গজারি বনের ‘মাছ মুরাল’
গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার বিভিন্ন অঞ্চলজুড়ে রয়েছে নয়নাভিরাম অরণ্য, যা গজারি বন নামে পরিচিত। বেশির ভাগ গজারি বনের পাশেই ছিল ছোট বড় বিল-বাঁওড়। প্রতিটা বিল-হাওরের বৈচিত্র্যময় সুন্দর নাম ছিল। যুগ যুগ ধরে সেসব নাম মানুষের কাছে তাদের পরিচয় বহন করে আসছিল। কন্যাই, পুইন্যা, কালিহাসি, বুইদ্দামারা, মোনতোষ, নলডুগুর, বাইন্যাইদ বিল, বুড়ির বিল, মহিষ মারা, ননী হাওর, ভারদুন, ফকির মারা...আরও কত বিচিত্র আর অদ্ভুত নামের বিল-বাঁওড় ছিল সমস্ত অঞ্চলজুড়ে! এসব নামকরণের পেছনে ছিল বিশেষ বিশেষ গল্প। বর্তমান বাংলাদেশের অনেক স্থানেই বিল-হাওরগুলো তাদের নিজস্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে মাছ চাষ। কচুরিপানা ও জলজ উদ্ভিদ পরিষ্কার করে, বিষ প্রয়োগে আদি মাছ হত্যা করে উন্নত জাতের মাছের চাষ হচ্ছে। আসলে দেশি মাছের এই বীজতলা নষ্ট করা অত্যন্ত ভয়াবহ বিষয়। কিছুদিন আগে কালীগঞ্জের বিল-বাঁওড়গুলো পরিদর্শনে গেলে পরিস্থিতি আর দৃশ্য দেখে আমার হৃদয় ভেঙে খানখান হয়ে যায়। কত স্মৃতি এই জায়গাগুলো নিয়ে আমার। বর্তমানে কী ধ্বংসাত্মক অবস্থা!
যাক সে কথা। পুরোনো স্মৃতি রোমন্থনে ফিরে যাই। তখন বয়স ছিল কম। ওই সব বিল-বাঁওড়ে নিয়মিত যাত্রা ছিল। ওই প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো ছিল জলচর পাখিদের স্বর্গরাজ্য। আর আমার তখন বেশির ভাগ সময় কাটত পাখি শিকার করে। সরালি, বুনো রাজহাঁস, চখাচখি, শামুকভাঙ্গা, কালিম, কোড়া, পানকৌড়ি, জলময়ূর, জলপিপি, জলমুরগি...আরও কত-শত পাখির প্রিয় আবাসস্থল ওই সব বিল-হাওর। তবে শুধু শিকারের উদ্দেশ্যে আমি এসব বিল-হাওরের চারপাশে ঘুরে বেড়াইনি। বিষয়টা হয়ে গিয়েছিল নেশার মতো। পদ্মবিলের সৌন্দর্য আর গজারি বনের দুর্দান্ত আকর্ষণ আমায় চুম্বকের মতো টানত। তাই শিকার করা ছেড়ে দেওয়ার পরও বন্দুক ছাড়া খালি হাতে বিল-হাওর আর গজারি বনের পাশে ঘুরে বেড়িয়েছি বহুবার, জুড়িয়েছে নয়ন, মুগ্ধ হয়েছে হৃদয়।
অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিল কন্যাই বিল। বিলের চারদিকে ঘন গজারি বন। যখন পদ্ম ফুটত, দূর থেকে দেখলে মনে হতো, সবুজ অরণ্যের বুকে কেউ গোলাপি কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে। শিকার ছেড়ে যখন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফি শুরু করি, সময় পেলেই ছুটে যেতাম কন্যাই বিলের পাশে। নানা জাতের পাখি আর মনজুড়ানো প্রাকৃতিক দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করে সময় কাটত। এসব ছবি তোলার বিষয়ে একজন মানুষ আমাকে খুবই সাহায্য করতেন। নাম ছিল তার জয়নাল মিয়া। সেই শিকারি জীবনে আমার সঙ্গে পরিচয়। কন্যাই বিলের পশ্চিম পাশের ঘন গজারি বনের ভেতরে তার বাড়ি। কী যে সুন্দর ছিল, অরণ্যবেষ্টিত সেই ছোট্ট মাটির বাড়িটি! আজও আমি তা ভুলতে পারি না। এ যেন আমার মনের বাড়ি। কত দিন কত রাত কেটেছে সেই বাড়ির চৌকির মতো উঁচু মাটির বিছানায়। জয়নাল মিয়া নিজেও একসময় শিকারি ছিলেন। তির-ধনুক দিয়ে গজারি বন থেকে সজারু, মায়া হরিণ আর বুনো খরগোশসহ নানা জাতের প্রাণী শিকার করেছেন। তবে আমার মতো তিনিও একদিন শিকার করা ছেড়ে দিয়েছিলেন অন্যায় মনে করে। জঙ্গল আর জঙ্গলের পশু-পাখি সম্পর্কে টনটনে জ্ঞান ছিল তার।
বিল-হাওর কিংবা গজারি বনের কোথাও নতুন কোনো প্রাণী বা পাখি দেখা গেলে জয়নাল মিয়া সাথে সাথে আমাকে খবর দিতেন। আমি যথাসম্ভব দ্রুত সেখানে গিয়ে তা ক্যামেরাবন্দী করে নিয়ে আসতাম। এ ব্যাপারে অবশ্য সব সময় সফলতা পাওয়া যেত না। প্রায় সময়ই ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হতো। একবার জয়নাল মিয়ার একটি চিঠি আসে আমার ঠিকানায়। তা থেকে জানা যায়, বেশ কয়েক দিন যাবত একটা কোড়া পাখিকে কন্যাই বিলের আশপাশে দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশের শিকারি পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে ইগল প্রজাতির এই পাখি 'কুড়া'। ইংরেজিতে এদের কেউ বলে Pallas's Fishing Eagle, আবার কারও কাছে Ringtailed Fishing Eagle নামে পরিচিত। একসময় বাংলাদেশের প্রায় সব বিল-হাওড়ের পাশে এদের দেখা যেত। কিন্তু এখন এরা খুবই বিরল প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে।
জয়নাল মিয়ার চিঠি আমাকে কিছুটা চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। কারণ, তখন পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশে হাতেগোনা কয়েক জোড়া কুড়া টিকে ছিল সিলেট ও ময়মনসিংহ জেলার হাওড় অঞ্চলে। গাজীপুরে কুড়া আসবে কোথা থেকে? বিগত সময়ে আমি গাজীপুরের কোথাও কুড়ার সন্ধান পাইনি। তবে কি জয়নাল মিয়া অন্য কোনো ইগলকে কুড়া মনে করছেন? এমন তো হবার কথা নয়! কারণ, পাখি সম্পর্কে তার সম্যক জ্ঞান রয়েছে। খয়েরি ইগল, চিত্রা ইগল, কালো ইগল, সাদা ইগল, টনী ইগল ইত্যাদি শিকারি পাখি সম্পর্কে তার বেশ ভালোই ধারণা রয়েছে। তার তো এমন ভুল হওয়ার কথা নয়!
বিকেলে ঢাকার ফুলবাড়িয়া থেকে বাসে উঠে রওনা হয়ে গেলাম জয়নাল মিয়ার বাড়ির উদ্দেশে। সন্ধ্যার একটু আগে সাওরাইদ বাজার নামক একটি স্থানে বাস থেকে নেমে গেলাম। একটা রিকশা নিয়ে এগিয়ে গেলাম গন্তব্যের উদ্দেশে। চার মাইল যাওয়ার পর রিকশা ছেড়ে দিতে হলো। কারণ, বাকি পথটুকু আমাকে যেতে হবে ঘন গজারি বনের ভেতর দিয়ে সরু একটা রাস্তা ধরে। চারদিক থেকে রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসছে। বুঝতে পারলাম বেশ একটা বোকামি করে ফেলেছি, আরও আগে ঢাকা থেকে রওনা দেওয়া উচিত ছিল। ঘন বনের ভেতর দিয়ে আমাকে প্রায় দুই মাইল পথ যেতে হবে। এমনিতে রাত্রির অরণ্য আমার কাছে মোটেই ভয়ের কোনো জায়গা নয়, বরং এতে এক ধরনের পুলকিত শিহরণ জেগে ওঠে মনে। তবে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল সঙ্গে থাকা দামি ক্যামেরাটাকে নিয়ে। এদিকে ডাকাতের উৎপাত রয়েছে। তবে শিকারি হিসেবে এখনকার অনেকেই আমাকে চেনে, তাদের সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্কও রয়েছে। এটা ভেবে মনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এল। যদিও ডাকাত তো ডাকাতই।
ঝোপ-জঙ্গল পেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম রাতের জঙ্গলের বুক চিরে। পথে তেমন কোনো সমস্যা হলো না। শুধু একটা গোখরা সাপের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। খৈয়া গোখরা। তারার আলো হঠাৎই দেখতে পেয়েছিলাম রাস্তা পার হচ্ছে সে। আমাকে দেখেই ফণা তুলে দাঁড়িয়ে গেল। আমিও স্বভাব অনুযায়ী চুপ মেরে দাঁড়িয়ে গেলাম। বন-জঙ্গলে যারা নিয়মিত যাতায়াত করেন, তারা ভালো করেই জানেন বিরক্ত কিংবা আঘাতপ্রাপ্ত না হলে সাপের মতো নিরীহ প্রাণী আর দ্বিতীয়টি নেই। সে কিছুক্ষণ ফণা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে মাথাটা নিচে নামিয়ে পাশের জঙ্গলে ঢুকে গেল। খাবারের সন্ধানে বেরিয়েছে সর্পরাজ।
দূর থেকে কুপির টিমটিমে আলো দেখে বুঝলাম, এখনো জেগে আছে জয়নাল মিয়ার বাড়ির লোকজন। উঠানে দাঁড়িয়ে নাম ধরে ডাকতেই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন গৃহকর্তা স্বয়ং। আমাকে দেখে অনেকটা অবাক হয়ে গেলেন। এত তাড়াতাড়ি যে পৌঁছে যাব ভাবতে পারিনি। জানতে চাইলেন পথে কোনো অসুবিধা হয়েছে কি না। আমি বললাম, 'রাতের জঙ্গলে হেঁটে বেড়ানোর চাইতে বড় আনন্দ আর কিছুই নাই।' শুনে হেসে উঠলেন তিনি।
রাতের খাবার খাওয়ার আগপর্যন্ত কুড়া সম্পর্কে তার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ আলাপ হলো। আর এই আলাপের মাধ্যমেই বুঝতে পারলাম, পাখিটা আসলে কুড়া নয়, তবে দেখতে অনেকটাই কুড়ার মতো। খাওয়াদাওয়ার পর মাটির ঘরের মাটির চৌকিতে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। চারদিকে ঘন বন। মাঝখানে ছোট্ট একটি বাড়ি। সেই বাড়ির ছোট্ট একটি ঘরে শুয়ে আছি আমি। ভাবতেই অনাবিল আনন্দের শিহরণে কেঁপে উঠল দেহ-মন। চারদিকে ঝিঁঝি পোকার অনবরত গুঞ্জন, দূর থেকে ভেসে আসা শেয়ালের কেক্কা-হুয়া ডাক, হুতুম প্যাঁচার গুরুগম্ভীর অথচ রক্তহীম করা 'হুতোম-ভুতুম, হুতোম-ভুতুম' আওয়াজ, নিশাচর তক্ষকের ভয়জাগানিয়া, রাত কাঁপানো 'গেক্কো-গেক্কো' ডাক শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, খেয়াল নেই।
সকালবেলা ঘুম ভাঙল জয়নাল মিয়ার ডাকে। তাড়াতাড়ি নাশতা সেরে তাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। আমরা কন্যাই বিলের দিকে হাঁটতে লাগলাম। জয়নাল মিয়ার কাছে জানতে পারলাম কুড়াটা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় কন্যাই বিলের পাশে। বিলের পাশাপাশি পৌঁছে আমি কান খাড়া করে রাখলাম। কারণ, কোনো স্থানে কুড়া থাকলে তাদের ডাক শুনে খুব সহজে এদের অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায়। সমস্ত বিলজুড়ে ফুটে আছে গোলাপি রঙের পদ্ম ফুল। পদ্ম পাতার ওপর নাচানাচি করছে কয়েকটা জলপিপি। পদ্ম পাতার ফাঁকে দেখতে পেলাম কয়েকটা পাখির কালো রঙের মাথা, সমস্ত শরীর পানির নিচে। ওরা পানকৌড়ি। ডুবসাঁতারে ভীষণ পারদর্শী। দুর্দান্ত মাছশিকারি। এই মুহূর্তে ওরা ভীষণ ব্যস্ত মাছ শিকারে।
পানকৌড়ি আর জলপিপির খেলা দেখতে দেখতে এগিয়ে যেতে লাগলাম সামনের দিকে। আগেই বলেছি কন্যাই বিলের চার দিকে গজারি বন। আমরা এগিয়ে চলেছি গজারি বনের পাশ ঘেঁষে। চারদিকে প্রচুর শঙ্খচিল দেখতে পেলাম। বিলের ওপর উড়ে বেড়াচ্ছে ছোট মাছ বা ব্যাঙ শিকারের উদ্দেশ্যে। শিকার পানির ওপর ভেসে ওঠার সঙ্গে ওরা দ্রুত ডাইভ দিয়ে তাদের শক্ত নখরে আঁকড়ে ধরে উড়ে যাবে আকাশে। সকালের রোদে তাদের লালচে ডানাগুলো চকচক করছিল। সমস্ত বিলের প্রায় চার ভাগের তিন ভাগ এলাকা ঘুরেও কুড়ার দেখা পাওয়া গেল না। কিছুটা বিশ্রামের আশায় আমরা একটা বেতঝোপের পাশে বসে পড়লাম। ঠিক সে সময় হঠাৎ বেশ বড় আকারের একটা পাখিকে বিলের পুব দিক থেকে উড়ে আসতে দেখলাম। বেশ ধীরগতিতে উড়ে আসছে সে। দূরত্ব অনেক বেশি থাকায় আমি পাখিটাকে চিনতে পারলাম না। তবে এটা বুঝলাম, পাখিটা ইগল প্রজাতির। বিলের উত্তর পাশের একটা আমগাছের মাথায় গিয়ে বসে পড়ল পাখিটা। আমরা বসে আছি বিলের দক্ষিণ পাশে, আর আমগাছটা আমাদের ঠিক বিপরীতে। বিলের আয়তন খুব একটা ছোট নয়। অনেকটা জায়গা ঘুরে আমগাছের কাছে যেতে হবে। বসা থেকে উঠে খুব দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগলাম আমরা। কারণ, যেকোনো সময় পাখিটা উড়ে যেতে পারে অন্য দিকে। সূর্য ধীরে ধীরে চলে আসছে মাথার ওপরে। দ্রুত হাঁটার ফলে আমাদের দুজনের কাপড় ঘামে ভিজে গেল। এভাবেই একসময় আমরা আমগাছের কিছুটা কাছাকাছি চলে এলাম। আমার আগেই জয়নাল মিয়া পাখিটাকে চিনে ফেলল। এ হচ্ছে তিলা নাগ ইগল। দুর্দান্ত এক শিকারি পাখি, যার প্রধান খাদ্য সাপ। এদের বহু ছবি তুলেছি আমি। তাই এই মুহূর্তে তার আমার কোনো প্রয়োজন নেই। তবু কয়েকটা ছবি তুলে রাখলাম।
এদিকে জয়নাল মিয়া আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, 'কুড়া মনে হয় এখন ভাদুন হাওরের দিকে আছে, এদিকে থাকলে এতক্ষণে অবশ্যই পাখিটাকে দেখা যেত।' তার কথার মধ্যে কেমন যেন একটা আত্মবিশ্বাসের সুর খুঁজে পেলাম। কন্যাই বিল থেকে কিছুটা দূরেই বিখ্যাত ভাদুনের হাওর। দেরি না করেই আমরা সাথে সাথে রওনা দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম হাওরের কাছাকাছি এলাকায়। জলাভূমির বিশালতা দেখে আমার মন দুর্বল হয়ে গেল। এত বিশাল জায়গা থেকে কী করে একটা নির্দিষ্ট পাখিকে খুঁজে বের করব? মাথায় চিন্তার ঝড় বয়ে গেল। বিষয়টা জয়নাল মিয়াকে খুলে বললাম। আমার কথা শুনে তার মুখটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম তিনিও বেশ চিন্তিত। দুজন ব্যাপারটা নিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা করার পর একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম। আমাদের হাতে ছবি তোলার মতো এখন যে সময় আছে, তাতে হাওরের অর্ধেক এলাকাও ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। হাওড়ের ঠিক উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে পাহাড়ের মতো উঁচু একটা টিলা। টিলার ওপর থেকে হাওরের সম্পূর্ণ অংশকে পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। আমরা ঠিক করলাম টিলার গা বেয়ে ওপরে উঠে যাব। তারপর আমরা তাই করলাম। আর টিলার সবচেয়ে ওপরের অংশে উঠে সামনের দিকে তাকাতেই বুঝলাম আমরা সঠিক কাজটি করেছি। হাওরের চারদিকে না ঘুরে টিলার ওপর বসে হাওরের ওপরে উড়ে চলা পাখিদের ওপর দৃষ্টি রাখার সিদ্ধান্তটা একদম সঠিক ছিল। টিলার একটা সমতল স্থানে বসে আমরা তীক্ষè দৃষ্টিতে হাওরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সেই সঙ্গে সজাগ থাকল আমার দুই কান। আমাদের দৃষ্টিসীমা এবং দৃষ্টিসীমার বাইরে বহু প্রজাতির পাখি দেখতে পেলাম। সঙ্গে বাইনোকুলারটি না নিয়ে আসার জন্য ভীষণ রাগ হলো নিজের ওপর। যন্ত্রটার সঙ্গে থাকলে কাজ আরও সহজ হতো। হাওরের ওপর শিকারের সন্ধানে, শঙ্খচিল, ভুবন চিল, সর্প ইগল, মধুবাজ, কটুয়া চিলসহ নানা জাতের পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমাদের সেই কাক্সিক্ষত পাখির কোনো চিহ্নই আকাশের কোনো জায়গায় দেখতে পেলাম না।
বেলা অনেক হয়েছে। পেটের ভেতর ক্ষুধাটা মোচড় দিয়ে উঠল। জয়নাল মিয়ার মুখের দিকে তাকাতেই বুঝলাম, তারও একই অবস্থা। বাড়ি থেকে আসার সময় তিনি বুদ্ধি করে সঙ্গে কিছু মুড়ি আর গুড় নিয়ে এসেছিলেন। শুকনো খাবার খাওয়ার পর ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে পানি পান করে নিলাম দুজনে। পেটে খাবার পড়ার পর দেহ-মনে নতুন উদ্যম ফিরে এল। কিন্তু মনে মনে আমি কুড়ার দেখা পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। জয়নাল মিয়ার মনের অবস্থাটা চিন্তা করলাম, বেচারা হয়তো খুব লজ্জিত বোধ করছেন; এত দূর থেকে আমাকে খবর দিয়ে এনেছেন। আরও কী যেন ভাবতে গিয়ে অনেকটা আনমনা হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ আমার পিঠে জয়নাল মিয়ার হাতের ধাক্কায় চিন্তার জাল ছিড়ে গেল। হাওড়ের দিকে আঙুল তুলে তিনি শুধু বলছেন, 'ওই যে কুড়া, ওই যে কুড়া।' হাওরের ঠিক মাঝখানে বিশাল আকারের একটা পাখিকে উড়তে দেখলাম। পাখিটাকে দেখে প্রথমে আমি নিজেও সেটাকে কুড়া মনে করেছিলাম। পরক্ষণেই বুঝলাম পাখিটা দেখতে অনেকটা কুড়ার মতো হলেও আসলে সে কুড়া নয়। তবে পাখিটা এখনো আমাদের কাছ থেকে বেশ দূরে, তাই পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। বিশাল পাখিটা একসময় উড়ে গিয়ে হাওরের দক্ষিণ পাশের প্রাচীন কড়ইগাছের ডালে গিয়ে বসল। আমরা এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলাম। টিলা থেকে নেমে দৌড়াতে লাগলাম কড়ইগাছের উদ্দেশ্যে।
গাছের কাছাকাছি গিয়ে জয়নাল মিয়াকে একটা ঝোপের ভেতর বসে থাকতে বলে খুব সাবধানে এগিয়ে যেতে লাগলাম সামনের দিকে। ক্যামেরায় আগে থেকেই টেলি ল্যান্স প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। অতি সন্তর্পণে প্রতিটা পদক্ষেপ ফেলতে হচ্ছে। কারণ, কোনো কারণে পাখিটা উড়ে গেলে এত কষ্ট, এত শ্রম, সবই বিফলে যাবে। শিকারি চিতার মতো গুড়ি মেরে একসময় চলে গেলাম পাখিটার অনেকটা কাছাকাছি। প্রথমেই সাক্ষী শট নিয়ে ফেললাম। তারপর ক্যামেরার রেঞ্জের মধ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে শাটার টিপতে শুরু করলাম।
অনেকগুলো ছবি তোলা হলো। এবার আমি অনেকটা কাছ থেকে পাখিটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। পাখিটা কুড়া নয়। তবে কুড়ার মতোই অনেকটা বিরল প্রজাতির পাখি। তবে খুবই আনন্দের কথা, আজই প্রথম আমি তার ছবি তুললাম। তবে কুড়ার ছবিও আমার সঙ্গে রয়েছে। এই শিকারি ইগল 'মাছ মুরাল' নামে পরিচিত। আকারের দিক দিয়ে মাছ মুরাল কুড়ার চাইতে কিছুটা ছোট। তবে স্বভাব আর শক্তি প্রদর্শনে ঠিক যেন কুড়ার প্রতিচ্ছবি। নিজের ওজনের চাইতে দ্বিগুণ ওজনের যেকোনো মাছ বা প্রাণীকে অনায়াসে নখরে বিধিয়ে আকাশে উড়ে যেতে পারে। কুড়ার সঙ্গে চেহারা আর স্বভাবের মিল থাকার কারণে অনেক অভিজ্ঞ লোকও প্রথম দর্শনে এদের চিনতে ভুল করে।
আমি তাকে আর একটু ভালো করে পর্যবেক্ষণের জন্য কিছুটা এগিয়ে গেলাম। আর তখনই আমাকে বিপজ্জনক মনে করে পাখিটা তার বিশাল ডানা মেলে আকাশে উড়ে গেল। ডানার ঝাপটায় কড়ইগাছের ঝাঁকরা পাতাগুলো ঝোড়ো বাতাসের মতো দুলে উঠল। পেছনের দিকে তাকাতেই জয়নাল মিয়াকে দেখতে পেলাম, একটা গাছের নিচে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। কাছে যেতেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কুড়ার ছবি কেমন তুললেন?' আমি তখন পাখিটার আসল পরিচয় তার কাছে খুলে বললাম। এতে মনে হয় তিনি বেশ লজ্জায় পড়ে গেলেন। তখন আমি তাকে বললাম, 'এ ধরনের ভুল অনেক অভিজ্ঞ লোকও করে থাকে, এতে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।' আমি তাকে এ-ও বললাম, 'মাছ মুরালের ছবি তুলতে গিয়ে দুর্দান্ত অ্যাডভেঞ্চার হয়ে গেল, দারুণ উপভোগ্য সময় কাটল।' আমার কথা শুনে অমায়িক হাসি হেসে উঠলেন অরণ্যবাসী মানুষটি।
সারা দিনের পরিশ্রমের ধকলে আমরা দুজনই তখন বেশ ক্লান্ত। জয়নাল মিয়ার কাঁধে হাত রেখে ফিরে চললাম তার অরণ্যবেষ্টিত বাড়ির উদ্দেশে। আজ আর ঢাকা ফেরা হবে না, অর্থাৎ আরও একটি চমৎকার আরণ্যক রাত অপেক্ষা করছে আমার জন্য।