আইন প্রণয়নের ১৫ বছরেও কেন কমেনি তথ্য পাওয়ার ‘বিড়ম্বনা’?
নাগরিকের তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে ২০০৯ সালে আইন প্রণয়ন করে বাংলাদেশ। তবে আইন প্রণয়নের ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও দেশে নাগরিকের তথ্যের অধিকার এখন পর্যন্ত রয়ে গেছে শুধু কাগজে-কলমেই; বাস্তবায়নের পরিধি খুবই সামান্য।
"প্রথমে তথ্যের আবেদন, পরে বিভাগীয় আপিল এবং শেষে তথ্য কমিশনে ২ বারের প্রচেষ্টা। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ, এরপর হাইকোর্ট। তারপরেও মেলেনি কাঙ্খিত তথ্য। চেষ্টা থামেনি, আবারও যাবো কোর্টে," তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ এর আওতায় তথ্য চেয়ে আজকের পত্রিকার সাভার-মানিকগঞ্জ স্টাফ করেসপন্ডেন্ট অরুপ রায় এভাবেই বর্ণনা করছিলেন নিজের বিড়ম্বনা।
১৯৮০ সাল থেকে সাভার-মানিকগঞ্জ এলাকায় সাংবাদিকতা করেন অরুপ রায়। কাজ করেছেন দেশের প্রথম সারির কয়েকটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায়। এ পর্যন্ত তথ্যের জন্য আবেদন করেছেন ৫৬০টি।
অরুপ রায় বলেন, "২০২৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সাভার সার্কেল কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট অফিসে মিষ্টির কারখানা, ডিলার এবং হোটেল ও রেস্টুরেন্টের ভ্যাট সম্পর্কিত তথ্য চেয়ে আবেদন করি। ২০ কর্মদিবসের মধ্যে তথ্য না পেয়ে ভ্যাট অফিসে বিভাগীয় আপিল করি। সেখানেও ব্যর্থ হলে সে বছরের ১৬ এপ্রিল তথ্য কমিশনে যাই। তথ্য কমিশন চাহিদাকৃত সব তথ্য দিতে বললেও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গড়িমসি করেন। পরে, আবারো তথ্য কমিশনে অভিযোগ দেই। সেখানে ভার্চুয়াল শুনানিতে আবারো তথ্য দিতে বলা হয়, কিন্তু এবারও তথ্য দেওয়া হয়নি।"
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, "কমিশনের মাধ্যমে ২ বার ব্যর্থ হলে নিরুপায় হয়ে এ বছরের ২০ জুন হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করি। রিট আদেশে তথ্য দিতে বলা হলে আবারও ১৪ জুলাই তথ্যের জন্য আবেদন করি। কিন্তু এবারও হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে আমাকে তথ্য দেওয়া হয়নি। আমি আবারো চেষ্টা করবো এবং কোর্টে যাবো তথ্যের অধিকার আদায়ের জন্য।"
বর্তমানে দৈনিক আজকের পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত অরুপ রায় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তথ্য চেয়ে ৫৬০টি আবেদন করি। এরমধ্যে ১০ শতাংশ তথ্য স্বাভাবিক উপায়ে পেয়েছি। ২ শতাংশ তথ্য পেয়েছি ঊর্ধ্বতন কর্তপক্ষের কাছে আপিল করে। এছাড়া, তথ্য কমিশনে অভিযোগ দিয়ে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ তথ্য পাই। এসব প্রক্রিয়ায় আমার ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।"
অরুপ রায় বলেন, "তথ্য কমিশনে অভিযোগ করে মনে হয় আমি যেন অপরাধ করেছি। তারা বেশিরভাগ সময় প্রশাসনের কর্মকাণ্ডকে প্রটেক্ট করার এবং আইনকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করে।"
জানা যায়, তথ্য অধিকার আইন–২০০৯ এর আওতায় ৯০ দিনের মধ্যে (১ জুলাই, ২০০৯) স্বাধীন সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়।
কমিশনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, তথ্য কমিশন যেকোনো নাগরিকের নিকট থেকে তথ্য না পাওয়া সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণ করে থাকে। এর মূল কাজ হলো, সকল সরকারি ও বেসরকারি বা বিদেশি সাহায্যপুষ্ট সকল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্যাদি পেতে জনগণকে সহায়তা করা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে তথ্য প্রদানে উৎসাহিত ও বাধ্য করা।
একইসঙ্গে, তথ্য না পাওয়া সংক্রান্ত অভিযোগ নিষ্পত্তি এবং কেউ মিথ্যা বা বিভ্রান্তিমূলক তথ্য সরবরাহ করে থাকলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এই কমিশনের কাজ।
তবে তথ্য গ্রহীতাদের অভিযোগ, কমিশন বিগত ১৫ বছরেও স্বাধীনভাবে যথাযথ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে সক্ষম হয়নি।
কমিশনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে হবে
এ প্রসঙ্গে এমআরডিআই–এর নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান বলেন, আবেদনের পর তথ্যের প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা আছে। গুরুত্বপূর্ণ ও বড় তথ্য সেভাবে কখনো পাওয়া যায়নি।
"এসব আবেদনে এক ধরনের ভয় কাজ করতো। এছাড়া, কমিশনের রায়ও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়িত হয় না। আইনের ধারা ৭ এর একটা সীমাবদ্ধতা আছে। প্রদানকারীরা এটার ব্যবহার খারাপভাবে করেছে," যোগ করেন তিনি।
হাসিবুর রহমান বলেন, "আইনের ৬ ধারায় স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশের কথা বলা হয়েছে। সেটি হলে জনগণের সুবিধা হয়। সরকারি ৪০ হাজার ওয়েবে সেটি প্রকাশ হলে, তথ্যের জন্য বিড়ম্বনা পোহাতে হতো না। এছাড়া, কমিশন হওয়া উচিত রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত।"
তিনি আরও বলেন, "কমিশনে সর্বোচ্চ একজন আমলা থাকতে পারেন। কমিশনার নিয়োগে সাম্যতা থাকা দরকার। যে প্রক্রিয়াতে কমিশনের সদস্য নিয়োগ দেওয়া হতো, সেটি সঠিকভাবে অনুসরণ হয়নি। নতুন কমিশন গঠনে যেনো সেটি ঠিকঠাক অনুসরণ করা হয়। কমিশনকে স্বাধীন করে, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে।"
"কমিশনের রায় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪০ শতাংশ সাংবাদিক তথ্যের জন্য আবেদন করেন। ১৫ বছরেও এই আইন সম্পর্কে ও এর ব্যবহার সম্পর্কে গণপরিসরে তেমন সচেতনতা গড়ে উঠেনি। আইনটি প্রচারের ক্ষেত্রে যাদের ভূমিকা রাখার কথা ছিল, তাদের ব্যর্থতার কারণেই মানুষ এ সম্পর্কে কম জানে," যোগ করেন হাসিবুর রহমান।
তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে টিআইবির ১৩ দফা
শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) তাদের ওয়েবসাইটে- তথ্য পাওয়ার সর্বজনীন অধিকার, তথ্যের অ্যাক্সেসিবিলিটি (প্রবেশযোগ্যতা) এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ১৩ দফা সুপারিশ জানিয়েছে।
সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে— তথ্য অধিকার আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা, সকল আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক বাধা বিলুপ্ত করা, তথ্য কমিশনের ব্যাপক সংস্কার এবং তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আইন সংশোধন ও বাতিল করা ইত্যাদি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, তরুণদের অসামান্য আত্মত্যাগ এবং স্বৈরাচারী শাসনের পতনের কারণে একটি নতুন বাংলাদেশ পুনর্গঠনের আশাবাদ আবারও জেগে উঠেছে।
তিনি বলেন, "বাকস্বাধীনতা, ভিন্নমতের অধিকার এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহ এই লক্ষ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের জন্য তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।"
বাংলাদেশের এই নতুন যুগে বাকস্বাধীনতা ও তথ্যের অধিকারকে অপরিহার্য হিসেবে অগ্রাধিকার দিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানান টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।