দস্তগীর হোটেল: নলা-নেহারির জন্য যে হোটেলের নামডাক দেশজুড়ে
চট্টগ্রাম শহরের খাবারের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বহুদিনের। বিশেষ করে- মেজবানী মাংস, গরুর কালাভুনা বা শুটকি ভুনার কথা আলাদা করে উল্লেখ না করলেই নয়। সমুদ্রঘেরা এই শহরটি যেমন ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত, তেমনই এর ঐতিহ্যবাহী খাবার–দাবারের জন্যেও। ভোজনরসিকদের মনে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে এসব খাবার। তাই তো দূর-দূরান্ত থেকে তারা ছুটে আসেন খাবারের স্বাদ উপভোগ করতে।
দস্তগীর হোটেল এর 'নলা-নেহারি' ও ঠিক এমন এক পদের খাবার। স্থানীয় ভোজনরসিকদের কাছে যেমন এটি প্রিয় নাম, তেমনি এর স্বাদও অতুলনীয়। দেশের নানা প্রান্তের মানুষের কাছে এর জনপ্রিয়তাও তুমুল। ভোর হলেই সে কথার স্পষ্ট প্রমাণ মেলে। চট্টগ্রামে ঘুরতে এলে ভ্রমণপিপাসুদের একবারের জন্য হলেও এই নলা-নেহারির স্বাদ নেওয়া চা-ই চাই। কারণ রাতভর অপেক্ষা করা নেহারিপ্রেমীরা জানেন, এই হোটেলের নলা-নেহারি একবার খেলে তার স্বাদ ভুলে থাকা কঠিন। তাই তো ভোররাত থেকে অনেকেই ভিড় জমান দস্তগীরের সামনে।
ভোর তখন ৪টা বেজে ৩৪ মিনিট। নলা-নেহারির স্বাদ নিতে ভোরের নরম আলো আর শীতল বাতাসকে সাথে নিয়ে আমিও ছুটলাম দস্তগীরের উদ্দেশ্যে। রাস্তায় তখন মানুষের চলাচল নেই তেমন। নেই কোনো গাড়ি–ঘোড়ার শব্দও। প্রতিদিনের কোলাহল নেই, নেই কোনো ব্যস্ততার চাপ। গা ছমছম আবহ চারপাশে। ঘুমন্ত শহরে গাড়ির দেখা না পেয়ে অপেক্ষা করলাম আরও আধঘণ্টা। ভাগ্য এবার সহায় হলো।
ভোর বেলাতেই ভিড় বাড়ে
এই সময়ে যানবাহন যে সহজে মেলে তা নয়; ঢাকার কথা ধরলে ব্যাপারটা আলাদা। তবে চট্টগ্রামে এমন সময়ে যানবাহনের দেখা পাওয়া ভার! তার উপর চুরি ছিনতাইয়ের ভয় তো ছিলই। ফাঁকা রাস্তায় মোটর রিকশাযোগে পৌঁছে গেলাম মিনিট দশেকের মধ্যে। আন্দরকিল্লার কদম মুবারকের মোমিন রোডের এক পাশে রিকশা এসে থামলো। নেমেই হাতের ডানে ঐতিহ্যবাহী সেই দস্তগীর হোটেল।
এত ভোরেও দোকানের সামনে অনেক মানুষের আনাগোনা। দোকানের ভেতরে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। সে ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢোকাই যেন দায়। ভেতরে দাঁড়ানোর জায়গায়টুকু নেই। কায়দা করে কোনোরকম ঢুকে চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে পড়লাম একটি টেবিলের সামনে।
এখানে ঠিক সময়ে খেতে হলে, এটিই নিয়ম— অন্যদের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকা। তারপর তারা খেয়ে উঠে পড়লে টুপ করে বসে পড়া। এমনটা করতে না পারলে সেদিনের মত নলা-নেহারি জুটবে না কপালে।
ভোরবেলা দস্তগীর হোটেলের সামনে জমে ওঠা ভিড়ই বলে দেয় এই নেহারির কদর কতটা। প্রতিদিন ফজরের সময়ের আগে হোটেলের দরজায় পা পড়ে ভোজনপ্রেমীদের। চারটা বাজতে না বাজতেই হোটেলের কর্মীরা নেহারির হাড়ি নামিয়ে সাজিয়ে ফেলেন। যেন এক মুহূর্তও বসে থাকার ফুরসত মেলে না তাদের। রান্না শেষে মিনিট তিরিশের পরে শুরু হয় খাবার পরিবেশন।
খেতে আসেন বিদেশি ফুড ভ্লগাররাও
এই হোটেলের সুস্বাদু নলা-নেহারির নামডাক দেশ ছাড়িয়ে পৌঁছেছে ভিনদেশেও। কথাচ্ছলে হোটেল মালিক নূর আলম সে কথা জানালেন।
বিখ্যাত কানাডিয়ান ফুড ব্লগার ট্রেভর জেমসও একবার এসে চেখে নিয়েছেন নলা-নেহারির স্বাদ। 'দ্য ফুড রেঞ্জার' নামক ফুড ব্লগিং প্ল্যাটফর্মে এ নিয়ে ভিডিও বানিয়েছেন তিনি।
তাছাড়া, প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত হতে চট্টগ্রাম ঘুরতে আসেন যারা, একবার করে হলেও তারা দস্তগীরের নলা-নেহারি খেয়ে যান। বিশেষ করে, শীতের সকালে গরম গরম নলা-নেহারির চাহিদা এতটাই বেশি হয়, খুব ভোরে না গেলে পাওয়া দায়। কাঁচের কাপে ধোঁয়া ওঠা চা, তার সাথে গরম রুটি আর নলা-নেহারির প্লেট—ব্যস! আর কী চাই ভোজনরসিকদের!
কথা হলো এক গ্রাহকের সাথে। নাম রিফাত হোসেন। পড়ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিন বন্ধুকে সাথে নিয়ে নলার ঝোল খেতে দস্তগীরে তার আসা। তবে এটিই প্রথমবার নয়। প্রায়ই তারা হুটহাট প্ল্যান করে চলে আসেন এখানে। নিজেরা খেয়ে কিনে নেন পরিবারের জন্যও।
রিফাত বলেন, "শীতকালে বেশি আসা হয় এখানে। কুয়াশা থাকে চারপাশে। এই সময় গরম গরম নলা-নেহারি খাওয়ার ব্যাপারই অন্যরকম। তবে দেরি করলে খাবার শেষ হয়ে যায় অনেক সময়। আমি এবং আমার বন্ধুরা কতবার যে না খেয়ে ঘরে ফিরেছি, হিসাব নেই।"
শুধু হোটেল নয়, আবেগের জায়গাও
চট্টগ্রামে বসবাসকারী বিভিন্ন বয়সী মানুষের কাছে দস্তগীর হোটেল শুধু খাবারের দোকান নয়, আবেগের জায়গাও। পঞ্চাশ বা ষাটোর্ধ্ব বয়স্করা বলেন, তাদের ছেলেবেলার স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই হোটেলের নাম।
কথা হলো মো. সাত্তারের সাথে। ষাটোর্ধ্ব এই ব্যক্তি আগে নিয়ম করে ঢুঁ মারতেন এখানে। বন্ধুবান্ধবকে সঙ্গে নিয়ে এখানে আসতেন। ওই সময়ে গল্প-আড্ডায় গরম রুটি আর নলা-নেহারি খাওয়া তাদের নিত্যদিনের আনন্দের একটি অংশ ছিল। এখনো আসেন মাঝেসাঝে। তবে সে বন্ধুরা আর তার কাছে নেই। সময় পেলেই দস্তগীরে আসার সেই প্রথা বহাল আছে, শুধু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভিড়টা বেড়েছে বলে জানান সাত্তার।
তিনি বলেন, "একা আসতাম না কখনো। সবসময় কেউ না কেউ থাকতোই। সকাল সকাল আব্বা আসতে দিতেন না বলে লুকিয়ে লুকিয়েও খেতে এসেছি অনেকবার। তখন কত পাগলামিই না করেছি। এখন আমার স্ত্রীকে নিয়ে আসি মাঝেমধ্যে। ফজরের নামজ শেষে হেঁটে চলে আসি। তবে অতিরিক্ত ভিড় থাকে বলে কম আসা হয়।"
বিহারী বাবুর্চি
দেশ স্বাধীনের আগে থেকেই চালু হয় এর কর্মযজ্ঞ। খাবারের অকৃত্রিম স্বাদ এবং মানের জন্য বেশ প্রসিদ্ধ দস্তগীর। চট্টগ্রামে বসবাসরত হাজার হাজার মানুষের স্মৃতির সাথেও জড়িয়ে আছে এই হোটেলের নাম। শুরু থেকেই নলা-নেহারির জন্য সুপরিচিত এটি। তখন অবশ্য এক বিহারী বাবুর্চি রান্না করতেন। সুস্বাদু নলা-নেহারি রান্নার জন্য মানুষের কাছে বেশ নাম ডাকও ছিল রি বাবুর্চির। কালক্রমে ব্যাপকভাবে এই রান্নার সুনাম মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই হোটেলে বাড়তে থাকে মানুষের আনাগোনা।
এই হোটেলের ইতিহাস যেমন পুরনো, তেমনি পুরনো এর রান্নার ধরণও। পাকিস্তান আমলে যাত্রা শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত সমান জনপ্রিয়তায় চলছে এই হোটেল। এরই মাঝে পেরিয়ে গেছে ৬৫ বছর। বদলে গেছেন পুরাতন সেই বিহারী বাবুর্চি। বিভিন্ন মানুষের হাতে উঠেছে হোটেলের মালিকানা। দোকানের চিত্রপটও বদলেছে। শুধু বদলায়নি নলা-নেহারি খেতে আসা মানুষের উপচে পড়া ভিড়; এটি আছে আগের মতোই।
পুরাতন খদ্দের যারা, তারা নিয়ম করে এসে খেয়ে যান বিশেষ এই পদ। তাদের মতে, আগের স্বাদের সাথে বর্তমানের কোনো হেরফের নেই। এখনও আদিম স্বাদে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন তারা। তবে একই স্বাদ অব্যাহত রাখার বিষয়টি খোলাসা করলেন হোটেলের বর্তমান মালিক নুরুল আলম। বিগত ১২ বছর ধরে তিনিই এই হোটেল পরিচালনা করছেন। এর আগে, পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আলাউদ্দিন নামের এক ব্যক্তি।
নুরুল আলম বলেন, "এই রান্না প্রথম চালু করেছিলেন এক বিহারী বাবুর্চি। আমাদের বর্তমান বাবুর্চিও সেই বিহারী বাবুর্চির সাথে থেকে শিখেছেন। বর্তমানে যিনি আছেন, তিনি ৩০-৩৫ বছর ধরে নলা নেহারি রান্না করছেন।"
প্রথমে পাকিস্তানি বাবুর্চির হাতে তৈরি হতো এই বিশেষ পদ, এখন তার উত্তরাধিকারীর হাতে নিখুঁতভাবে তৈরি হচ্ছে। আর মানুষের ভিড়ই বলে দেয়, স্বাদে কোনো কমতি নেই।
ভোর ৪ টায় শুরু, রাত ১২ টায় শেষ
নুরুল আলমও জানালেন, হোটেলের সবচেয়ে জনপ্রিয় রান্নার পদ হলো নলা-নেহারি। তবে রোববার ও বৃহস্পতিবার বিশেষ মেজবানের আয়োজন করেন তারা। সে দিনগুলোয় দুপুর বেলা খদ্দেরদের আনাগোনাও বাড়ে। রাতেও যে কম থাকে তা নয়; বরং তখন চিংড়ি ভুনা আর গরুর মাংস ভুনা থাকে গ্রাহকদের পছন্দের শীর্ষে।
"সকাল সাড়ে চারটার দিকে খাবার দেওয়া শুরু করি। কিন্তু শুক্রবারে একটু আগেই হয়। ধরতে গেলে ভোর ৪টা থেকে শুরু হয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ চলে। এভাবে একই নিয়মে চলতে থাকে হোটেলের কাজ," বলেন নুরুল আলম।
আবার খাবারের স্বাদ এবং মান অনুযায়ী দাম বেশি তাও কিন্তু নয়। মাত্র ২০০ টাকায় কব্জি ডুবিয়ে গরম গরম নলা এবং নেহারি খেতে পারবেন দস্তগীরে। সঙ্গে আছে খাসির পায়াও। মাত্র ১০০ টাকায় পাওয়া যাবে এই সুস্বাদু খাবার।
ভোরবেলার রোদের সাথে সাথে যখন ক্ষুধাও বাড়ে, তখন দস্তগীরের চিকেন স্যুপের কথা মনে পড়ে অনেকের। মাত্র ৮০ টাকায় পাওয়া যাবে এক বাটি চিকেন স্যুপ। এই হোটেলের জনপ্রিয় খাবারের তালিকায় আরেক সংযোজন হলো গরুর বট। সেটির দামও ১২০ টাকার মধ্যে।
শুধু বট নয়, গরুর মাংস ভুনা কিংবা চিংড়ি ভুনা খেতে চাইলে ভোজনরসিকদের খরচা হবে মাত্র ১২০ টাকা।
কর্মব্যস্ত এই হোটেলের লোকবল ৪৫ জনের মতো। নলা-নেহারি রান্নার জন্য আছেন একজন বিশেষ বাবুর্চি। শুধু এই কাজটিই করেন তিনি। বাকি সব রান্নাবান্নার জন্য আছেন আরও ৫ জন। রুটি বানানোর জন্য আছেন ৬ জন কর্মী। এতেও গ্রাহক সামলানো কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে মাঝেমধ্যে।
তবে এত বেচা-বিক্রির পরেও খুব বেশি লাভ হয়না বলে জানালেন নুরুল আলম। মাসে লাভের পরিমাণ ৪০ হাজার, কখনো ৩০ হাজার, আবার মাঝে মাঝে ২০ হাজারেও নেমে আসে।
তার ভাষ্য মতে, "জিনিসপত্রের দাম যে হারে বাড়ছে, টিকে থাকাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।"