জ্যাক মার জাদু: চীনের মানি সুপারমার্কেট যেভাবে ২০০ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি
১৬ বছর আগে জ্যাক মা যখন তার অনলাইন কেনাকাটা ব্যবসার জন্য অখ্যাত এক লেনদেন ব্যবস্থার সূচনা করেন, বেশিরভাগ মানুষ ভাবতেই পারেনি, এই উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখবে। বর্তমানে এর মাধ্যমেই অ্যান্ট গ্রুপের ভিত্তিপ্রস্তর গড়ে উঠেছে।
এই প্রতিষ্ঠানের মূল্যমান এখন ২০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এবং চীনের বৃহত্তম অনলাইন লেনদেন প্রতিষ্ঠান।
চীনের জনগণের প্রায় সকল ধরনের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গেই প্রতিষ্ঠানটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে।
তবে এটি গড়ে উঠেছিল চীনের নতুন গড়ে ওঠা অনলাইন কেনাকাটা ব্যবসা খাতের সীমাবদ্ধতা দূর করতে। ২০০৪ সালের দিকে খুব কম মানুষেরই ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ছিল। ফলে অর্থের লেনদেনের জন্য আলিবাবা ই-কমার্স প্লাটফর্মের ক্রেতা ও বিক্রেতাদের প্রয়োজন ছিল নির্ভরযোগ্য অর্থ লেনদেনের একটি মাধ্যম।
জ্যাম মা তখনই আলিবাবার ফিন্যান্স বিভাগকে আলিপে তৈরির নির্দেশনা দেন। ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে অর্থ লেনদেনের কাজে নিয়োজিত তৃতীয় পক্ষ হিসেবেই কাজ করত এই পরিষেবা। ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার পর অর্থ গ্রহণ করে তা বিক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো।
২০১৪ সালে সিবিএস নিউজের একটি সাক্ষাৎকারে জ্যাক মা জানান, "আমি যখন আলিপে শুরু করি, সবাই বলেছিল, 'জ্যাক, এটি আমাদের দেখা সবচেয়ে অকেজো ব্যবসা পরিকল্পনা। কেউই এটি ব্যবহার করবে না।'"
জ্যাক মা বলেন, 'আমি বলেছিলাম, যতক্ষণ পর্যন্ত এই পরিকল্পনা কাজ করছে, এটি বৈজ্ঞানিক কি না, এর বাহ্যিক রূপ কেমন- তা আমি পরোয়া করি না। কাজ করলেই তা গ্রাহকদের বিশ্বাস গড়ে তুলতে সক্ষম।'
এই পরিকল্পনা পরে সত্যিকার অর্থেই কাজ করে। বর্তমানে, প্রতি মাসে ৭১১ মিলিয়ন মানুষ আলিপে ব্যবহার করেন। গত জুন মাস পর্যন্ত ১২ মাসের হিসাবে, আলিপের মাধ্যমে ১১৮ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (১৭.২ ট্রিলিয়ন ডলার) লেনদেন হয়েছে।
২০০৯ সালে আলিপের মোবাইল অ্যাপ বাজারে আসে। বাজার গবেষণা সংস্থা ই-মার্কেটারের তথ্যানুযায়ী, এ বছরের প্রথম তিন মাসে চীনের ৫৫ শতাংশের বেশি মোবাইল লেনদেন সম্পন্ন হয় আলিপের মাধ্যমে; অন্যদিকে টেনসেন্টের উইচ্যাট পে এবং কিউকিউ ওয়ালেটের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় ৪০ শতাংশ।
অ্যাপটি মানুষকে হরেক রকম আর্থিক পরিষেবার সঙ্গেও যুক্ত করতে সাহায্য করে। আলিপের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা ইন্সুরেন্স, বিল প্রদান, কেনাকাটা এবং বিনিয়োগও করতে পারেন।
রেস ক্যাপিটালের অংশীদার এদিথ ইয়াং আলিপে'কে সুপারমার্কেটের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, 'যে ধরনের আর্থিক কাজ করতে যান, সবই আলিপের মাধ্যমে করা সম্ভব।'
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপ্রনএশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা জেনন ক্যাপ্রন জানান, আলিপে বর্তমানে এত বিস্তৃত আর্থিক পরিষেবা দিয়ে থাকে, লক্ষ লক্ষ মানুষ ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নিত্যদিনের অংশ হয়ে গেছে এটি।
আলিপের অন্যতম একটি জনপ্রিয় পরিষেবা হলো ইয়ুয়ে বাউ। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা তাদের অ্যাকাউন্টে বেঁচে থাকা অর্থ বিনিয়োগ করতে পারেন। অ্যাকাউন্টে ১ ইউয়ান থাকলেও তা সম্ভব।
চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম চায়না ডেইলির তথ্যানুযায়ী, ৬ মাসের মধ্যেই ৪৯ মিলিয়ন মানুষ এটি ব্যবহার শুরু করেন, জমা পড়ে ২৫০ বিলিয়ন ইউয়ান (৩৬.৫ বিলিয়ম ডলার)।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর এই পরিষেবায় বিনিয়োগের জন্য নির্ধারিত সর্বনিম্ন মূল্য ছিল ৫০ হাজার ইউয়ান (৭,৩০০ ডলার)।
ফিচ রেটিংয়ের হিসাব অনুযায়ী, এ বছরের মার্চ পর্যন্তও এই পরিষেবার মোট সম্পত্তি ছিল ১.২৬ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (১৮৪ বিলিয়ন ডলার)। অন্যদিকে, লক্ষ লক্ষ মানুষ এই প্রতিষ্ঠানের সেবা গ্রহণ করায়, তাদের কাছে চীনা গ্রাহকদের বিপুল পরিমাণ তথ্য রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো চীনের নির্ভরযোগ্য কোনো ক্রেডিট স্কোরিং সিস্টেম নেই। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য ২০১৫ সালে অ্যান্ট সিসেইম ক্রেডিট চালু করে। রেস ক্যাপিটালের ইয়াং জানান, সিসেইম ক্রেডিটই চীনের বৃহত্তম ক্রেডিট রেটিং সিস্টেম। এটি শুধু আর্থিক কাজেই ব্যবহৃত হয় না।
ইয়াং বলেন, 'আমি মানুষকে অনলাইন ডেটিং অ্যাপের প্রোফাইলেও সিসেইম স্কোর ব্যবহার করতে দেখেছি। আপনি চাইলেই এটি আপনার ডেটিং প্রোফাইলে যুক্ত করতে পারবেন।' নিজেদের ক্রয়ক্ষমতা প্রচারের জন্য অনেকেই তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সিসেম স্কোর সংযুক্ত করেন।
এ বছরের শুরুতে প্রতিষ্ঠানটি অ্যান্ট ফিন্যান্সিয়াল থেকে নাম পরিবর্তন করে অ্যান্ট গ্রুপ রাখে। গবেষক সানি তিয়ান জানান, প্রতিষ্ঠানটি নতুন করে নিজেদের কাজ সাজাচ্ছে। শুধু অর্থনৈতিক পরিষেবাই নয়, অন্যান্য অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে তারা প্রযুক্তিগত পরিষেবা প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করছে।
বিনিয়োগের পরামর্শ সেবার ক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহারও যুক্ত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। নতুন এই পরিষেবার নাম বাংনিতু। অ্যালগরিদমের সাহায্যে এই পরিষেবা ব্যক্তির জন্য উপযোগী বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলোকে সুপারিশ করে থাকে। এক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৮০০ ইউয়ান ( ১১৮ ডলার) বিনিয়োগ করতে হয়।
এপ্রিলে এই পরিষেবা আগমনের ৩ মাসের মধ্যেই প্রায় ২ লক্ষ ব্যবহারকারী যুক্ত হয়।
- সূত্র: সিএনএন