তাকে বলা হয় ‘ভারতের ভেনাস’, ফিরিয়েছিলেন হলিউডের সিনেমা, শুটিংয়ে রক্তবমি হতো…
মাত্র ৩৬ বছরের জীবন। কিন্তু এই সময়েই নিজের কাজ আর ব্যক্তিজীবনের আকর্ষণীয় সব গল্পে নিজেকে অসামান্য করে রেখে গেছেন এই ক্ষণজন্মা শিল্পী। তাকে বলা হয় ভারতের ভেনাস—অর্থাৎ প্রেমের দেবী। তাকে বলা হয় ভারতের মেরিলিন মনরো নামেও।
১৯৫০-এর দশকের খ্যাতিমান এই অভিনেত্রী ভারতের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত তারকাদের একজন ছিলেন। অভিনয় করেছেন ৭০টিরও বেশি চলচ্চিত্রে।
তারকা দিলীপ কুমারের সঙ্গে মধুবালার সম্পর্কের কাহিনি সিনেমার গল্পের চেয়ে কম বৈচিত্র্যময় নয়। আজও তিনি বলিউডের জনপ্রিয় আইকন।
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মারা যান তিনি। কিন্তু পঞ্চান্ন বছর পর আজও তিনি সিনেমাপ্রেমীদের কাছে জনপ্রিয়, রহস্যে মোড়ানো চরিত্র।
মধুবালার মৃত্যুর কয়েক দশক পর এক প্রতিবেদনে নিউইয়র্ক টাইমস তাকে ভারতের মেরিলিন মনরো বলে উল্লেখ করে। মেরিলিন মনরোর মতোই মধুবালা ছিলেন শাশ্বত সুন্দরী। আর দুজনেই বরণ করেছেন মর্মান্তিক পরিণতি।
স্ক্রিন টেস্টে 'একঘেয়ে' বলে বাতিল
মধুবালার সিনেমায় স্বপ্নের মতো একধরনের জাদু কিছু ছিল, যে জাদু অনুভব করা যায় সাদাকালো সিনেমাতেও। তার সাফল্যের শুরুটা কিদার শর্মার নীল কমল (১৯৪৭) দিয়ে। তারপর 'মহল' (১৯৪৯) তাকে তারকাখ্যাতি এনে দেয়।
'মহল' মুক্তির পর তার সৌন্দর্যে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েন দর্শক থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র সাংবাদিকরাও।
তবে 'মহল'-এর প্রথম স্ক্রিন টেস্টের পর মধুবালাকে 'একঘেয়ে' বলে বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। পরিচালক কমল আমরোহি মধুবালাকে নেওয়ার জন্য জেদ না ধরলে হয়তো সিনেমাজগত এক অসাধারণ শিল্পীকেই হারাত। বোম্বে টকিজের সিনিয়ররা 'মহল'-এ নায়ক অশোক কুমারের বিপরীতে প্রধান চরিত্রে সুরাইয়াকে চেয়েছিলেন। মধুবালার স্ক্রিন টেস্ট 'ভেস্তে' দেওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন তারা।
আমরোহির ছেলে তাজদার এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ছবির চিত্রগ্রাহক জোসেফ উইর্শিং ইচ্ছা করেই খারাপ আলোতে মধুবালার শুট করেছিলেন, যাতে স্ক্রিন টেস্ট বাজে আসে। কিন্তু আমরোহি প্রযোজকদের জোরাজুরি করে ফের স্ক্রিন টেস্ট করান। এবার তারা মধুবালার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। 'মহল '-এর সাফল্য সব সমালোচকের মুখে কুলুপ এঁটে দেয়।
মধুবালা: বাধ্য হয়ে অভিনেত্রী
মধুবালার জন্ম ১৯৩৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, দিল্লিতে। পারিবারিক নাম মমতাজ জাহান বেগম দেহলভী।
তবে মধুবালা অভিনয় জগতে পা রাখেন নিজের ইচ্ছায় নয়, বরং পরিস্থিতির কারণে। বেগম আয়েশা ও আতাউল্লাহ খানের ঘরে জন্ম নেওয়া মমতাজ জাহান বেগম দেহলভী ওরফে মধুবালার কাঁধে অল্প বয়সেই পরিবারের দায়িত্ব চাপে।
বাবা তামাক কোম্পানির চাকরি হারানোর পর মাত্র আট বছর বয়সে পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয় মমতাজকে। বোম্বে টকিজ মমতাজকে শিশুশিল্পী হিসেবে 'বসন্ত' (১৯৪২) সিনেমায় ১৫০ রুপি পারিশ্রমিকে তাকে নেয়। তার অভিনয় বোম্বে টকিজের দেবিকা রানির মন জিতে নেয়।
মমতাজ শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ করে যান। মাত্র ১৪ বছর বয়সে কিদার শর্মা তাকে নীল কমল (১৯৪৭) ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ দেন। এরপরই তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়।
১৯৪৮ সাল নাগাদ দেবিকা রানি তার নতুন নাম দেন মধুবালা। পরিবারের আর্থিক চাহিদা মেটাতে তিনি ক্যারিয়ারের প্রথম চার বছরে প্রায় ২৪টি ছবিতে অভিনয় করেন। যদিও সাফল্যের দেখা তখনও পাননি। তবে ওই সময় কয়েকটি সিনেমা ব্যর্থ হলেই অভিনেতাদের বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া হতো না।
আরও কিছু ভালো সিনেমা এবং অভিনয়দক্ষতার জোরে ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে মধুবালা সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছান। মধুবালা অনায়াসে বিভিন্ন চরিত্রে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারতেন। হোক সেটা 'মি. অ্যান্ড মিসেস ৫৫'-এ (১৯৫৫) এক ধনী উত্তরাধিকারীর চরিত্র, 'কালা পানি'-তে (১৯৫৮) সাংবাদিকের চরিত্র, কিংবা 'চলতি কা নাম গাড়ি'-তে (১৯৫৮) প্রথাবিরোধী নারীর চরিত্র।
'কাজপাগল' মধুবালা
দিলীপ কুমার মনে করতেন, মধুবালা 'দরকারের চেয়ে বেশি ছবি করেন'। মধুবালা নিজেও বলতেন, পরিবারকে সময় দিতে পারেন না কাজের চাপে।
এক সাক্ষাৎকারে মধুবালা বলেছিলেন, 'সময় আমাকে নিজের সাথেই দেখা করার সময় দেয় না।'
কাজেই পরম আনন্দ খুঁজে পেতেন মধুবালার। দিলীপ কুমারের ভাষ্যে, 'ও ছিল কাজপাগল।'
২২ বছরের শোবিজ জীবনে মধুবালা প্রায় ৭০টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। ১৯৫৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, কাজের চাপে বিয়ে করার সময় পাচ্ছেন না।
লোকশ্রুতি আছে, মধুবালা ছবিপ্রতি মাত্র ৭ হাজার রুপি পারিশ্রমিক নিতেন। এজন তিনি বেশি ছবি পেতেন। অন্যদিকে আরেক তারকা সুরাইয়া পারিশ্রমিক নিতেন তারচেয়ে ছয়গুণেরও বেশি—৪৫ হাজার রুপি।
মধুবালা ছিলেন সুশৃঙ্খল মানুষ। সকাল ৬টায় কাজে হাজির হয়ে যেতেন, সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে কাজ সেরে ফেলতেন।
১৯৪০-এর দশকের শেষের দিকে তিনি বৃষ্টির মধ্যেও লোকাল ট্রেনে চেপে কাজে গিয়েছিলেন। তার এই নিবেদন ও সময়ানুবর্তিতা দেখে পরিচালক কিদার শর্মা হতবাক হয়ে পড়েন। দেব আনন্দ একবার বলেছিলেন, 'মধুবালা সেটে থাকলে প্রায়ই শিডিউলের আগেই কাজ শেষ হয়ে যেত।'
প্রযোজক-পরিচালক শক্তি সামন্ত ও রাজ খোসলা মধুবালা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 'তিনি কখনও কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন না। খুব নরম আর স্নেহপরায়ণ মানুষ ছিলেন।'
হলিউডের সিনেমা প্রত্যাখ্যান; কড়া নিয়ন্ত্রণের জীবন
মধুবালা কোন ছবিতে কাজ করবেন, কার সঙ্গে দেখা করবেন, সেটে কী খাবেন, কখন বাড়ি ফিরবেন—সবই নিয়ন্ত্রণ করতেন তার বাবা।
তারকাখ্যাতি তুঙ্গে ওঠার পর আমেরিকান ম্যাগাজিন 'থিয়েটার আর্টস'-এ তাকে নিয়ে ফিচার ছাপা হয়।
তিনবারের একাডেমি অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী মার্কিন পরিচালক ফ্র্যাঙ্ক কাপরা মধুবালার সঙ্গে দেখা করতে এবং তাকে ছবিতে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তাতেও বাদ সাধেন অভিনেত্রীর বাবা।
মুম্বাই সফরের সময় ফ্র্যাঙ্ক কাপরা মধুবালার সাথে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাকে হলিউডের একটি ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাবও দেন। কিন্তু অভিনেত্রীর বাবা এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।
অভিনেত্রী নিম্মি একবার বলেছিলেন, মধুবালা স্টুডিও ছাড়া কোথাও যেতেন না। কেউ তার সেটে যেতে পারতেন না—না কোনো অতিথি, না কোনো সাংবাদিক। মধুবালা কারও বাড়িতে যেতেন না, অন্য কেউও বাড়িতেও যেতেন না। চলচ্চিত্রের কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন না।
মধুবালা নিজেও অবশ্য ফিল্ম স্টুডিও থেকে বেরিয়ে নিজের ওপর থেকে তারকার অদৃশ্য চাদর ফেলে দিতে চাইতেন। একবার তিনি বলেছিলেন, 'স্টুডিওর কাজ শেষ করার পর আর আমি তারকা মধুবালা থাকতে চাই না।'
তবে ফিল্ম পার্টি ও ছবির প্রিমিয়ার না গেলেও সহ-অভিনেতা ও তার সঙ্গে কাজ করা অন্যরা বরাবরই বসময় এ তারকার প্রশংসা করেছেন।
'মোগল-ই-আজম ও তার পরের জীবন
মধুবালার জন্ম হয়েছিল একটি ভেন্ট্রিক্যুলার সেপটাল ডিফেক্ট নিয়ে—অর্থাৎ তার হার্টে ছিদ্র ছিল। চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করার পর এটি ধরা পড়ে। সেই সময় এর কোনো চিকিৎসা ছিল না।
শুটিং চলাকালে মধুবালা প্রায়ই দুর্বল হয়ে মেঝেতে পড়ে যেতেন। নৃত্য পরিচালক সিতারা দেবী একবার বলেছিলেন, নাচের দৃশ্যের শুটিং চলাকালে মধুবালাকে পাঁচ বা দশ মিনিট পরপর বিরতি নিতে হতো।
তবে 'বহুত দিন হুয়ে' (১৯৫৪) ছবির শুটিংয়ের সময় কাশির সঙ্গে রক্ত আসার পর তার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ বেড়ে যায়।
১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি নাগাদ শারীরিক যন্ত্রণা সামলে কাজ করে যেতে পেরেছেন মধুবালা। কারণ এ সময় দিলীপ কুমারের সঙ্গে তার গভীর প্রণয় চলছিল। কিন্তু এ প্রেমই তাকে ভীষণ যন্ত্রণা দেয়।
মধুবালা ও দিলীপ কুমারের প্রণয়ের শুরু 'তরানা'-র (১৯৫১) সেটে। বন্ধুদের বাড়িতে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে দেখা করতেন তারা। দিলীপ কুমারই 'মোগল-ই-আজম'-এ মধুবালাকে নেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু মধুবালার বাবা তাকে কড়া নিয়ন্ত্রণ রাখতেন। বাবার বিরুদ্ধে কখনও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেননি তিনি।
দিলীপ কুমার তার জীবনীতে লিখেছেন, মধুবালার বাবা আতাউল্লাহ খান তাদের প্রেমের ছিলেন না। বরং তাদের বিয়ে নিয়ে ফায়দা লুটতে চেয়েছেন। এ ব্যাপারটা দিলীপ কুমার ভালোভাবে নেননি।
পরে দুই তারকার ব্যক্তিত্বের রেষারেষিতে আকস্মিক ভেঙে যায় এ সম্পর্ক। প্রবল ভালোবাসা থাকার পরও দুজনের ৯ বছরের প্রেমের ইতি ঘটে।
হঠাৎই এলোমেলো হয়ে যায় মধুবালার জীবন। তার চলচ্চিত্রগুলো ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হতে থাকে। এক বিতর্কিত মামলার পর তাকে বি আর চোপড়ার 'নয়া দৌড়' সিনেমা থেকেও বাদ দেওয়া হয়।
শাম্মী কাপুর মনে করতেন, মধুবালার 'সবচেয়ে বড় দুর্বলতা' পরিবারের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে না পারা। তার মতে, মধুবালা জানতেন কখন সম্পর্কের রাশ আলগা করতে হবে। মধুবালা তার পরিবারকে ছেড়ে দিলীপ কুমারের কাছে যেতে পারেননি।
মর্মান্তিক মৃত্যু
খারাপ সময়কে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মধুবালা ১৯৬০ সালে গায়ক কিশোর কুমারকে বিয়ে করেন। যদিও এ সম্পর্কে প্রেম বলতে কিছু ছিল না।
রেডিফ ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মধুবালার বোন মধুর বলেন, 'মধুবালা জেদ আর দিলীপ সাহেবের ওপর রাগের কারণে কিশোর কুমারকে বিয়ে করেছিলেন।'
এছাড়া কিশোর কুমার সারাক্ষণ শো ও সিনেমার জন্য ভ্রমণে ব্যস্ত থাকায় মধুবালাকে সময় দিতে পারতেন না।
'ও (মধুবালা) একা একা অনেক কেঁদেছে,' আরেক সাক্ষাৎকারে বলেন মধুর।
ওই বছরই মধুবালার জীবনের শ্রেষ্ঠ সিনেমা 'মোগল-ই-আজম' মুক্তি পায়। মুক্তির পরপরই ছবিটি ক্লাসিকের মর্যাদা পায়।
কিন্তু এ সাফল্য মধুবালা উপভোগ করতে পারেননি, কারণ তার স্বাস্থ্য তখন দ্রুত খারাপ হচ্ছে। লন্ডনের ডাক্তাররা বলে দিয়েছিলেন, তার হাতে মাত্র কয়েক বছর সময় আছে।
১৯৬০ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত শয্যাশায়ী হয়েই দিন কেটেছে মধুবালার।
দিলীপ কুমার জানান, শেষদিকে মধুবালা তাকে ব্যক্তিগত বিষয়ে পরামর্শ চাইতে ডেকেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে দিলীপ কুমার বলেন, 'ও মরতে চায়নি…আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, "আমি যদি সুস্থ হয়ে যাই, তাহলে আমার সাথে আরেকটা ছবি করবে?" খুব কষ্ট পেয়েছিলাম ওর জন্য।'
মধুরও জানান, শেষ দিনগুলোতে মধুবালা প্রার্থনা করতেন, তিনি বাঁচতে চান।
কিন্তু 'সৌন্দর্যের রানি'কে শেষতক অসুস্থতার কাছে হার মানতে হয়। ৩৬তম জন্মদিনের নয় দিন পর ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।