নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে দায় এড়িয়ে ‘নিরাপদে চলছে’ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ!
সরবরাহ চেইনের ধাপগুলো নিরাপদ করার উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতির মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ শুরু করলেও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) দায়িত্ব পালনে অবহেলা করছে। এর ফলে, ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর ভোক্তাদের মধ্যে ভেজালমুক্ত খাদ্য পাওয়ার যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে।
বিএফএসএ গত ২৩ সেপ্টেম্বর দুটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, লালশাক, বেগুন, পটল, ঢেড়স, শিম, বাঁধাকপিসহ ৯ ধরনের সবজিতে ক্ষতিকর মাত্রায় ভারী ধাতু এবং লিচুসহ ৪টি ফলে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে। নিয়মিত এই খাদ্যগুলো খেলে ক্যান্সারের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে বিএফএসএ দ্রুত সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়ার কথা। তবে বিএফএসএর চেয়ারম্যান জাকারিয়া জানিয়েছেন, গবেষণাগুলো যারা করেছেন, তারাই দায়বদ্ধ। বিএফএসএর সঙ্গে এর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
এর আগে, ফুচকা, চটপটি, আখের রসসহ বিভিন্ন রাস্তার খাবারে ইকোলাইসহ নানা ধরনের ডায়রিয়ার জীবাণু পাওয়া গেছে, কিন্তু সেগুলো দূর করতে বিএফএসএ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এছাড়া, ডিম, মুরগি, মাছ, মাংস, আলু এমনকি চালের মধ্যেও ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেলেও সেটা দূর করতে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি প্রতিষ্ঠানটিকে।
এ বছরের এপ্রিল মাসে ভারতীয় ব্র্যান্ড এমডিএইচ এবং এভারেস্টের বিরুদ্ধে মশলার মিশ্রণে ক্যানসার সৃষ্টিকারী কীটনাশক ইথিলিন অক্সাইডের উপস্থিতির অভিযোগ ওঠে। ক্যানসার সৃষ্টিকারী এই উপাদানের উচ্চমাত্রার উপস্থিতি পাওয়ায় হংকং এবং সিঙ্গাপুরে ব্র্যান্ড দুটি গুঁড়ো মশলা বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু বিএফএসএ চেয়ারম্যান মশলাগুলো পরীক্ষা করে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বললেও, গত পাঁচ মাসে প্রতিষ্ঠানটি মশলাগুলো নিষিদ্ধ করা কিংবা এই বিষয়ে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জনগণকে সচেতন করার উদ্যোগ নেয়নি।
বিএফএসএর সাবেক সদস্য মো. মাহবুব কবির বলেন, 'খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে খাবার টেবিল পর্যন্ত নিরাপদ রাখতে যা করার দরকার, তা বিএফএসএকে করতে হবে। অথচ চাল, ডাল, আলু, শাকসবজি, মাছ, মাংস, ডিম, মুরগী, সবকিছুর মধ্যে মারাত্মক পরিমাণে ভারী ধাতু পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু বিএফএসএ সে বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।'
তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার মতো কর্তৃপক্ষ সাধারণত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে কিংবা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অধীনে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিএফএসএ কাজ করছে। এই কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা থাকলেও মোবাইল কোর্ট ছাড়া সিলগালা, জব্দ করা বা জরিমানা আদায় করার ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয় না।
বিএফএসএর সক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে ৫২টি জেলায় মিনি ল্যাবরেটরি স্থাপন কার্যক্রম চলছে। তবে সেগুলোতে পণ্য নমুনা পরীক্ষার কার্যক্রম নামমাত্র। মোবাইল ল্যাবরেটরিগুলোও একই অবস্থায় রয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে পণ্যের সব ব্র্যান্ড পরীক্ষা করে ঝুঁকি ভিত্তিক পর্যালোচনা করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। মোড়কজাত পণ্যের মেয়াদের সঠিকতা নিরূপণের ব্যবস্থাপনা নিয়ে একবার উদ্যোগ নিলেও সেটি বাস্তবায়িত হয়নি।
বিএফএসএর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির দুটো দুর্বল দিক স্পষ্ট। প্রথমত, খাদ্যদ্রব্য জব্দকরণ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া বিএফএসএ কর্মকর্তাদের জন্য সীমাবদ্ধ, যার জন্য প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানকে উদ্যোগ নিতে হবে। তবে এই বিষয়ে কেউ উদ্যোগী নয়। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজারে মনিটরিং করছে, কিন্তু বিএফএসএ সে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারছে না।
দ্বিতীয়ত, বিএফএসএ খাদ্য ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স প্রদানের ক্ষমতা চাইছে। ফুড সেইফটি লাইসেন্স ছাড়া কেউ যাতে খাদ্য ব্যবসা না করতে পারে, এবং লাইসেন্স দেওয়ার আগে তাদের নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের সব শর্ত পূরণের বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের টেবিলে পড়ে রয়েছে।
২০২২ সালের ২২ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বিএফএসএ'র আইন সংশোধনের বিষয়ে একটি সভা করে। সেই সভায় কিছু সংযোজন পরিমার্জনের নির্দেশ দেওয়ার পর খাদ্য মন্ত্রণালয় সেটি বাস্তবায়ন করেনি।
সাবেক খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, 'আমি এখন খাদ্য মন্ত্রণালয়ে নেই। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না।'
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আইন সংশোধন না হলে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী বা ব্যবসায়ীদের ওপর বিএফএসএ প্রকৃতপক্ষে মনিটরিং জোরদার করতে পারবে না। এজন্য প্রতিষ্ঠানগুলো বিএফএসএর নির্দেশনাগুলো গুরুত্ব সহকারে নেয় না।
আইনটি সংশোধন হলে রপ্তানি খাদ্যপণ্যের সার্টিফিকেশন নিয়েও কাজ করতে পারে বিএফএসএ। প্রস্তাবনায় জরিমানা বাড়ানোর বা কমানোর প্রস্তাবও রয়েছে। বিএফএসএর চেয়ারম্যান জাকারিয়া বলেন, 'আমাদের ফান্ডে চারটি গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর দায়ভার সম্পূর্ণ তাদের, বিএফএসএর নয়। খাবারে ভারী ধাতুর প্রবেশ বন্ধ করতে হলে আরও গবেষণা দরকার, তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি।'
আইন সংশোধনের বিষয়ে তিনি বলেন, 'আইনের কিছু সংশোধন বিএফএসএতে ফেরত এসেছে। সংশোধনগুলো করে আবার পাঠাতে হবে, প্রক্রিয়াটি জটিল হওয়ায় সময় লাগছে।'