১৪ বছর বয়সেই হয়ে ওঠেন ‘দক্ষিণ এশিয়ার পপ রানি’; ৩৫-এ ক্যান্সার কেড়ে নেয় জীবন
ডেনিম ডুঙ্গারি পরা এক তরুণী—আদতে কিশোরী। মাথার চুল পরিপাটি করে বেণী করা। ১৯৮০-র দশকে এই ছোট্ট মেয়েই ঝড় তোলেন সংগীত জগতে। 'আপ জ্যায়সা কোই', 'ডিস্কো দিওয়ানে' গানের সুবাদে ওই বয়সেই তিনি তারকা বনে যান।
নাজিয়া হাসানের বয়স তখন মাত্র ১৪ বছর। যদি আপনি জেনারেশন এক্স বা মিলেনিয়াল হলে, কিংবা সেই সময়ের গান নিয়ে আগ্রহ থাকলে, পাকিস্তানে জন্ম নেওয়া এই গায়িকা-গীতিকারের গানগুলো নিশ্চয় অজস্রবার শুনেছেন আপনিও। না শোনার কোনো কারণ নেই—নাজিয়া হাসান যে বিখ্যাত ছিলেন 'কুইন অভ সাউথ এশিয়ান পপ' নামে।
গানের শক্তিতে রাজনৈতিক শত্রুতাপূর্ণ দুই দেশকে একটু হলেও এক করেছিলেন নাজিয়া।
খ্যাতির প্রথম সোপান
নাজিয়ার তারকাজীবনের গল্পের শুরুটা ১৯৮০-র দশকে, বলিউডের হাত ধরে। ১৯৮০ সালের কথা। 'কুরবানি' সিনেমা নির্মাণ করছেন পরিচালক-প্রযোজক-অভিনেতা ফিরোজ খান। ছবির গান সামলানোর দায়িত্ব চেপেছে মুম্বাইয়ের সুরকার জুটি কল্যাণজি-আনন্দজির ঘাড়ে। তারা শুনলেন বিড্ডু ও নাজিয়া নামে দুজনকে দিয়ে গান গাওয়াতে চান ফিরোজ খান।
এদিকে 'কুরবানি'র গান গাইবেন মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার, আশা ভোঁসলে ও অমিত কুমারের মতো মহারথীরা। তাদের ভিড়ে একেবারেই আনকোরা দুজন শিল্পীকে দিয়ে গাওয়ানোটা ঝুঁকির কাজ মনে হলো সুরকারদের।
লন্ডনে এক পার্টিতে ফিরোজ খানকে নাজিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন অভিনেত্রী জিনাত আমান। জিনাতও ছিলেন 'কুরবানি'তে। ছোট্ট নাজিয়ার গান শুনেই ফিরোজ বলে বসলেন, তার পরের ছবিতেই একটি গান গাইতে হবে নাজিয়াকে।
কম্পোজার বিড্ডু চেয়েছিলেন বনি এমের 'রাসপুতিন' গানের হিন্দি সংস্করণ তৈরি করবেন। কিন্তু নাজিয়া ও তার ভাই জোহেবের মনে ছিল অন্য চিন্তা। তাদের হাত ধরেই জন্ম নেয় 'আপ জ্যায়সা কোই' গানটি—যা দক্ষিণ এশীয় পপ সংগীতের জগতে বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়। এ গান এক কিশোরীকে খ্যাতির শিখরে নিয়ে যায়।
'কুরবানি'র সাফল্যের পর নাজিয়াকে 'স্টার' ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু গানেই থাকতে চান বলে তিনি সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। রাজ কাপুরও তাকে 'হেনা' ছবিতে রাজীব কাপুরের বিপরীতে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন; কিন্তু নাজিয়া সেই প্রস্তাবও ফিরিয়ে দেন। অভিনয়ের চেয়ে সামাজিক কাজ, গান আর পড়াশোনাতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন।
উত্থান
নাজিয়া হাসানের জন্ম পাকিস্তানের করাচিতে, বেড়ে ওঠা করাচি ও লন্ডন মিলিয়ে। তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী বশির হাসান ও সমাজকর্মী মুনিজা বশিরের কন্যা। নাজিয়ার আরও দুই ভাইবোন ছিলেন—ভাই গায়ক জোহেব হাসান ও বোন জারা হাসান।
'কুরবানি' মুক্তির পর যে মাত্র ১৪ বছর বয়সে সংগীতজগতে এভাবে খ্যাতি পেয়ে যাবেন, সেটি নাজিয়ার কল্পনাতেও ছিল না।
ফিরোজ খান যখন প্রথম গান গাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তখন নাজিয়া স্কুল কামাই দিতে হবে বলে একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন।
তবে 'কুরবানি' ছবির অ্যালবাম দারুণ সাফল্য পায়। এ ছবি উপমহাদেশকে এক নতুন তারকা উপহার দেয়। ১৪ বছর বয়সি এক মেয়ের গাওয়া গানে ঠোঁট মেলান জিনাত আমান। এর মাধ্যমেই বলিউডে এক নতুন ধারার সংগীতের সূচনা হয়।
'আপ জ্যায়সা কোই' গানের মাধ্যমে ডিস্কো ও ফিল্মি-পপ ঘরানা ধীরে ধীরে উপমহাদেশে শক্ত ভিত পায়। নাজিয়ার 'আপ জ্যায়সা কোই'র হাত ধরে ১৯৮০-র দশকের ইলেকট্রো-ডিস্কো ঢেউয়ের নিখুঁত সূচনা। ১৯৮১ সালে আর.ডি. বর্মণের 'দিল লেনা খেল হ্যায় দিলদার কা' গানটি বাজারে আসে। এরপর বাপ্পি লাহিড়ীর 'ডিস্কো ড্যান্সার' (১৯৮২) আরেকটি আলোড়ন তৈরি করে। এরপর 'নমক হালাল' (১৯৮২) ও 'হিম্মতওয়ালা'র (১৯৮২) গানের মাধ্যমে ডিস্কো সংগীত নতুন উচ্চতায় পৌঁছে।
দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ ও মধ্যবয়সি জনগোষ্ঠীর কল্পনায় যখন সিন্থ ও ডিস্কো সংগীত জায়গা করে নিচ্ছিল, তখনই ১৯৮১ সালে নাজিয়া হাসান হাজি হন প্রথম অ্যালবাম 'ডিস্কো দিওয়ানে' নিয়ে। একই বছর 'আপ জ্যায়সা কোই' গানের জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডে সেরা নারী প্লেব্যাক সিঙ্গারের পুরস্কার ছিনিয়ে নেন। তিনিই সবচেয়ে কমবয়সি শিল্পী হিসেবে এই পুরস্কার জিতেচেন।
দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে আধিপত্য ছিল 'ফিল্মি' সাউন্ডট্র্যাকের। 'ডিস্কো দিওয়ানে' এই বাজারে প্রথম পপ অ্যালবাম হিসেবে শীর্ষে উঠে আসে। ব্রাজিলের টপ চার্টে ওঠা প্রথম পপ অ্যালবামও এটি। এছাড়া নাজিয়াকে প্রথম পাকিস্তানি গায়িকা হিসেবে ব্রিটিশ টপ চার্টে জায়গা পাইয়ে দেয় 'ডিস্কো দিওয়ানে'। এ অ্যালবামের শিরোনাম গানটি অজস্রবার পুনঃনির্মাণ ও কাভার করা হয়েছে।
নাজিয়ার পরের তিনটি অ্যালবাম—'বুম বুম/স্টার' (১৯৮২), 'ইয়াং 'তারঙ্গ' (১৯৮৪) ও 'হটলাইন' (১৯৮৭)—ইন্ডি-পপ বাজারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। 'ইয়াং তারঙ্গ' ছিল প্রথম দক্ষিণ এশীয় অ্যালবাম, যার সঙ্গে মিউজিক ভিডিও যুক্ত ছিল।
এছাড়াও নাজিয়া ও জোহেব জুটি প্রথম দক্ষিণ এশীয় শিল্পী হিসেবে আন্তর্জাতিক রেকর্ড লেবেল ইএমআই-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। এই অ্যালবামগুলো নাজিয়াকে উপমহাদেশের প্রতিষ্ঠিত পপ তারকায় পরিণত করে। প্রবাসীদের মধ্যেও হয়ে ওঠেন জনপ্রিয়। নাজিয়া হয়ে ওঠেন প্রতিটি ঘরের পরিচিত কণ্ঠ ও চেহারা।
১৯৮৯ সালে 'মিউজিক '৮৯' অনুষ্ঠানের হাত ধরে পাকিস্তানি সংগীতের জগতে বড় পরিবর্তন আসে। এটি ছিল পাকিস্তানে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত প্রথম পপ মউজিক স্টেজ শো। এ অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন নাজিয়া ও জোহেব জুটি। এই অনুষ্ঠানই ভিটাল সাইনস, জুপিটার্স ও স্ট্রিংসের মতো ব্যান্ডগুলোকে পরিচিত করিয়ে দেয়। পরের কয়েক দশকে উপমহাদেশের সংগীত সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় গভীর প্রভাব ফেলেছিল এসব ব্যান্ড। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ডিস্কোর জনপ্রিয়তা কমে আসে।
নাজিয়া আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজে যুগকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। স্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন সংগীতজগতে। ১৯৮০-র দশকে উপমহাদেশ এক সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এই দশকে নাজিয়ার তারকাখ্যাতি ছিল শীর্ষে। ১৯৯০-এর দশকে সংগীতের নতুন ঢেউ আসার পর তার ক্যারিয়ারে ভাটার টান লাগে। ১৯৯২ সালে নাজিয়া ও জোহেবের শেষ অ্যালবাম 'ক্যামেরা ক্যামেরা' মুক্তি পায়। অ্যালবামটি মোটামুটি সাফল্য পায়।
ডিস্কোর আলো ছাড়িয়ে
গোটা ক্যারিয়ারজুড়েই সবাই নাজিয়াকে অন্য কারও প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখতে চেয়েছে। কম্পোজার বিড্ডু নাজিয়া ও তার ভাই জোহেবকে শিল্পী জুটি দ্য কার্পেন্টার্সের আদলে গড়তে চেয়েছিলেন। আবার অনেকে তাদের সংগীতকে ডেভিড বাউয়ি, বনি এম ও জ্যাকসন ৫-এর মিশেল হিসেবে দেখেছেন। তবে এসবের মধ্যেও নাজিয়া তার স্বকীয় কণ্ঠ ও অনন্য ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে নিজেকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছিলেন।
'আপ জ্যায়সা কোই'র সাফল্যের পর কিশোরী নাজিয়া এক জাতীয় টিভিতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মুখে সরল হাসি নিয়ে আশ্চর্য সংযম নিয়ে গানটির ব্যাপারে কথা বলেছিলেন। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সংগীত ও নৃত্যে আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি তার প্রতিভাকে আরও শাণিত করার পরিকল্পনা করেছেন কি না। উত্তরে নাজিয়া বলেছিলেন, 'না, আমার মনে হয় স্কুল চলাকালীন আমার সময় হবে না। হয়তো কলেজের পর।' এই দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাসই নাজিয়াকে বাকিদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছিল।
তিনি যা ভালোবাসতেন, সেটাই করতেন। তার প্রতিটি গানই মানুষকে গাইতে ও নাচতে প্রেরণা জোগাত। সাফল্যের শুরু থেকেই নাজিয়ার পরিচয় নিয়ে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় রক্ষণশীল সমাজে। ওই সময়ে পপ তারকাকে সামাজিকভাবে মোটেই সম্মানের চোখে দেখা হতো না। পারিবারিক সম্মানের চাপে তাকে অনেক কিছুই সহ্য করতে হয়েছে। এ সবই তিনি সহ্য করে গেছেন।
নাজিয়া পড়াশোনা শেষে একটি স্থিতিশীল পেশাগত জীবন চেয়েছিলেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় প্রশাসন ও অর্থনীতিতে ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। পরে আইনেও ডিগ্রি লাভ করেন। খ্যাতির শীর্ষে থেকেও তিনি তার পেশাগত জীবন চালিয়ে যান, জাতিসংঘে কাজ করেন।
নাজিয়া ছিলেন মানবাধিকার কর্মী। দারিদ্র্যপীড়িত শিশুদের সহায়তায় অসংখ্য দাতব্য কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন তিনি।
বিয়ে ও মৃত্যু
নাজিয়া হাসান ১৯৯৫ সালে পারিবারিকভাবে করাচিভিত্তিক ব্যবসায়ী মির্জা ইশতিয়াক বেগকে বিয়ে করেন। তবে তাদের সম্পর্কে বনিবনা ছিল না। মারা যাওয়ার দিন দশেক আগে নাজিয়া ইশতিয়াককে তালাক দেন।
নাজিয়া হাসান যুক্তরাজ্যের একটি উচ্চ আদালতে স্বামী মির্জা ইশতিয়াক বেগের বিরুদ্ধে শারীরিক নির্যাতন ও তার ওপর বিষপ্রয়োগের অভিযোগ আনেন।
২০০০ সালে এক সাক্ষাৎকারে নাজিয়া বলেন, ইশতিয়াক তার ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য টাকা দিতে রাজি হননি।
ইশতিয়াকের আগের দুটি বিয়ের কথা—ফিলিপিনো নৃত্যশিল্পী হ্যাজেল ও পাকিস্তানি অভিনেত্রী শাজিয়ার সঙ্গে—নাজিয়ার পরিবারের জানা ছিল না। নাজিয়া ও বেগের সংসারে এক ছেলের জন্ম হয়।
ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াইয়ে হার মেনে ২০০০ সালের ১৩ আগস্ট লন্ডনে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে মারা যান নাজিয়া হাসান। মৃত্যুর তিন দিন আগে তাকে নর্থ লন্ডন হসপাইস-এ ভর্তি করা হয়েছিল। মৃত্যুর আগেরদিন কিছুটা সুস্থতার লক্ষণ দেখা যায় তার মধ্যে। কিন্তু ১৩ আগস্ট হঠাৎ তার তীব্র কাশি শুরু হয়, এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই পালমোনারি অ্যামবোলিজমে তার মৃত্যু হয়। লন্ডনের হেনডনে তাকে দাফন করা হয়।
নাজিরার ভাই জোয়েব পরে 'দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন'কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, 'ও (নাজিয়া) একজন অসুখী মানুষ হিসেবেই মারা গেছে, যন্ত্রণা নিয়ে মারা গেছে।'
বহু মানুষের আইকন
সবকিছু ছাপিয়ে নাজিয়া ছিলেন বহু নারীর অনুপ্রেরণা। রক্ষণশীল দক্ষিণ এশীয় সমাজে লাজুক নাজিয়া হাসান হয়ে উঠেছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার পপের রানি। তার সংগীত ঐতিহ্যগত ধারার বাইরে গিয়ে অসংখ্য মেয়ের জন্য নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছিল।
২০০০ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ফুসফুসের ক্যান্সারে নাজিয়ার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর প্রায় ১০ দিন আগে স্বামী মির্জা ইশতিয়াক বেগের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করেন তিনি।
পরে এক সাক্ষাৎকারে নাজিয়ার ভাই জোহেব তার বোন সম্পর্কে বলেছিলেন, 'ও কখনও ব্যক্তিগত জীবনের কোনো কথা জানাত না। ক্যান্সার একটি মরণব্যাধি। কেমোথেরাপির সময় ধীরে ধীরে ওকে ভেঙে পড়তে দেখেছি আমি। আর ওর বিয়েও একটা বড় ভুল ছিল।'
পাকিস্তানে জন্ম নেওয়া এবং লন্ডনে বেড়ে ওঠা নাজিয়া হাসান হয়ে উঠেছিলেন উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক আইকন।