সেগুনি-বেগুনি
মনে আমার অনেক কষ্ট। সেই সব কষ্ট কোনো মানুষের জন্য নয়। সেই কষ্ট প্রিয় ভুবন চিল অ্যালবার্টের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার, সেই কষ্ট প্রিয় ঘোড়া লালুকে হারানোর, সেই কষ্ট ছোট্ট কুকুরছানা টিল টিলের নির্মম মৃত্যুর, সেই কষ্ট আদরের বন বিড়াল এলসাকে হারানোর। মানুষের চাইতে ওদের সঙ্গে অধিকতর প্রগাঢ় ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল আমার। ওদের অনেকের জন্যই চোখের জল ঝরেছে আমার। তবে তবে ভীষণ কেঁদেছিলাম বেগুনির মৃত্যু আর সেগুনির শেষ বিদায়ে। সেই ছোট্টকালে এদের গ্রামীণ জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে এনেছিলাম পোষার জন্য। তবে বন্যপ্রাণীদের সম্বন্ধে তখন সম্যক জ্ঞান ছিল না। এভাবে ওদের পোষ মানানোর চেষ্টা অনুচিত, প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ। যাক সে কথা। ভালোবাসা আর আদরে ওরা আমার একেবারে আপনজন হয়ে উঠেছিল।
ওদের আমি কখনো খাঁচায় বন্দী রাখিনি। থাকত আমার ঘরেই খাটের নিচে। ওরা নকুল, নেউল কিংবা বেজি, কিন্তু ছিল আমার সন্তানের মতো। ওদের কখনো মাংস খেতে দিতাম, কখনো মাছ। মাঝেমধ্যে ঢোঁড়া সাপ ধরে এনে ওদের সামনে ছেড়ে দিতাম। তখন সে কী লড়াই! ওদের আমি নানাভাবে পর্যবেক্ষণ করতাম। যেদিন ওরা মাংস খেত, সেদিন ওদের পটি থাকত স্বাভাবিক, কিন্তু মাছ খাওয়ার পর তীব্র দুর্গন্ধ দেখা দিত। আর ওরা সব সময় পায়খানা করার পর নিজের পশ্চাৎদেশ মাটিতে ঘষে পরিষ্কার করত এক বিশেষ কায়দায়, যাতে ওখানে ময়লা লেগে না থাকে।
বেগুনির রং ছিল ধূসর, সে খুব দ্রুত বড় হয়ে উঠছিল, স্বভাব ছিল ভীষণ হিংস্র। একবার মুখের কাছে নিয়ে আদর করার সময় সোজা কামড় দিয়েছিল আমার নাকে। সেগুনি নামের কালো বেজিটা, স্বভাবে ছিল ভীষণ শান্ত, ধূসর বেজিদের তুলনায় তারা এতটা বড় হয় না। সেগুনিকে তাই আমি অপেক্ষাকৃত বেশি আদর করতাম।
সমস্যা দেখা দিল ওরা কিছুটা বড় হয়ে ওঠার পর। বেজি শিকারি প্রাণী, রক্তে তার শিকারের নেশা। তাই কোথাও মোরগ-মুরগি দেখলেই আক্রমণ করে বসত। আস্তে আস্তে সেই আক্রমণ বাড়ি ছাড়িয়ে অন্যান্য জায়গায়ও বিস্তার করল। আমি খুব বেসামাল অবস্থায় পড়ে গেলাম। কী করি এদের নিয়ে? এদিকে একের পর এক মুরগি হারানো মানুষের নালিশ আসতে লাগল। অবশেষে এক রাতে আমি ওদের একটা চটের বস্তায় ভরে বাড়ি থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে একটা স্কুলের পেছনের জঙ্গলে নিয়ে ছেড়ে দিলাম। থাক, বন্যেরা বনেই থাক। কিন্তু রাতের বেলা বাড়ি ফিরে এসে আর ঘুম আসছিল না। অনেক দিনের মায়া বলে কথা।
সকালে ঘুম ভাঙল খাটের নিচের বিশেষ শব্দে। আমি একই সঙ্গে শিহরিত আর পুলকিত হয়ে উঠলাম। আশ্চর্য ব্যাপার, ভোর না হওয়ার আগেই সে কোন সেগুনি আর বেগুনি দেড় মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আবার বাড়িতে ফিরে এসেছে, ঠিক আমার কাছে। কী প্রগাঢ় ভালোবাসার বন্ধন!
ওরা আবারও বাড়িতে বড় হয়ে উঠতে লাগল। সেই সঙ্গে চলল, মাঝেমধ্যে মুরগিনিধন। এরা এদিক-সেদিক চলে যেত, আবার বাড়িতে ফিরে আসত; একদিন সন্ধ্যায় বেগুনি আর ফিরে এল না। পরদিন ভোরে সঙ্গী জাকিরকে নিয়ে খুঁজতে বেরিয়ে কিছুক্ষণ পরই বেগুনির মৃতদেহ পেলাম বাড়ি থেকে একটু দূরে। কেউ ওর মাথাটা থেতলে দিয়েছে। কী ভীষণ কান্নাটাই না সেদিন কেঁদেছিলাম, তখন আমি ইন্টারমিডিয়েটের প্রথম বর্ষের ছাত্র। অথচ কেঁদেছিলাম শিশুর মতো। বুঝলাম, সেগুনিকে বাঁচাতে হলে নদীর ওপারের গজারিবনে নিয়ে ছেড়ে দিতে হবে। কারণ, খাঁচাবন্দী হয়ে সে বাঁচতে পারবে না। ওভাবে বাঁচতে শেখাইনি আমি ওদের।
কিছুক্ষণ পর সেগুনি কোথা থেকে যেন আমাদের কাছে এসে হাজির হলো? তার পেটটা ভীষণ ফোলা। অর্থাৎ কারও মুরগি সাবাড় করে এসেছে। তাকে তখনই ধরে একটা খাঁচায় ভরে ফেললাম। তারপর তুলে দিলাম জাকিরের হাতে, যা করবে তা আগেই বলে দিয়েছিলাম।
আমি নদীর পাড়ে বসে তাকিয়ে ছিলাম। জাকির সেগুনিকে খাঁচায় করে নদী পার হচ্ছিল। আমার বারবার মনে হচ্ছিল—নৌকার মধ্যে আমার কলজেটা রয়েছে।