জুলাই বিপ্লবের ‘স্ট্যালিনগ্রাদ’ যাত্রাবাড়ী, তৈরি হলো স্মৃতিস্তম্ভ
১৭ জুলাই। কোটা সংস্কারের দাবি ততদিনে রূপ নিয়েছে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে। শিক্ষার্থীদের সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ। সারাদেশে চলছে পুলিশি হামলা, সর্বত্র ধরপাকড়। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দাপটে যখন অনেকটাই স্তিমিত আন্দোলন, সেই সময় খবরের শিরনামে উঠে আসে একটি এলাকার নাম। যে এলাকার প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষ শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে নেমে আসে রাস্তায়। অসীম সাহসের সঙ্গে লড়াই করে যায় স্বৈরাচার পতনের শেষ দিন পর্যন্ত।
বলছি, যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া এলাকার কথা। আন্দোলনের পুরোটা সময় বুকচিতিয়ে লড়াই করেছিলেন এখানকার মানুষ। জুলাই বিপ্লব শেষ হওয়ার আড়াই মাস পর অবশেষে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হলো একটি সম্মিলিত স্মৃতিস্তম্ভ। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া বীরেরা সামান্য হলেও পেলেন স্বীকৃতি। গত ২১ অক্টোবর শহীদ পরিবারের সদস্যরা অশ্রুসিক্ত নয়নে উদ্বোধন করেন এ স্মৃতিস্তম্ভ। 'জুলাই বিপ্লব পরিষদ' নামে একটি সংগঠন এর প্রতিষ্ঠাতা।
যাত্রাবাড়ী ও এর আশেপাশের এলাকায় জুলাই বিপ্লবে প্রাণ উৎসর্গ করা মোট ৪৮ জনের নাম স্থান পেয়েছে এই স্মৃতিস্তম্ভে। 'জুলাই বিপ্লব পরিষদ' এর পক্ষ থেকে যাত্রাবাড়ী মোড়ে এই চত্বরের নামকরণ করা হয়েছে 'শহীদী ঐক্য চত্বর'।
ধবধবে সাদা ফলকে নিহত ব্যক্তির নাম, তাদের পেশা, জন্ম ও মৃত্যু তারিখ যুক্ত করেছেন তারা। শিক্ষার্থী ছাড়াও প্রবাসী, চাকরিজীবী, সাংবাদিক, দিনমজুর থেকে শুরু করে দোকানদার, বাবুর্চি, দর্জি, এমনকি রিকশাচালকও রয়েছেন শহীদদের তালিকায়। আছেন গার্মেন্টস শ্রমিক, ভ্যান চালক এবং ফ্রিল্যান্সার। ২০০৯ সালে জন্ম নেওয়া শিক্ষার্থী আশরাফুল অন্তরের নাম যেমন রয়েছে, তেমনি আছে ভ্যানচালক জাহাঙ্গীরের নাম, যার জন্ম ১৯৮০ সালে। সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের আত্মত্যাগের কথাই যেন মনে করিয়ে দেয় এই স্মৃতি ফলক।
শহীদী স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধনের পর এর ছবি ফেসবুকে শেয়ার করেছেন অনেকে। তাদের কেউ কেউ যাত্রাবাড়ীকে আখ্যায়িত করেছেন 'স্ট্যালিনগ্রাদ' বলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্ট্যালিনগ্রাদে জার্মানি-রাশিয়ার যুদ্ধ যেমন পুরো ইতিহাস বদলে দিয়েছিল, জুলাই অভ্যুত্থানে যাত্রাবাড়ীর সেই ভূমিকার কথাই তুলে ধরেছেন তারা।
স্ট্যালিনগ্রাদের যুদ্ধ মানবসভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এ যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। এ যুদ্ধই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভাগ্য অনেকটাই ঠিক করে দিয়েছিলো। জুলাই অভ্যুত্থানে যাত্রাবাড়ীর আন্দোলনকে অনেকে তাই তুলনা করছেন 'স্ট্যালিগ্রাদ'-এর সঙ্গে।
জুলাই বিপ্লব পরিষদের স্থায়ী সদস্য শাহনেওয়াজ ফাহাদ জানালেন স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের নেপথ্য কাহিনী। বললেন, "সারা দেশে যখন আন্দোলন বন্ধ হয়ে গেল, তখন এই যাত্রাবাড়ীর সাধারণ মানুষ জন, ছাত্র-জনতা, তারা কিন্তু রাজপথ ছাড়েনি। এই জায়গায় পুলিশ প্রচুর হামলা করেছে, মানুষ শহীদ হয়েছে, কিন্তু আন্দোলন দমন করতে পারেনি।"
এসব শহীদদের আত্মত্যাগের কথা আগামী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে কিছু করার কথা ভাবছিলেন তারা। অবশেষে এই উদ্যোগ।
বললেন, "শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে শহীদদের তালিকা জমা দেওয়ার জন্য আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। তখন ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, রায়েরবাগ, শনির আখড়া-সহ এই অঞ্চলে আমরা মোট ৫৮ জন শহীদের তথ্য পাই। তাদের মধ্যে থেকে ৪৮ জনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে আমরা সত্যতা পেয়েছি। এদেরই নাম ফলকে যুক্ত করেছি আমরা।"
ফাহাদ জানালেন, খোঁজ এখনও অব্যাহত রয়েছে। হেল্প ডেস্কে আরও প্রায় ১৫ জন শহীদের তথ্য পেয়েছেন তারা। সেগুলো যাচাই করে এই স্মৃতিস্তম্ভে নাম যুক্ত করা হবে।
"আমাদের এই স্তম্ভে আরও ১৬টি নাম যুক্ত করা যাবে। যদি আরও শহীদদের সন্ধান পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে আমরা স্মৃতিস্তম্ভ বর্ধিত করবো।"
তিনি আরও জানালেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সাধারণ মানুষের প্রসংশায় ভাসছেন তারা। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ইতিবাচকভাবে দেখছেন এই স্মৃতিস্তম্ভকে। বললেন, আর কিছু না হোক, শহীদদের পরিবারের মানুষের মনে একটু সান্ত্বনার বাণী পৌঁছে দিতে পেরেছেন, এটিই তাদের বড় পাওয়া।
"শহীদ পরিবারের এক সদস্য বলেছেন, যা ক্ষতি হয়েছে তা তো পূরণ করার নয়, তবে যাওয়া-আসার সময় এই স্মৃতিস্তম্ভ দেখে অন্তত এটুকু মনে হবে যে, আমার সন্তান দেশের জন্য কিছু করেছে," বললেন ফাহাদ।
শহীদ ঐক্য চত্বরের অদূরেই এক চায়ের দোকান। সেখানে কথা হলো কয়েকজনের সঙ্গে। সকলেই এক মত, দারুণ একটি কাজ হয়েছে।
"যারা যারা আন্দোলনে জীবন দিয়েছে, তাদের সবার নাম দিয়ে যদি জায়গায় জায়গায় এই জিনিস করা যেতো, তাহলে ভালো হতো," বললেন যাত্রাবাড়ীর এক মাদ্রাসা শিক্ষক আবুল কাশেম।
তার মতে, নিহতদের স্মরণ করার মাধ্যমে কিছুটা হলেও তাদের আত্মত্যাগকে সম্মান জানানো হবে।
স্মৃতি ফলকটি নির্মাণ করতে প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ টাকার মত খরচ হয়েছে, যার পুরোটায় বহন করেছে এই সংগঠনের সদস্যরা। কোনো রাজনৈতিক দল বা বাইরের কারো সাহায্য তারা গ্রহণ করেননি বলে জানালেন তারা।
জুলাই বিপ্লব পরিষদ সংগঠনটির প্রতিটি সদস্যই অংশ নিয়েছিলেন স্বৈরাচার বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলতে, জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে অক্ষুণ্ণ রাখতেই 'জুলাই বিপ্লব পরিষদ' এর জন্ম, জানালেন সংগঠনটির সদস্য সচিব মোহম্মদ আরিফুল ইসলাম রাতুল।
তারা কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের সাথে জড়িত নন, সামনে জড়িত হতেও চান না। তবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে তাদের মনে।
"আমাদের ৭ দফা দাবি ছিল, যার প্রথমটি হলো রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ। ফ্যাসিস্টের চিহ্ন রেখে বিপ্লব হয় না। আমরা মনে করি, দেশের এখন যে সংস্কার হচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ করার অধিকার রয়েছে। শহীদদের তালিকায় দেখেন— দোকানদার, ব্যবসায়ী, বাবুর্চি, রিকশাচালক, সবাই আছে, তাহলে আপনি যে সংবিধান সংস্কারের আলাপ করছেন, এদের কাছে কিছু জানতে চেয়েছেন? জানতে চেয়েছেন তারা দেশটাকে কীভাবে চান? এই আলাপটাকেই আমরা সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র বা আর সি মজুমদার হল থেকে যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, রায়েরবাগে আনতে চাই। এটার জন্য স্মৃতিফলক করা," বললেন ফাহাদ।
তিনি আরও জানালেন, এ ধরনের সম্মিলিত স্মৃতিফলক তারাই প্রথম নির্মাণ করলেন। "বুদ্ধিবৃত্তিক, তাত্ত্বিক, এত আলাপ আলোচনা হলো, আড়াই মাসে বাংলাদেশের কোথাও সম্মিলিত স্মৃতিফলক হয়নি। তাহলে দেখা গেলো আমরা চাষাভুষা, অশিক্ষিত মিডিল ক্লাস মানুষেরা দেখিয়ে দিয়েছি।"
ভবিষ্যতে এ ধরনের স্মৃতিফলক নির্মাণ-সহ শহীদের স্মৃতি টিকিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার, তা করবেন বলে জানালেন সংগঠনের সদস্যরা।
"বাংলাদেশের অভ্যুত্থান হয়েছে, বিপ্লব হয়নি; আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে অভ্যুত্থানকে বিপ্লবে পরিণত করা। এজন্য আমাদের ৭ দফা রয়েছে। এগুলো যেন অবশ্যই বাস্তবায়ন হয়," বললেন সদস্য সচিব আরিফুল ইসলাম রাতুল।