ভয়াল ১২ নভেম্বর: ৫৪ বছরে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছে উপকূলের যত মানুষ
১৯৭০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৫৪ বছরে বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে অন্তত ১২ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও), আর্ন্তজাতিক ও দেশীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং বিভিন্ন গ্রন্থসূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
গত ২০০ বছরে সংঘটিত প্রলয়ংকারী ঝড়গুলোর তালিকা করেছে ডব্লিউএমও। এ তালিকায় সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঝড় হিসেবে শীর্ষে রয়েছে 'গ্রেট ভোলা সাইক্লোন'।
২০১৭ সালের ১৮ মে প্রকাশিত ডব্লিউএমও'র তথ্য বিবরণী থেকে জানা গেছে, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) উপকূলে আঘাত হানে 'গ্রেট ভোলা সাইক্লোন'। ২২৪ কিলোমিটার গতি সম্পন্ন ঝড়টি ভোলা, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরগুনা ও চট্টগ্রামসহ দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যায়।
ওই ঝড়ে মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বিশ্বের বহু গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার-প্রকাশ হয়। আর্কাইভ ডটঅর্গ-এ সে সময়ে প্রকাশিত বৃটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকার একটি প্রিন্ট কপি রয়েছে। ১৯৭০ সালের ১৮ নভেম্বর বৃটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদটির শিরোনাম ছিল অফিসিয়ালস ফেয়ার ডেথ টোল অব 'ওয়ান মিলিয়ন'।
সেইসঙ্গে প্রতিবেদনটিতে ঝড়ে পুরো উপকূলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৮৬.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বলে উল্লেখ করা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ের ২৯৭ পৃষ্ঠায় ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের ঝড়ের কথা লিখেছিলেন। সেখানে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছেন তিনি।
বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ওয়েবসাইটেও ১৯৭০ সালের ঝড়ে মৃত্যুর সংখ্যা ১০ লাখ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ দুর্যোগ প্রস্তুতি কেন্দ্র (বিডিপিসি) প্রকাশিত 'দূর্যোগ কোষ' গ্রন্থ সূত্রে জানা গেছে, এ ঝড়ে কেবল মৎস্যজীবীই মারা গেছেন এক লাখ ৬১ হাজার।
আবহাওয়া বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়েদার ও হারিকেন সায়েন্সের তথ্যমতে, এ ঝড়ে ভোলার তজুমুদ্দিন উপজেলায় প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় এক লাখ ৬৭ হাজার মানুষ।
দূর্যোগ কোষ গ্রন্থ সূত্রে আরও জানা গেছে, ১৯৭০ সালে ১০ লাখ মৃত্যুর পর ২০২২ সালের ১২ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে আঘাত হানা আরো ২১টি ঝড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। এসব ঝড়ে মোট এক লাখ ৭৪ হাজার ৯৫ জন উপকূলবাসী প্রাণ হারিয়েছেন।
তবে রেডক্রসের তথ্যমতে, এ সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়ে যাবে। আর ১৯৭০ সাল থেকে চলতি বছরের ১২ নভেম্বর পর্যন্ত ৫৪ বছরে বিভিন্ন ঝড়ে বাংলাদেশের উপকূলে অন্তত ১২ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল। এতে দেড় লাখ উপকূলবাসী নিহত ও নিখোঁজ হন। মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে তৃতীয় বড় ঝড়টি হয়েছিল ১৯৮৫ সালের মে মাসে। এত ১১ হাজার ৬৯ জন মানুষ নিহত হন।
দূর্যোগ কোষ-এ উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭০ সাল থেকে পরবর্তী সাত বছরের নভেম্বর মাসগুলোতে সংঘঠিত ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১২ হাজার উপকূলবাসী।
এর মধ্যে ১৯৭৪ সালের ২৪ নভেম্বর ২০০, ১৯৮৩ সালে ৫ নভেম্বর ৩০০, ১৯৮৬ সালের ৮ নভেম্বর ২০০, ১৯৮৮ সালের নভেম্বর মাসে পাঁচ হাজার ৭০৮ জন, ১৯৯৫ সালের ২১ নভেম্বর ৬৫০ জন এবং ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডরে চার হাজার ৪০৯ জন উপকূলবাসী নিহত হন।
অন্য ঝড়গুলোর মধ্যে ১৯৭৪ সালের ১৩ আগস্ট ৬০০ জন, ১৯৯৪ সালের ২৯ এপ্রিল ৪০০ জন, ১৯৮৩ সালে ১৪ অক্টোবর ১৯৩ জন, ১৯৯৪ সালের ২৯ এপ্রিল ৪০০ জন, ১৯৯৭ সালের ১৬ মে ১২৬ জন, ২০০৮ সালের ২৬ অক্টোবর ১৫ জন, ২০০৯ সালের ২৫ মে ১৯০ জন, ২০১৩ সালের ১৭ মে ১৭ জন, ২০১৫ সালের ২৯ জুলাই ১৩২ জন, ২০১৬ সালের ২১ মে ২৬ জন, ২০১৯ সালের ১২ মে ছয়জন, ২০২২ সালে ৩৫ জন উপকূলবাসী নিহত হন।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কমিটির রামগতি উপজেলা টিম লিডার মো. মাইন উদ্দিন খোকন বলেন, ১৯৭০ সালের পর ৫৪ বছর ধরে দেখে আসছি আমাদের উপকূল অনিরাপদ।
'গ্রেট ভোলা সাইক্লোন' আঘাত হানার পর নিহতদের মরদেহ উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছিলেন কৃষক ওলি আহমেদ। তিনি বলেন, '১২ নভেম্বরের পর কত লাশ উদ্ধার ও দাফন করেছি তার কোনো হিসাবে নেই।'
এদিকে উপদ্রুত অঞ্চলে ১২ নভেম্বর উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় কোনো কর্মসূচি না থাকলেও বিভিন্ন সংগঠন দিনটিতে শোক পালন করে। উপকূলীয় এলাকায় কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন কোস্টাল জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক ২০১৭ সাল থেকে দিনটিকে উপকূল দিবস হিসেবে ১৯ জেলায় পালন করে আসছে। সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা দিনটিকে জাতীয় ও আর্ন্তজাতিকভাবে উপকূল দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবিও জানিয়েছেন।
কোস্টাল জার্নালিস্ট নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টু বলেন, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের ধ্বংসযজ্ঞকে কেন্দ্র করে উপকূলের জন্য একটি পৃথক দিবস থাকলে উপকূলবাসীর মধ্যে প্রাকৃতিক দুযোর্গ নিয়ে সচেতনতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। জলবায়ু পরির্বতনের ফলে বাংলাদেশ যে ঝুঁকিতে আছে তা আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়কে বোঝানো সম্ভব হবে। এ অঞ্চলের উন্নয়নের বিষয়গুলো সবার নজরে আসবে।