মার্কেসকে অনুপ্রাণিত করা বিখ্যাত মেক্সিকান উপন্যাস ‘পেদ্রো পারামো’ পর্দায় আনল নেটফ্লিক্স
'আমি কোমালায় এসেছি, কারণ শুনেছিলাম আমার বাবা, জনৈক পেদ্রো পারামো, এখানে থাকতেন।'
মেক্সিকোর প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হুয়ান রুলফোর 'পেদ্রো পারামো' উপন্যাসের এ প্রথম লাইনটি অনেক মেক্সিকানদের মুখস্থ। এবার তারা এ ঐতিহাসিক বাক্যটি শুনতে পাবেন নেটফ্লিক্সে — প্রায় ৫০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো এ উপন্যাসটির সিনেমা সংস্করণ মুক্তি পাচ্ছে প্ল্যাটফর্মটিতে।
বলা হয়, এ উপন্যাসই গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসকে তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউড' লেখার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
মেক্সিকান লেখিকা আলমা দেলিয়া মুরিলো এ নতুন সিনেমার এক উচ্ছ্বসিত পর্যালোচনায় লিখেছেন, 'মেক্সিকো, যেখানে মৃত্যু প্রতিনিয়ত বর্ণিত হয় এবং কখনও নির্মম, কখনও কবিতার মতো হয়ে ওঠে, সেই দেশের জন্য পেদ্রো পারামোর চেয়ে শক্তিশালী রূপক আর নেই।'
পেদ্রো পারামোর গল্প শত বছরেরও বেশি সময় আগে মেক্সিকোর বিপ্লব-পরবর্তী সময়ের পটভূমিতে আবর্তিত। উপন্যাসের প্রথম বাক্যগুলোতে দেখা যায়, হুয়ান প্রিসিয়াদো তার মৃত মায়ের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করতে কোমালা নামক এক শহরে পৌঁছান। তার উদ্দেশ্য ছিল নিজের পিতার কাছে থেকে তার প্রাপ্য অর্থ দাবি করা, যিনি ওই শহরের একসময়ের শক্তিশালী সামন্ত প্রভু ছিলেন।
তবে পথিমধ্যে প্রিসিয়াদোর এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়। তিনি জানান, পেদ্রো পারামো বহু আগেই মারা গেছেন এবং কোমালা শহর এখন একেবারে পরিত্যক্ত। পরে জানা যায়, ওই ব্যক্তিও পারামোর পুত্র। প্রিসিয়াদো তখন জানতে চান, পারামো আসলে কেমন মানুষ ছিলেন। উত্তরে ওই ব্যক্তি ধীরে ধীরে বলেন, 'রেনকর ভিভো' — অর্থাৎ, 'জীবন্ত পিত্ত'।
প্রিসিয়াদো যখন কোমালায় প্রবেশ করেন, তখন তিনি যেন এক ভুতুড়ে জগতে পা রাখছেন। এরপর গল্পটি শুধু প্রিসিয়াদোর মাধ্যমে নয়, বরং এক ভৌতিক কোরাসে বর্ণিত হতে থাকে, যেখানে বর্তমান-অতীত, জীবিত-মৃতদের মধ্যে বিভেদ প্রায় অবলুপ্ত।
মাত্র ১০০ পৃষ্ঠার কিছু বেশি দৈর্ঘ্যের এ উপন্যাসটি শেষ করেই রুলফো মেক্সিকান সাহিত্যের প্যান্থিয়নে স্থান করে নেন। এরপর তিনি আর কোনো উপন্যাস লেখেননি। জীবনে কখনও অভিবাসন এজেন্ট, কখনও ভ্রাম্যমাণ টায়ার বিক্রেতা, আবার কখনও আদিবাসী সম্প্রদায়ের সহায়ক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
হুয়ান রুলফো ফাউন্ডেশনের পরিচালক ভিক্টর জিমেনেজ বলেন, 'মেক্সিকোতে লেখকরা জানেন, হুয়ান রুলফোর পথে হাঁটা প্রায় অসম্ভব। তবে তার লেখা সবাইকে প্রভাবিত করে। অনেকের কাছে তিনি মেক্সিকোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক।'
অনেকেই মনে করেন, পেদ্রো পারামো পরবর্তী লাতিন আমেরিকান কথাসাহিত্যের ভিত্তি স্থাপন করেছে। খ্যাতনামা সাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেস একে 'সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলোর একটি' বলে আখ্যা দিয়েছেন। গার্সিয়া মার্কেস বলেছিলেন, তিনি গোটা বইটি মুখস্থ বলতে পারেন, এমনকি উল্টোদিক থেকেও।
১৯৬১ সালে মেক্সিকোতে আসার পর এক বন্ধুর অনুরোধে মার্কেস এক রাতেই বইটি দুবার পড়েন এবং পরে বইটির জন্য একটি প্রস্তাবনাও লেখেন। মার্কেস বলেছিলেন, 'রুলফোর লেখার গভীরতা আমাকে আমার লেখার জন্য নতুন পথ দেখিয়েছিল।'
'ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউড'-এ পেদ্রো পারামোর ছায়া স্পষ্ট। প্রথম লাইনের আভিজাত্য থেকে শুরু করে দুটি উপন্যাসে রাজনৈতিক সহিংসতা, শক্তিশালী পরিবার এবং ম্যাকন্ডো ও কোমালা নামক বিচ্ছিন্ন শহরগুলোর পৌরাণিক বৈশিষ্ট্যেরও মিল রয়েছে।
পেদ্রো পারামোকেই প্রায়শই লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তব ধারার উত্থান ঘটানোর স্ফুলিঙ্গ বলা হয়। তবে উপন্যাসটি আসলেই জাদুবাস্তব ধারার অন্তর্গত কি না, তা নিয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে।
বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে রুলফো নিজেও পেদ্রো পারামো সম্পর্কে নানা মন্তব্য করতেন। তিনি বলতেন, উপন্যাসটি ভালোভাবে বুঝতে চাইলে তিনবার পড়া উচিত। অনেক কাটাকাটি করায় শেষে তিনি নিজেও এটিকে পুরোপুরি বুঝতে পারেননি বলেও মন্তব্য করেছিলেন।
জিমেনেজ বলেন, 'উপন্যাসটির জটিল কাঠামো এবং এর সময়-কাল লাফিয়ে চলার বৈশিষ্ট্যের কারণেই রুলফো সন্দিহান ছিলেন এটি কখনও সিনেমায় রূপান্তরিত হতে পারবে কি না।'
এ উপন্যাসের কার্লোস ভেলো, হোসে বোলাওস এবং সালভাদর সানচেজ পরিচালিত পূর্ববর্তী সিনেমা সংস্করণগুলো বিশেষভাবে সফল হয়নি।
বুধবার মুক্তি পাওয়া এ নতুন সংস্করণ সফল হবে কি না, তা নিয়ে মেক্সিকানদের আগ্রহ তুঙ্গে। প্রিমিয়ারে অংশ নিয়ে জিমেনেজের বিশ্বাস, এটি এখন পর্যন্ত সেরা প্রচেষ্টা।
তিনি বলেন, 'নতুন সিনেমা সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়েছে। তবে এটি এমন একটি কাজ যা কেবল পাঠকদের হাতে যথার্থ প্রাণ পায়।'