সপ্তাহে ৪ দিন কর্ম দিবস পরীক্ষা করেছে জার্মান কোম্পানিগুলো, ফলাফল কী?
চলতি বছরের শুরুর দিকে জার্মানির ৪৫টি প্রতিষ্ঠান সপ্তাহে চার দিন কর্মদিবসের একটি পাইলট প্রজেক্ট শুরু করেছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল এই মৌলিক পরিবর্তনটি কর্মচারী এবং নিয়োগকর্তাদের জন্য ইতিবাচক কোনো ফলাফল বয়ে আনতে পারে কিনা তা যাচাই করা।
ছয় মাস ধরে জার্মানির মুনস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে, প্রজেক্টে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের বেতন না কমিয়ে, কম কর্মদিবস কাজ করার সুযোগ দিয়েছিল।
পাইলট প্রজেক্টটি বার্লিনভিত্তিক ব্যবস্থাপনা পরামর্শ সংস্থা ইন্ট্রাপ্রেন্যোর এবং অলাভজনক সংস্থা ৪ ডে উইক গ্লোবাল (৪ডাব্লিউজিএ)- এর সহযোগিতায় পরিচালিত হয়।
সাধারণত, একই বেতনে কম কর্মদিবস কাজ করে সমান আউটপুট [ফলাফল] অর্জনের জন্য, কর্মীদের উৎপাদনশীলতা অনেক বাড়ানো প্রয়োজন হয়। প্রথমদিকে, কাজের চাপ এবং দায়িত্বের বোঝা বেড়েছে বলেও মনে হতে পারে।
ফলাফলের প্রধান মাপকাঠি হলো উৎপাদনশীলতা
কাজের সময় কমিয়ে দেওয়ার প্রভাবগুলো নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন করার জন্য, গবেষকরা জরিপ এবং সাক্ষাৎকার নেওয়ার বাইরেও আরও কিছু কাজ করেছিলেন।
তারা কর্মীদের স্ট্রেসের মাত্রা পরিমাপ করতে চুলের নমুনা বিশ্লেষণ করেছেন এবং হার্ট রেট, কাজে গতিশীলতার মাত্রা এবং ঘুমের মানের মতো শারীরবৃত্তীয় তথ্য সংগ্রহ করতে ফিটনেস ট্র্যাকার ব্যবহার করেছেন।
পাইলট গবেষণার বৈজ্ঞানিক প্রধান জুলিয়া ব্যাকম্যান বলেন, কর্মীরা সাধারণত কম সময় কাজ করলে ভালো বোধ করতেন এবং এসময় তারা সপ্তাহে পাঁচ দিন কর্মদিবসের সমানই কাজ করেছেন এবং কিছু ক্ষেত্রে তারা তার [পাঁচ দিন কর্মদিবসের] চেয়েও বেশি কাজ করেছেন।
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, অংশগ্রহণকারীরা মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্য উন্নতির কথা জানিয়েছেন। এছাড়া, প্রাত্যাহিক স্ট্রেসের সময় ট্র্যাক করা স্মার্টওয়াচ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এ সময় তাদের মানসিক চাপ ও বার্নআউটের লক্ষণও কমেছে৷
ব্যাকম্যানের অনুসন্ধান অনুসারে, কাজের প্রক্রিয়ায় কিছু পরিবর্তন আসায়, তিনজনের মধ্যে দুজন কর্মচারী কাজে কম ব্যাঘাত ঘটার কথা জানিয়েছেন। কারণ অর্ধেকেরও বেশি কোম্পানি এসময় কম মিটিং করেছে এবং এগুলো [মিটিং] যাতে সংক্ষিপ্ত হয়; সেজন্য নতুন করে ডিজাইন করেছে। এছাড়া, চারটি প্রতিষ্ঠানেরর মধ্যে একটি কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য নতুন ডিজিটাল টুলস ব্যবহার শুরু করেছে।
ইন্ট্রাপ্রেন্যোর-এর কার্স্টেন মেয়ার বলেন, 'কর্মদিবস কমানোর সম্ভাব্য ফলাফল জটিল প্রক্রিয়া, অতিরিক্ত মিটিং এবং কম ডিজিটালাইজেশনের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।'
স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে কিছু অপ্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া গেছে
গবেষণায় দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারীরা চার দিন কর্মদিবসে শারীরিকভাবে আরও সক্রিয় ছিল। এছাড়া, এসময় তারা সপ্তাহে পাঁচ দিন কর্মদিবসের তুলনায় প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৩৮ মিনিট বেশি ঘুমায়।
তবে, কর্মীদের প্রতিমাসে অসুস্থ থাকার পরিমাণ সামান্যই কমেছে। এক বছর আগের একই সময়ের তুলনায় পরিসংখ্যানগতভাবে এই পার্থক্য বেশ নগণ্য।
মুনস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের মারিকা প্লাটজ এই তথ্য বিশ্লেষণ করে অবাক হয়েছেন, কারণ অন্যান্য দেশে একই ধরনের গবেষণায় কর্মীদের অসুস্থ থাকা দিনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে দেখা গেছে।
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, আরেকটি বিস্ময়কর বিষয় হলো, জার্মান পরীক্ষার সময় কর্মদিবস কমায় পরিবেশগত তেমন সুবিধা না পাওয়া৷
অন্যান্য দেশে অফিস একদিনের জন্য পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ইতিবাচক প্রভাব পরিবেশে পড়েছে৷ কর্মস্থলে যাতায়াতের সংখ্যা কমে যাওয়ায় জ্বালানি সাশ্রয়ও হয়েছে৷
তিনি বলেন, এর কারণ সম্ভবত কিছু জার্মান কর্মচারী দীর্ঘ সাপ্তাহিক ছুটিতে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেছেন, যার ফলে সম্ভাব্য জ্বালানি সঞ্চয়ের পরিমাণ কমেছে।
ত্রুটিপূর্ণ তথ্য এবং একপাক্ষিক পরীক্ষা
গবেষণাটির ধরন ও পদ্ধতি ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে, গবেষণার ফলাফলগুলো কতটা কার্যকর বা উপকারী তা নিয়ে কিছুটা সংশয় তৈরি হতে পারে।
গবেষণার ছয় মাসের মধ্যে দুইটি কোম্পানি স্বেচ্ছায় প্রজেক্ট থেকে বেরিয়ে গেছে এবং আরও দুটি কোম্পানিকে মূল্যায়ন থেকে বাদ দিতে হয়েছে।অবশিষ্ট ৪১টি অংশগ্রহণকারী কোম্পানির মধ্যে শুধু এক তৃতীয়াংশ কোম্পানি সাপ্তাহিক কর্মদিবস একদিন কমিয়েছে।
প্রায় ২০% কোম্পানি দৈনিক কাজের সময় ১১% থেকে ১৯% পর্যন্ত কমিয়েছে, আর প্রায় অর্ধেক কোম্পানি কাজের সময় ১০% এর কম কমিয়েছে বা মোটামুটি সপ্তাহে চার ঘণ্টা কমিয়েছে। অর্থাৎ, শুধু ৮৫% ক্ষেত্রে কর্মচারীরা একটি পূর্ণ দিন ছুটি পেয়েছেন।
এছাড়া, অংশগ্রহণকারী কোম্পানির সংখ্যা সীমিত হওয়ার কারণে এই গবেষণাটি জার্মানি এবং তার ৩ মিলিয়নের বেশি নিবন্ধিত কোম্পানির জন্য প্রকৃতপক্ষে যথেষ্ট প্রতিনিধিত্বশীল নয়।
মারিকা প্লাটজ বলেছেন, প্রকল্পটি শুরু হওয়ার পর থেকে দুই বছর ধরে যথেষ্ট আগ্রহী নিয়োগকর্তা খুঁজে পেতে সমস্যা হয়েছিল, কারণ জার্মানিতে আগে থেকেই পার্ট-টাইম কাজের বিষয়টি প্রচলিত।
এই কারণে, গবেষণার ফলাফলগুলো সম্পূর্ণভাবে নির্ভুল বা জার্মানির বৃহত্তর পরিস্থিতির প্রতিফলন নাও হতে পারে।
রেগেন্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং জার্মানির এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক এনজো ওয়েবার ডয়চে ভেলেকে বলেন, প্রজেক্টটিতে উৎপাদনশীলতা বাড়ার বিষয়টি শুধু কর্মঘণ্টা কমানোর কারণে নাও হতে পারে৷ কারণ এ সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের পদ্ধতি এবং সাংগঠনিক কাঠামোতেও পরিবর্তন আনা হয়েছিল।
ওয়েবার আরও বিশ্বাস করেন, ইতিবাচক ফলাফলগুলো দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হতে নাও পারে। কারণ কর্মঘণ্টা কমানোর কারণে বাড়তি কাজের চাপ কর্মচারীদের সামাজিক, যোগাযোগমূলক এবং সৃজনশীল দিকগুলোর ওপর চাপ ফেলবে। এর 'প্রভাবগুলো সাধারণত তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা যায় না, বরং মধ্যমেয়াদে দৃশ্যমান হয়।'
এছাড়া তিনি আরও বলেন, সাধারণত এই ধরনের গবেষণাগুলো এক বছর বা তার বেশি সময় ধরে করা হয় না। এর পরিবর্তে মাত্র ছয় মাসের মতো একটি সংক্ষিপ্ত সময়ে এগুলো করা হয়ে থাকে।
এর মানে হলো, যদিও প্রথম দিকে ফলাফলগুলো ইতিবাচক মনে হতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদি কর্মচারীদের সামাজিক সম্পর্ক, সৃজনশীলতা এবং যোগাযোগের দক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং এসব প্রভাব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ পেতে পারে।
জার্মানির এমপ্লয়ারের অ্যাসোসিয়েশন বিডিএ-এর সিইও স্টেফেন ক্যাম্পিটার বলেছেন, যে কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে কার্যক্রম পরিচালনা করে, তারা সচেতনভাবে এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কর্মদিবস কমানোয় উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লাভ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'সপ্তাহে চার দিন কাজ করে পুরো সপ্তাহের বেতন দেওয়া মানে মজুরি অনেক বেশি হয়ে যাওয়া, বেশিরভাগ কোম্পানিই এটা বহন করতে পারে না।'
সপ্তাহে ৪ দিন কর্মদিবস নিয়ে শেষকথা
প্রজেক্টে অংশ নেওয়া ৪১টি কোম্পানির মধ্যে ৭০% এরও বেশি কোম্পানি বলেছে, তারা এই প্রজেক্টে ভবিষ্যতে চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। কিছু কোম্পানি বলেছে যে তারা ট্রায়াল পর্বের মেয়াদ বাড়াবেন, অন্যরা সরাসরি কর্মঘণ্টা কমানোর বিষয়ে চিন্তা করছে।
তবে গবেষণার পরিচালক ব্যাকম্যান জোর দিয়ে বলেছেন, সব খাতে একসঙ্গে সপ্তাহে চার দিন কর্মদিবস চালু করার পক্ষে সমর্থন জানানো এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল না। বরং 'একটি সৃজনশীল কর্ম-সময় মডেল এবং তার প্রভাব' অন্বেষণ করার জন্য এটি করা হয়েছে।
ইন্ট্রাপ্রেন্যোর কনসালটেন্সির কার্স্টেন মেয়ার বলেন, ট্রায়ালের ইতিবাচক ফলাফল জার্মানির প্রতিটি কোম্পানির জন্য সমপরিমাণ লাভজনক বলে ভাবা ঠিক হবে না।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি