গ্রামের জন্য এক নেটফ্লিক্স: ভারতের স্টার্ট-আপগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রে গ্রাম
ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্য হরিয়ানার ছোট ছোট গ্রামগুলোতে আজকাল এক অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটেছে। বিশেষত শিল্প শহর রোহতকের আশেপাশের অঞ্চলের কৃষকদের বাড়িগুলো সিনেমার শুটিং লোকেশনে পরিণত হয়েছে। এই ঘটনার মূলে রয়েছে 'স্টেজ' নামে একটি স্টার্ট-আপ। স্টেজ এই অঞ্চলে এক নতুন চলচ্চিত্র শিল্পের সূচনা করেছে। খবর বিবিসির
স্টেজের প্রতিষ্ঠাতা বিনয় সিঙ্ঘল বিবিসিকে বলেন, 'আমরা আসার আগে ভারতের ইতিহাসে মাত্র এক ডজন হরিয়ানভি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। অন্যদিকে ২০১৯ সাল থেকে আমরা ২০০-র বেশি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছি।
স্টেজ মূলত গ্রামীণ এবং উপেক্ষিত শ্রেণীর দর্শকদের জন্য কনটেন্ট তৈরি করে। এসব কনটেন্টে তারা স্থানীয়দের রুচি, উপভাষা এবং সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোকে গুরুত্ব দেয়।
এই প্রতিষ্ঠানটির সাফল্যের গোপন রহস্য হলো ভারতের বিভিন্ন উপভাষার বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দেওয়া। ভারতের ১৯ হাজার ৫০০ উপভাষার মধ্যে স্টেজ ১৮টি উপভাষাকে লক্ষ্য করে কনেটেন্ট বানায়। তারা সেসব উপভাষার কনটেন্ট বানাচ্ছে, যেগুলোর যথেষ্ট জনসংখ্যা রয়েছে এবং নিজস্ব চলচ্চিত্র শিল্প [ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি] গড়ে তোলার যোগ্যতা আছে।
বর্তমানে স্টেজ হরিয়ানভি ও রাজস্থানি ভাষায় কনটেন্ট তৈরি করছে এবং এর তিন মিলিয়ন গ্রাহক রয়েছে। কোম্পানিটি অন্যান্য আঞ্চলিক উপভাষা; যেমন- মৈথিলি ও কঙ্কণিতেও কনটেন্ট তৈরির কথা ভাবছে, এই ভাষাগুলো ভারতের উত্তর-পূর্ব এবং উপকূলীয় অঞ্চলে প্রচলিত।
প্রতিষ্ঠানটি আমেরিকার একটি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম থেকে অর্থায়ন পাওয়ার কথা রয়েছে। এই অর্থায়ন পেলে এই উদ্যোগ সম্প্রসারণে সহায়তা হবে।
ভারতের বিশাল গ্রামীণ জনসংখ্যাকে টার্গেট করে ব্যবসা শুরু করা স্টার্ট-আপগুলোর মধ্যে স্টেজ একটি। অ্যাগ্রোস্টার ও দেহাত- এর মতো স্টার্ট-আপ এক্ষেত্রে বেশ সফলতা লাভ করেছে, প্রতিষ্ঠান দুটিই কৃষি সংক্রান্ত সেবা দিয়ে থাকে।
চিরাচরিতভাবে ভারতের প্রযুক্তি পরিষেবাগুলো মূলত শহুরে ভোক্তাদেরই টার্গেট করে পরিকল্পনা করা হয়ে থাকে। ফলে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন জনসংখ্যার দেশটির ৬ লাখ ৫০ হাজার গ্রামের বিশাল গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে উপেক্ষিতই রয়ে গেছে।
ফ্লিপকার্ট, সুইগি এবং আরবান কোম্পানির মতো বেশ কয়েকটি সফল উদ্যোগে অর্থায়ন করা বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান অ্যাক্সেল-এর অংশীদার আনন্দ ড্যানিয়েলের মতে, ভারতে কয়েক ডজন ইউনিকর্ন - বা প্রযুক্তি সংস্থা রয়েছে, যার মূল্য ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। তবে তারা সবাই মূলত শহুরে ভারতীয়দের 'শীর্ষ ১০%' এর জন্য বিভিন্ন পরিষেবা তৈরি করেছে।
অনলাইন মার্কেটপ্লেস মিশো বা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ভারতের স্টার্ট-আপ বুম মূলত গ্রামগুলোকে উপেক্ষা করেছে।
মি. সিঙ্ঘল বলেন, এখন এই ধারা বদলাচ্ছে, কারণ বিনিয়োগকারীদের মনোভাবে অনেক পরিবর্তন হচ্ছে। অ্যাক্সেল- এর মতো সংস্থাগুলো গ্রামীণ স্টার্ট-আপগুলোতে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে।
ইউনিকর্ন ইন্ডিয়া ভেঞ্চারস জানিয়েছে, তাদের অর্ধেক বিনিয়োগ টিয়ার ২ এবং টিয়ার ৩ শহরগুলোতে লক্ষ্য করে করা।
এছাড়া, গ্রামীণ বাজারের স্টার্ট-আপগুলোর উদ্দেশ্যে সুজুকি একটি বড় তহবিল ঘোষণা করেছে।
এই পরিবর্তন বিনিয়োগ কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এর বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।
যেমন- ভারতের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ গ্রাম এলাকায় বসবাস করে, তাই গ্রামীণ বাজার একটি উল্লেখযোগ্য ব্যবসাক্ষেত্র। মোট মিলিয়ে প্রতি বছর এখানে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হয়।
আশ্চর্যের বিষয়, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর শীর্ষ ২০%, শহরের অর্ধেক বাসিন্দাদের চেয়ে বেশি ব্যয় করে। এতে বোঝা যায়, গ্রামীণ ভোক্তারাও বেশ ভালো ব্যবসায়িক লক্ষ্য হতে পারে।
ড্যানিয়েল বলেন, 'ভারতের জিডিপি আগামী এক দশকে ৪ ট্রিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পাবে বলে প্রত্যাশা করা হয়। এর অন্তত ৫ শতাংশ ডিজিটালাইজেশনের কল্যাণে আসবে এবং তা আসবে গ্রামগুলো থেকে। অর্থাৎ, গ্রাম থেকে ২০০ বিলিয়ন ডলার আয়ের সুযোগ রয়েছে।
এছাড়া, গ্রামের মধ্যম আয়ের পরিবারগুলোর মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহারের প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে।
স্মার্টফোন এই পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, গ্রামের প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন মানুষ এখন স্মার্টফোন ব্যবহার করছে।
ইউপিআই-এর মতো ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমগুলোর ফলে লেনদেন সহজ হয়েছে। এগুলো কোম্পানিগুলোকে গ্রামীণ ভোক্তাদের কাছে পৌঁছাতে সহায়তা করছে।
আগে যেসব প্রতিবন্ধকতা ছিল যেমন- লজিস্টিকস এবং পেমেন্ট সিস্টেম সংক্রান্ত জটিলতা প্রভৃতি অনেক কমে যাওয়ায়, গ্রামে উদ্যোক্তা তৈরির সম্ভাবনাও বাড়ছে।
এছাড়াও, ছোট শহরগুলোতে নতুন উদ্যোক্তার ঢেউ উঠছে। কম উৎপাদন খরচ এবং গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের জন্য পরিচালিত সরকারি বিভিন্ন সহায়তায় এরা উঠে আসছে।
এসব উদ্যোক্তাদের সাধারণত স্থানীয় বাজার সম্পর্কে গভীর ধারণা থাকে, যা ব্যবসা পরিচালনায় বিশেষ কাজে লাগে।
তবে ভারতের গ্রামীণ পরিবেশে ব্যবসা বিস্তারে নানা চ্যালেঞ্জেরও সম্মুখীনও হতে হয়। যেমন- গ্রামীণ ভোক্তারা মূল্য-সচেতন এবং তারা বেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে, যার ফলে কোম্পানিগুলোর জন্য একটি স্থিতিশীল বাজার প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে যায়।
এছাড়া, এখনও অবকাঠামোগত বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, যার ফলে পণ্য ডেলিভারি প্রক্রিয়ায় জটিলতা সৃষ্টি হয় এবং ব্যবসা পরিচালনার খরচ বাড়ে।
তাই স্টার্ট-আপগুলোকে তাদের কৌশলগুলোকে গ্রামের প্রেক্ষাপটের উপযোগী করতে হবে। কারণ প্রথাগত শহুরে ব্যবসায়িক মডেলগুলো গ্রামে কার্যকর নাও হতে পারে।
তাছাড়া, টার্গেট জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিশ্বাস গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে, বিশেষ করে নারীদের সঙ্গে অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা; বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন এবং ব্যবসা সম্প্রসারণে খুবই কার্যকর উপায় বলে প্রমাণিত হয়েছে।
মোটের উপর, ভারতের গ্রামাঞ্চলে প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও, সাফল্য একটি সূক্ষ্ম কৌশলের ওপর নির্ভর করবে, তা হলো স্থানীয় চাহিদা এবং প্রেক্ষাপটকে উপলব্ধি করা। শুধুমাত্র তাহলেই সম্ভাব্য ২০০ বিলিয়ন ডলারের বাজারটিকে কার্যকরভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি