যেভাবে টাটা পরিবারের এক কমিউনিস্ট সদস্য ব্রিটেনের প্রথম এশীয় এমপি হয়েছিলেন
শাপুরজি সাকলতওয়ালা। নামটি হয়তো অনেকের কাছেই পরিচিত নয়। তবে এ নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক ইতিহাস। যে ইতিহাস সংগ্রাম, অদম্য মনোবল আর অধ্যাবসায়ের। খবর বিবিসির।
শাপুরজি ছিলেন ভারতের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গোষ্ঠী টাটা পরিবারের সদস্য। ২০ শতকের শুরুতে, তিনি রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি সবসময়ই শ্রমিক শ্রেণির অধিকার ও সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে কথা বলেছেন। তার জীবনকাহিনি সেই লড়াইয়েরই প্রতিফলন। একজন ব্যক্তি কীভাবে সমাজে পরিবর্তন আনতে পারেন, তার বাস্তব উদাহরণও তিনি।
পরিবারের অন্য সদস্যরা যেখানে তাদের বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য দেখাশোনায় ব্যস্ত ছিলেন, সেখানে শাপুরজি অন্য স্বজনদের মতো বংশীয় পদবি বা মর্যাদা গ্রহণ করেননি। তিনি টাটা গ্রুপের পরিচালনার কাজেও নিজেকে জড়াননি।
পরিবর্তে শাপুরজি নিজেকে স্পষ্টভাষী ও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন এশিয়া থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রথম সদস্য। যেখান থেকে তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছিলেন। এমনকি প্রায়ই মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে মতানৈক্যও হতো তার।
অভিজাত পরিবারে জন্ম নেওয়া শাপুরজি কীভাবে স্বজনদের চেয়ে আলাদা পথে হাঁটলেন? কীভাবেই বা তিনি ব্রিটেনের প্রথম এশীয় এমপি হলেন? এসবের উত্তর পরিবারের সাথে শাপুরজির সম্পর্কের মতোই জটিল।
শাপুরজির বাবা দোরাবজি ছিলেন তুলা ব্যবসায়ী। তার মা জেরবাই ছিলেন টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জামসেতজি নুসেরওয়ানজি টাটার ছোট মেয়ে। শাপুরজির বয়স যখন ১৪ বছর, তখন তার পরিবার জেবরাইয়ের ভাই ও তার পরিবারের সঙ্গে বসবাসের জন্য বোম্বের এসপ্লান্ডে হাউসে চলে গিয়েছিলেন। একপর্যায়ে শাপুরজির বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়। এরপর থেকে ছোট জামসেতজির কাছে বাবার স্নেহে বেড়ে ওঠেন শাপুরজি।
শাপুরজির মেয়ে সেহরি তার বাবার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ 'দ্য ফিফথ্ কমান্ডমেন্ট'-এ লিখেছেন, জামসেতজি শাপুরজিকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন। তিনি খুব ছোটবেলাতেই তার (শাপুরজি) মধ্যে ভালো সম্ভবনা দেখেছিলেন। তিনি তার (শাপুরজি) প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগী ছিলেন এবং তার (শাপুরজি) সক্ষমতার প্রতি অগাধ আস্থা রেখেছিলেন।
তবে শাপুরজির প্রতি জামসেতজির এ আলাদা নজরে প্রচণ্ড বিরক্ত ছিলেন তার বড় ছেলে দোরাব। এ কারণে তাদের দুজনের সম্পর্কও খুব একটা ভালো ছিল না। এই বৈরী সম্পর্কের কারণেই শেষপর্যন্ত শাপুরজিকে পারিবারিক ব্যবসা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে ভূমিকা রেখেছিলেন দোরাব- বইতে এমনটাই লিখেছেন সেহরি।
১৮৯০-র দশকের শেষ দিকে বোম্বেতে ছড়িয়ে পড়া বিউবোনিক প্লেগ রোগের ভয়াবহতা শাপুরজির মনকে ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছিল। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়া এ রোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তের শিকার দরিদ্র ও সমাজের খেটে খাওয়া মানুষ তথা দিনমজুররা। অথচ তার পরিবারের মতো সমাজের উচ্চ শ্রেণি যারা রয়েছেন, তারা তুলনামূলকভাবে সুরক্ষিত ছিলেন।
শাপুরজি তখন কলেজ শিক্ষার্থী। সে সময় তিনি রুশ বিজ্ঞানী ওয়ালদিমার হাফকিনের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। বিপ্লবী চিন্তাধারা ও রাশিয়ার জারতন্ত্রের বিরোধিতার কারণে এই বিজ্ঞানী দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। হাফকিন এই মহামারি মোকাবিলায় একটি ভ্যাকসিন তৈরি করেছিলেন। শাপুরজি সেই ভ্যাকসিন নিতে উৎসাহিত করতে লোকেদের দুয়ারে দুয়ারে গিয়েছিলেন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটি শাপুরজির জীবনকে প্রভাবিত করেছিল, তা হলো সেলি মার্শের সঙ্গে তার সম্পর্ক। মার্শ ছিলেন একজন খাবার পরিবেশনকারী। ১৯০৭ সালে শাপুরজির সঙ্গে তার বিয়ে হয়।
মার্শরা ছিলেন ১২ ভাই-বোন। তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। অল্প বয়সে বাবাকে হারানোয় তাদের প্রত্যেকের জীবন অনেক কঠিন হয়ে ওঠে। তাই বেঁচে থাকার জন্য তখন থেকেই তাদের কঠোর সংগ্রাম শুরু হয়।
অন্যদিকে শাপুরজি ছিলেন ধনাঢ্য পরিবারের। তাই বেঁচে থাকার জন্য লড়াই-সংগ্রামের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তিনি পরিচিত ছিলেন না। মার্শের জীবনের মধ্য দিয়েই তিনি দেখতে পান, বেঁচে থাকার জন্য ব্রিটেনের শ্রমজীবী মানুষদের কতটা লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়।
সেহরি বইতে লিখেছেন, জেসুইট (সোসাইটি অব জেসুস) পুরোহিত ও সন্ন্যাসীদের নিঃস্বার্থ জীবনধারার বিষয়টিও তার বাবার জীবনকে প্রভাবিত করেছিল, যাদের অধীনে তিনি (শাপুরজি) স্কুল ও কলেজ জীবনে পড়াশোনা করেছিলেন।
১৯০৫ সালে যুক্তরাজ্যে যাওয়ার পর শাপুরজি দরিদ্র ও প্রান্তিক লোকেদের সাহায্যের ব্রত নিয়ে রাজনীতির পাতায় নাম লেখান। ১৯০৯ সালে তিনি লেবার পার্টিতে যোগ দেন। এর ১২ বছর পর যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে।
রাজনীতিতে আসার পর থেকেই ভারত ও ব্রিটেনের শ্রমিক শ্রেণির অধিকার নিয়ে অত্যন্ত সোচ্চার ছিলেন এই রাজনীতিক। তিনি বিশ্বাস করতেন, সাম্রাজ্যবাদী শাসন নয়, কেবল সমাজতন্ত্রই দারিদ্র্য দূর করতে পারে এবং শাসনকার্যে মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে।
শাপুরজির ভাষণে বহু মানুষ আকৃষ্ট হয়েছিলেন। দ্রুতই তিনি জনপ্রিয় মুখ হয়ে ওঠেন। ১৯২২ সালে তিনি সংসদে পার্লামেন্ট মেম্বার নির্বাচিত হন এবং প্রায় সাত বছর এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়টায় তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য জোরালোভাবে তৎপরতা চালিয়েছিলেন। তিনি এতটাই সোচ্চার ছিলেন যে পার্লামেন্টের ভারতীয় বংশোদ্ভূত একজন সদস্যই তাকে 'ভয়ংকর কট্টর কমিউনিস্ট'হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন।
এমপি থাকাকালে শাপুরজি ভারত সফর করেছিলেন। সফরকালে দেওয়া ভাষণে তিনি ভারতের শ্রমিক শ্রেণি ও তরুণ জাতীয়তাবাদীদের স্বাধীনতা আন্দোলনে সমর্থন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি ভারতের যেসব এলাকায় সফর করেছিলেন, সেসব এলাকায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়াকে সংগঠিত করতে কাজ করেছিলেন।
সমাজতন্ত্র নিয়ে শাপুরজির কট্টর মতাদর্শ প্রায়ই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধীর মতাদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠত।
এই দুই নেতা নিজেদের মধ্যে কখনও মতৈক্যে পৌঁছাতে না পারলেও তারা একে-অপরের প্রতি আন্তরিক ছিলেন এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে তথা ব্রিটিশ রাজকে উৎখাত করতে তারা ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। যেখানে মহাত্মা গান্ধী অহিংস পথে স্বাধীনতা অর্জনের পক্ষে ছিলেন।
ভারতে শাপুরজির দেওয়া জ্বালাময়ী সেই ভাষণ ব্রিটিশ কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ১৯২৭ সালে তার স্বদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। এরপর ১৯২৯ সালে এমপি পদ হারালেও তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই অব্যাহত রাখেন।
১৯৩৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শাপুরজি ব্রিটিশ রাজনীতি এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার মরদেহ সৎকারের পর দেহাবশেষ (ছাই) লন্ডনের একটি কবরস্থানে তার বাবা-মা ও জামসেতজি টাটার কবরের পাশে দাফন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন দূরে থাকলেও আবারও টাটা পরিবারের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন শাপুরজি।
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক