে।"
জাপানে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের পুনর্বিচার অত্যন্ত বিরল। হাকামাদার পুনর্বিচার ছিল জাপানে যুদ্ধ-পরবর্তী ইতিহাসে পঞ্চমবার।
জি৭ ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানেই মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের তাদের ফাঁসির বিষয়ে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে অবহিত করা হয়।