এরাই কী শেষ জলচর উট!
উটগুলোকে নিজের সন্তানের মতোই দেখেন আইয়ুব আমিন জাট। তার উটগুলো অবশ্য যেনতেন কোনও মরুচারী প্রাণি নয় বরং এমন একটি বিরল প্রজাতি যারা পানিতে সাঁতার কাটতে পারদর্শী।
ভারতের গুজরাট রাজ্যে শত শত বছর ধরে এই উটগুলো পালন করে এসেছে আমিন জাটের আধা-যাযাবর পূর্বপুরুষেরা।
খারাই উটের নাম এসেছে স্থানীয় শব্দ 'খারা' থেকে, যার অর্থ; লবণাক্ততা।
বর্ষা মৌসুমে আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত কচ্চ উপসাগর লোনা পানিতে প্লাবিত হয়। সেই পানিতেই সাঁতার কেটে মাঝে মাঝে জেগে থাকা ছোট ছোট দ্বীপের মতো উঁচু ভূখণ্ডে চড়তে যায় উটগুলো। মনের সুখে খায়, স্বাসমূলীয় এবং অন্যান্য লবণাক্ততা সহণশীল গাছের পাতা।
নরম মাংসে মোড়ানো খুরের তলা তাদের উপকূলীয় আদ্র ভূমিতে চলাচলেও সাহায্য করে। এর সাহায্যে তারা তিন কিলোমিটার বেগে সাঁতার কাটতে পারে।
লবণাক্ত পরিবেশের সঙ্গে দারুণ খাপ খাইয়ে নিয়েছে খারাই উট প্রজাতি। ম্যানগ্রোভের পাতা ভোজের পর- সরাসরি দ্বীপগুলোর জলাশয়ে জমা থাকা বৃষ্টির পানি খায় তারা। দ্বীপে যথেষ্ট পানি না থাকলে তখন পশুপালক রাখালেরা আশেপাশের গ্রামে নিয়ে গিয়ে উটগুলোকে পানি পান করান।
মরুচারী উটের পানিতে এমন বিচরণের কথা বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় না। তবে মনুষ্যসৃষ্ট নানা কর্মকাণ্ডের প্রভাবে খারাই উটেরা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। কেবল ২০১৫ সালে একে আলাদা প্রজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তাই ঠিক কী পরিমাণ খারাই উট অবশিষ্ট আছে- তা হিসাব করাটা বেশ কঠিন।
তবে গুজরাটের স্থানীয় একটি অলাভজনক সংস্থা- সেহজিভান- এর অনুমান আজ থেকে এক দশক আগেও প্রায় ১০ হাজার এ প্রজাতির উট ছিল রাজ্যটিতে। সেই সংখ্যা বর্তমানে নেমে এসেছে মাত্র সাড়ে চার হাজারে।
শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চলে দ্রুতগতির শিল্পায়ন এবং অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত খারাই উট টিকে থাকার সহযোগী বাস্তুসংস্থান বিনষ্ট করছে। খাদ্য ও বিচরণ স্থল হারানোয় প্রজাতিটি বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, বলে হুঁশিয়ার করেছেন সংরক্ষণবিদেরা।
পরিতাপের সঙ্গে ৫৩ বছরের আমিন জাট বলেন, ''পূর্বপুরুষেরা এ উটগুলো আমাকে দিয়েছিলেন। এরা আমার সন্তানের মতোই। তাদের মৃত্যু নিজের চোখে দেখাটা কীভাবে মেনে নিতে পারি?''
পশুপালক এবং প্রকৃতি সংরক্ষণবাদীরা এজন্য দায়ি করছেন লবণ উৎপাদক কোম্পানিগুলোর দিকে। বাণিজ্যিক এসব প্রতিষ্ঠান ম্যানগ্রোভ জলাভূমিতে বাঁধ দেয়। ফলে জোয়ারের পানি সহজে সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। এতে শ্বাসমূলীয় বনভূমি দ্রুত শুকিয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে মারা যায় গাছগুলো।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং অন্যান্য শিল্পও পরিবেশ ধবংসে ভূমিকা রাখছে বলে জানায়, সেহজিভান সূত্র।
সংস্থাটির উট পালন প্রকল্পের পরামর্শক মাহেন্দ্র ভানানি বলেন, ''লবণ কোম্পানিগুলো মাটির দেওয়াল তৈরি করে, স্থানীয়ভাবে এটি 'বান্দ' নামেই পরিচিত। জোয়ারের পানি এরফলে প্রবেশ করতে পারে না। এভাবে ধীরে ধীরে পানির অভাবে মারা যায় শ্বাসমূলীয় বনের গাছপালা। গাছগুলো মারা গেলে পরবর্তীতে তাদের যন্ত্র দিয়ে শিকড় সমেত উপরে ফেলাটাও অনেক সহজ হয়।''
'২০১৮ সালে এমন একটি লবণ কোম্পানি মাত্র একমাসে চার বর্গকিলোমিটার ম্যানগ্রোভ বন ধবংস করে'' তিনি যোগ করেন।
লবণ কোম্পানিগুলোর অবশ্য দাবি, তারা অনুৎপাদনশীল জমিকে উন্নয়নের আওতায় এনেছে এবং তাতে স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে।
ইন্ডিয়ান সল্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ভারাত রাভাল বলেন, ''আমরা বিরান জলাভূমিতে সরকারের কাছ থেকে বাণিজ্যিক কাজের অনুমতি পেয়েছে। এসব জমিতে কোনও ফসল উৎপন্ন করা যায় না। আমাদের কর্মকাণ্ডে কিছু মানুষ জীবিকা হারাতে পারেন, তবে সেই সংখ্যা খুবই কম।''
এব্যাপারে গুজরাট ইনস্টিটিউড অব ডেজার্ট ইকোলজির উপকূলীয় এবং জলীয় বাস্তুসংস্থান বিশেষজ্ঞ জি এ থিভাকারান জানান, কিছু কোম্পানি তাদের নিজস্ব ক্ষমতার সবটুকু কাজে লাগিয়ে ম্যানগ্রোভ বনকে অনুৎপাদনশীল বিরান জমি ঘোষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
''দুই দশক আগে নানা শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ বন ধবংসের প্রতীযোগীতায় নেমেছিল। ওই প্রেক্ষাপটে ২০১১ সালে শ্বাসমূলীয় বনভূমিতে শিল্প কর্মকাণ্ড সীমিত করার লক্ষ্যে বেশকিছু কঠোর আইন প্রবর্তন করে সরকার। তবে কোম্পানিগুলো সেই আইনে বিদ্যমান ফাঁক খুঁজে বের করেছে। তারা এখন জোয়ারের পানি প্রবেশের পথে বাঁধ দিচ্ছে। ফলে এক বছরের মধ্যে শ্বাসমূলীয় গাছেরা মারা যাচ্ছে। এরপর ওই জমিকে সরকারের পক্ষ থেকে বিরান ঘোষণা করার সুযোগে শিল্পপ্রতিষ্ঠান জমিগুলো অধিগ্রহণ করছে।
ইতোপূর্বে, ২০১৫ সালে খারাই উটের সংখ্যা হ্রাসের বিষয়টি লক্ষ্য করে ভারত সরকার। এবং প্রজাতিটিকে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা প্রাণির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
সরকার খারাই উটের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় হেলথ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে। পাশাপাশি রাজ্যের বেশকিছু অলাভজনক সংস্থাকে উটগুলোর প্রজনন এবং চিকিৎসা দেওয়ার জন্য অর্থবরাদ্দ দেওয়া হয়।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভারতের জাতীয় পরিবেশ আদালতেও আইনি লড়াইয়ে উল্লেখযোগ্য একটি বিজয় পান খারাই উট পালকেরা।
খারির প্রবেশমুখে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে জোয়ারের পানি প্রবেশে বাধা দেওয়া হচ্ছে কিনা- তা পর্যবেক্ষণে গুজরাট রাজ্য কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেন- এ আদালত। পাশাপাশি শ্বাসমূলীয় বনভূমির বাস্তুসংস্থান রক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়। আদালত কিছু এলাকায় লবণ উৎপাদনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
তবে আইনি লড়াই শেষ কথা নয়। ম্যানগ্রোভ বনকে বাঁচাতে প্রতিনিয়ত লড়তে হচ্ছে পশুপালকদের।
ভানানি বলেন, ''এটা আমাদের নিত্যদিনকার লড়াই। আমরা একটি কোম্পানিকে সরাতে সক্ষম হলে, এক সপ্তাহের মধ্যেই আরেক কোম্পানি এসে হাজির হয়। এ যেন অন্তহীন লুকোচুরির প্রক্রিয়া।
বঞ্চণা অবশ্য সরকারি নীতিমালার মাধ্যমেও হচ্ছে।
ভারতীয় বনবিভাগের মতে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে গুজরাটে উপকূলীয় শ্বাসমূলীয় বনভূমির পরিধি ১,১৪০ বর্গ কি.মি. থেকে ১,১৭৭ বর্গ কি.মিটারে উন্নীত হয়।
তবে আমিন জাট জানান, বনবিভাগের মালিকানায় থাকা ওই জমিতে উট চারণের অনুমতি নেই।
''উট চারণের ঐতিহ্যবাহী জমি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের দখলে আর বনবিভাগ আমাদের খেদিয়ে দেয়। আমরা কোথায় যাব!"
থিভাকরণ জানান, উট পালকেরা ক্ষমতাহীন গোষ্ঠী। তাদের উটের উটগুলো কিছু ছোটগাছ মাড়ালেও তাতে ম্যানগ্রোভ বনের কোনও ক্ষতি হয় না। এজন্য পশুপালকদের দায়ি করাও উচিৎ নয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা এ বনে উট চড়িয়েছে, তাতে কোনও বিরূপ প্রভাব পড়েনি। তাছাড়া, খারাই উট পাতলা এবং দুর্বল শ্বাসমূলীয় গাছের পাতা খায়।
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা- হয়ে দাঁড়িয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কচ্চ অঞ্চলে অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত। গত তিন বছর ধরেই কদাচিৎ বৃষ্টির এ চক্রে পড়েছে এ অঞ্চল।
''ম্যানগ্রোভ বনের পাতায় লবণের পরিমাণ বেশি থাকায়, এগুলো খাওয়ার পড়েই তাদের মিঠাপানি খাওয়ার দরকার হয়। তাই অনিয়মিত বৃষ্টি আমাদের জন্য এক মহাবিপদ। আমরা শুধু আমাদের পশুগুলোর জীবন-ধারণের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও পানীয়ের ব্যবস্থা চাই'' আমিন জাট বলছিলেন।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান