৩৫ জুলাই: শহীদদের লাশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল
ইসমাইল হোসেন রাব্বির গোলগাল চেহারা; চিবুকের নিচের দিক কিছুটা সরু। সাথে রয়েছে এলোমেলো চুল, অল্প কিছু দাড়ি ও গভীর দুই চোখ। তিনি যেন গতানুগতিক বাংলাদেশি কিশোরদের মূর্ত প্রতীক।
কিন্তু রাব্বির দুই চোখই চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। সম্ভবত দূর থেকে ছোড়া একটি ৭.৬২x৩৯ মিমি বুলেট তার কপালের মাঝখান বরাবর বিদ্ধ হয়েছে। বুলেটটি তার খুলির পিছনের অংশ ছিন্নভিন্ন করে বের হয়ে যায়। তার মুখে ছড়িয়ে থাকা তাজা রক্ত জমাট বেঁধে শুকিয়ে যাচ্ছিল।
সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ মিনারে তার মরদেহ ঘিরে ছিল শত শত বিক্ষোভকারী। তাদের স্লোগানে ছিল, 'আমরা আমাদের ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না'। এদিকে বেদিতে রাখা হয় আরো লাশ।
বিক্ষোভকারীর সংখ্যা কয়েকশ থেকে বেড়ে কয়েক হাজারে পরিণত হয়। এ সময় শেখ হাসিনা সরকারের অনুগত বাহিনীর হাতে নিহত চারজনের চারপাশে মানুষ জড়ো হওয়ার সাথে সাথে সমগ্র এলাকা চিৎকার ও ক্ষোভে স্পন্দিত হতে থাকে।
ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটি ছিল ৩৫ জুলাই, অর্থাৎ, ৪ আগস্ট। এর একদিন আগেই হাসিনা সরকারের পতনের দাবিতে এক দফা ঘোষণা করা হয়েছিল। আর পরের দিন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান।
সেদিন হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ও দেশের অন্যান্য প্রান্তে রাস্তায় নেমেছিল। দিনটি জুলাই বিদ্রোহের সবচেয়ে সহিংস দিনগুলির একটি।
সেদিন সারা দেশে ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে, বিকেলে শহিদ মিনারে বিক্ষোভকারীরা চারজন মৃত সহযোদ্ধার লাশের সামনে অশ্রুসিক্ত চোখে স্লোগান দিচ্ছিল 'হাসিনার ফাঁসি চাই'। জুলাই বিদ্রোহের সময় সম্ভবত এটিই ছিল জনসম্মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বিচারের প্রথম দাবি।
ঐতিহাসিক মিছিল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা ও ৪ আগস্ট শহিদ মিনারে বিক্ষোভে নেতৃত্বদানকারী আবু তৈয়ব হাবিলদার বলেন, "তখন শহিদ মিনারে আমরা সবাই অপরিচিত। আমরা কেউই জানতাম না যে, বেদিতে রাখা শহীদেরা কারা। কিন্তু তবুও আমরা এমনভাবে চিৎকার করেছিলাম যেন আমাদের নিজের ভাইকে হত্যা করা হয়েছে।"
হাবিলদার আরও বলেন, "আমি সেখানে মরদেহগুলো তত্ত্বাবধান করছিলাম। যখন আমি তাদের জন্য জোরে জোরে দোয়া করতে লাগলাম, তখন সবাই এতে যোগ দিল। লোকেরা এমনভাবে কাঁদছিল যেমনটা তারা আগে কখনও কাঁদেননি। সেই মোনাজাতে আমরা শেখ হাসিনার পতন কামনা করি।"
"সেদিন আমি লোকদের তীব্র হাহাকার ও বিলাপ দেখেছিলাম। কিন্তু আমি তাদের ভেতরের শক্তিও দেখেছিলাম", যোগ করেন তিনি।
প্রার্থনা শেষ হতে হতে কয়েক হাজার মানুষ শহিদ মিনারে জড়ো হয়। বিকেলও গড়িয়ে যায়। হাবিলদার শহিদদের মরদেহ নিয়ে গণভবনের দিকে পদযাত্রার ঘোষণা দেন।
সেই মুহূর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। আন্দোলনকারীরা ঘাম, রক্ত ও অশ্রুতে ভিজে শহিদদের কাঁধে তুলে নিয়ে নির্ভয়ে শেখ হাসিনার বিচারের দাবিতে স্লোগান দেয়।
সেদিনই এই ঘটনার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, 'শেখ হাসিনার ফাঁসি চাই' এবং 'আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না' বলে স্লোগান দিয়ে শহিদদের নিয়ে যাচ্ছেন।
ভিড়ের মানুষগুলো ছিল বেশ বৈচিত্র্যময়। এদের মধ্যে কেউ বয়স্ক, কেউ স্কুল ইউনিফর্ম পরা আবার কেউবা নারী কিংবা দাড়িওয়ালা ইত্যাদি।
মিছিলের সামনে হাবিলদারকে খয়েরি টি-শার্ট পরা অবস্থায় দেখা যায়। তিনি বলেন, "সন্ধ্যায় আমরা টিএসসি হয়ে শাহবাগে পৌঁছাই। এরপরই শাহবাগ থানা থেকে পুলিশ আমাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে।"
"গুলি চালানোর প্রবণতা দেখে আমার মনে হয় যে, তখন আরও বেশি লোক নিহত হয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যায় শাহবাগে মানুষকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছি", যোগ করেন তিনি।
মিছিল ছত্রভঙ্গ; লাশ নিয়ে যায় পুলিশ
মিছিলের ভাইরাল ক্লিপটি দেশের মানুষকে আন্দোলিত ও উজ্জীবিত করেছিল। যারা আগে থেকেই ক্ষুব্ধ ছিল।
'বুয়েটিয়ান' নামে ফেসবুক পেজে শেয়ারকৃত ভাইরাল ঐ ভিডিওতে একজন কমেন্ট করেন, "আমরা ইতিহাসের বইয়ে আসাদের রক্তমাখা শার্টের কথা পড়েছি। এখন আমরা (একই ইতিহাসের) সাক্ষী হচ্ছি।
চার শহিদের মরদেহ নিয়ে সমাবেশের ঐ ক্লিপটি দেখতে একইসাথে ভয়ংকর ও অনুপ্রেরণাদায়ক ছিল; এমন অনুভূতি অনেকেই আমাদের কাছে প্রকাশ করেছেন। একইসাথে এটি একজন স্বৈরশাসককে পতনের জন্য জনগণের ভেতর দৃঢ় সংকল্প তৈরিতেও কাজ করেছে বলে তারা মনে করেন।
গণ অধিকার পরিষদের নেতা এসকে রাশেদ সেদিনের বিক্ষোভে ছিলেন। তিনি বলেন, "পুরুষ, মহিলা, শিশু... এটি এমন একটি মিছিল ছিল যেখানে সবাই একত্রিত হয়েছিল। ক্ষোভে তারা গণভবনের দিকে যাত্রা করেছিল সেক্ষেত্রে পথে যা-ই ঘটুক না কেন।
"কিন্তু শাহবাগ থানা থেকে গুলি বর্ষণের মুখে সেটি করা সম্ভব হয়নি", যোগ করেন তিনি।
তাই মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। হাবিলদার ও রাশেদ তখন বারডেম হাসপাতালে আশ্রয় নেন। সেখানে একজন সিকিউরিটি অফিসার তাদের পুলিশ ও গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) হাত থেকে রক্ষা করেন।
রাশেদ বলেন, "আমি ওপরে গিয়ে দেখি শাহবাগ চত্বর থেকে পুলিশ শহিদদের লাশ নিয়ে যাচ্ছে। আমি এটি ভিডিও করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু অন্ধকার ছিল এবং পুলিশ তখনও নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছিল। পুরো ঘটনাটি রেকর্ড করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।"
হাবিলদার আমাদের জানান, পুলিশ সারারাত সব লাশ শহিদ মিনারে ফেলে রেখেছিল।
শহিদেরা কারা ছিলেন?
সেদিন শহিদ মিনারের বেদিতে হাবিলদার একজন শহিদের পরিচয় শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন নাজমুল নামের এক রিকশাচালক।
হাবিলদার বলেন, "তিনি বিপ্লবী গান গাইতেন। প্রেসক্লাবের আশেপাশের লোকজন তাকে চিনতো।"
হাবিলদার আমাদের একটি ইউটিউব চ্যানেলে নাজমুলের গান গাওয়ার একটি ভিডিও দেখান। সেখানে একটি মেট্রো স্টেশনের নীচে তিনি বসেছিলেন। গানটি ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্রমবর্ধমান দাম কীভাবে মানুষকে সমস্যায় জর্জরিত করছে সেটি নিয়ে।
হাবিলদার বলেন, "আমরা তার দেহে কী হয়েছিল তা খুঁজছিলাম। কিন্তু কিছুই শনাক্ত করতে পারিনি।" তবে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি যে, সেদিন চার শহিদের মধ্যে নাজমুল ছিলেন কি-না।
হাবিলদার কয়েকদিন পর বড় বোন মিম ও মিতুর সঙ্গে দেখা না হওয়া পর্যন্ত ইসমাইল হোসেন রাব্বিকেও শনাক্ত করতে পারেননি। তার বোনেরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে মরদেহ খুঁজে পান এবং মিছিলের ভিডিও থেকে রাব্বিকে শনাক্ত করেন।
হাবিলদার বলেন, "শহিদ রাব্বি ছাড়া বাকি লাশগুলোর কী হয়েছে তা আমরা জানতে পারিনি। আমরা বহু অফিসে অন্য তিনটি লাশের দাফনের স্থান খুঁজছিলাম। কিন্তু তারা আমাদের কোনো তথ্য দেয়নি।"
ভাইয়ের লাশ নিয়ে দুই বোনের মিছিল
৪ আগস্ট মিম ও তার পরিবার তার ভাই ইসমাইল হোসেন রাব্বিকে বাড়িতে তালাবদ্ধ করে রাখেন। ছেলেটির বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর ৮ মাস। কিন্তু শুরু থেকেই তিনি সক্রিয়ভাবে জুলাই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে আসছিলেন।
রাব্বির পরিবার তাকে শরীয়তপুর থেকে সায়েদাবাদে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। তিনি একজন পলিটেকনিকের ছাত্র ছিলেন। তার পরিবার বুঝতে পেরেছিলেন যে, সেখানে (শরিয়তপুড়ে) তার প্রতিবাদী কর্মকাণ্ড তাকে অনেক বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।
মিম বলেন, "কিন্তু ঢাকাতেও ও আমাদের অমান্য করেছেন। ও প্রতিটি বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিল এবং বেশ কয়েকদিন আহত হয়ে ফিরে এসেছিল। এ কারণে ৪ আগস্ট আমরা বাইরে যাওয়ার সময় ওকে তালাবদ্ধ করে রেখেছিলাম।"
তবে রাব্বি সেই বাধাও অতিক্রম করে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। এক প্রতিবেশী তাকে শেষ দেখেছিল গুলিস্তানে; দুপুরের দিকে শাহবাগের দিকে যাচ্ছে। পরদিন তাকে পরিবারটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে খুঁজে পায়।
মিম বলেন, "তারা ওকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করেছে। নাহলে গুলিটি ওর কপালের ঠিক মাঝখানে কীভাবে বিঁধতে পারে?"
রাব্বির কপালে যে বুলেট লেগেছিল তার ধরণ নিয়ে আলোচনা করতে আমরা সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে পরামর্শ করেছি। সেক্ষেত্রে তারা জানায়, নিশ্চিতভাবে বলার জন্য একটি ফরেনসিক পরীক্ষা প্রয়োজন। তবে তারা এটিকে ৭.৬২x৩৯ মিমি বুলেট হিসাবে চিহ্নিত করেছে। একজন বিশেষজ্ঞ ক্ষতের প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে বলেছেন, "সম্ভবত ৭০ থেকে ১০০ মিটার দূর থেকে গুলি করা হয়েছিল।"
৫ আগস্ট মিম ও তার পরিবার যতক্ষণে রাব্বির মরদেহ পেয়েছে ততক্ষণে শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে চলে গেছে। এক্ষেত্রে মিম অভিযোগ করেন, পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতা করা হয়নি।
পরিবারকে বলা হয়েছিল যে, কাগজপত্রের কাজ শেষ করতে যেখানে তাকে গুলি করা হয়েছিল সেখান থেকে পুলিশ নিয়ে আসতে। যা সেদিন স্পষ্টতই অসম্ভব ছিল।
তবে বিকেলে কয়েকজন শিক্ষার্থী মর্গে ঢুকে রাব্বির মরদেহ উদ্ধার করে। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ডেথ সার্টিফিকেট না পাওয়ায় শহিদ রাব্বি এখনো শহিদের সরকারি রেকর্ডে তালিকাভুক্ত হয়নি। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন।
মিম ও মিতু তাদের ভাইয়ের মরদেহ পাওয়ার পর শোকে ও ক্ষোভে সেটি নিয়ে মিছিল করতে থাকেন। তখন জোরে জোরে বলতে থাকেন, "আমরা শেখ হাসিনার বিচার চাই।"