চট্টগ্রামে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নয়নে ৩,৭৪৫ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায়
চট্টগ্রাম নগরীর পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সুষম পানি বণ্টন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নতুন পাইপলাইন, স্মার্ট মিটার স্থাপনসহ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করতে প্রায় ৩,৭৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প নিতে যাচ্ছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।
বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ সহায়তায় প্রস্তাবিত প্রকল্পটির অধীনে ৩০০ কিলোমিটার পাইপলাইন প্রতিস্থাপন ও ৮৭,০০০ স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হবে।
পাশপাশি পানি সরবরাহ ও সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা জোরদারে স্থাপন করা হবে ৪৬টি ডিএমএ (ডিস্ট্রিক্ট মিটারিং এরিয়া)। এছাড়া, শুষ্ক মৌসুমে জরুরি পরিস্থিতির জন্য ৪০টি গভীর নলকূপও প্রতিস্থাপন করা হবে।
এর ফলে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নয়নের পাশাপাশি সংস্থাটির কর্মক্ষমতা ও আয় বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সমীক্ষা সম্পন্ন, ডিপিপি প্রণয়ন ও প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে চলতি বছরের ১৬ অক্টোবর প্রকল্পটিতে সরকারি অর্থায়নের অনুমোদন মিলেছে।
বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (ভৌত ও অবকাঠামো বিভাগ) সোলেমান খানের সভাপতিত্বে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটিও এটি অনুমোদন করে।
প্রকল্পটি এখন সবশেষ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ একনেকের অনুমোদনের পর এর ঋণচুক্তি হবে।
পাইপলাইন নেটওয়ার্ক উন্নতকরণ ও চ্যালেঞ্জসমূহ
চট্টগ্রাম ওয়াসার নথিপত্রের তথ্যমেতে, বর্তমানে নগরীর ১৬৮ দশমিক ২১ বর্গকিলোমিটার এলাকায় প্রায় ১,৩০০ কিলোমিটার পাইপলাইন নেটওয়ার্ক আছে সংস্থাটির। এরমধ্যে কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-০১ এর অধীনে ৪৫ কিলোমিটার, চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন ও স্যানিটেশন প্রকল্পের (সিডব্লিউএসআইএসপি) অধীনে ১৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন নেটওয়ার্ক প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল।
এছাড়া কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-০২ এর অধীনে শহরের মধ্যবর্তী স্থান থেকে ৫৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ৭০০ কিলোমিটার পাইপলাইন প্রতিস্থাপন হয়েছে।
এর বাইরে নগরীর পতেঙ্গা, খুলশী, কাট্টলী, জাকির হোসেন সড়ক, ফয়েজ লেক, আকবর শাহ ও হাটহাজারীর পানি সরবরাহ ব্যবস্থা প্রায় ৪০০ কিলোমিটার পুরাতন পাইপলাইন দিয়ে চলছিল। ফলে এসব এলাকায় পানির চাপ কম। পুরাতন এসব পাইপলাইনের ফলে শহরের দূরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা নিয়মিত পানি পান না। এসব এলাকায়ও পানির চাপ কম।
নগরী ছাড়াও ভান্ডাল-জুড়ির পানি সরবরাহ প্রকল্পের মাধ্যমে বোয়ালখালী, পটিয়া ও আনোয়ারা তিন উপজেলায় নতুন করে ১৩৩ কিলোমিটার পাইপলাইন নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হচ্ছে। চলতি বছর প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার নথিপত্রের তথ্যমতে, পানির সরবরাহ ব্যবস্থাপনার পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চট্টগ্রাম শহরকে ছয়টি হাইড্রোলিক জোনে বিভক্ত করেছে সংস্থাটি। জোনগুলোর শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত কর্ণফুলী সার্ভিস এরিয়া (কেএসএ) জাইকা এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-০২ এর আওতায় পাইপলাইন প্রতিস্থাপনের পাশাপাশি ডিএমএ ব্যবস্থা চালু করায় ৪৬ হাজার সংযোগে নিরবচ্ছিন্নভাবে সুষম চাপে পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে।
অ-রাজস্বভুক্ত পানি এর পরিমাণ ১০ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। এর বাইরে বাকি পাঁচটি জোন— পতেঙ্গা, খুলশী, এ কে খান, বায়েজিদ, অক্সিজেন, কালুরঘাট, চাক্তাই সার্ভিস এরিয়ায় পুরাতন জরাজীর্ণ পাইপলাইন, লিকেজ, অবৈধ সংযোগের কারণে প্রায় ৪০ হাজার সংযোগে নিরবচ্ছিন্ন ও সুষম চাপে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। নতুন প্রকল্পের অধীনে ৪৫ হাজার সংযোগের (নতুন সংযোগসহ) মাধ্যমে ১০-১২ লাখ মানুষ সুবিধা পাবেন।
সংস্থাটির কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, পুরো কর্ম এলাকার জন্য মোট ১৪৫টি ডিএমএ ব্যবস্থা স্থাপন প্রয়োজন। এরমধ্যে কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-০২ এর অধীনে ৫৯টি স্থাপন করা হয়েছে। বাকি ৮৬টির মধ্যে ৪৬টি ডিএমএ নতুন প্রকল্পের অধীনে স্থাপন করা হবে।
মূলত ডিএমএ প্রযুক্তির মাধ্যমে পানি শোধনাগার থেকে রিজার্ভার, রিজার্ভার থেকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফ্লো মিটার এবং সুপারভাইসরি কন্ট্রোল অ্যান্ড ডাটা অ্যাকুইসিশন-এসসিএডিএ সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাধ্যমে প্রতি মুহূর্তের পানি সরবরাহের পরিমাণ ও চাপের তথ্য-উপাত্ত পর্যবেক্ষণ করা যায়।
চট্টগ্রাম ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল আহসান চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পুরাতন পাইপলাইনের মধ্যে যেগুলো ভালো আছে, সেগুলো রাখা হবে। বাকিগুলো পরিবর্তন করা হবে। পাহাড়ি ঢলে পানি ঘোলা বা লবণাক্ততা বৃদ্ধির সময় পরিস্থিতি মোকাবিলায় কালুরঘাটে ৪০টি গভীর নলকূপ প্রতিস্থাপন করা হবে। ডিএমএ ও স্মার্ট মিটার বসালে পানির সরবরাহ, প্রেশারসহ যাবতীয় হিসেব পাওয়া যাবে। নগরীর নাসিরাবাদ ও হালিশহরের দুটি স্টোর সংস্কার করা হবে।"
বসবে ৮৭ হাজার স্মার্ট মিটার, কমবে অ-রাজস্বভুক্ত পানি
চট্টগ্রাম ওয়াসার বর্তমানে ৯১ হাজারেরও বেশি সংযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ৯৩ শতাংশ আবাসিক ও ৭ শতাংশ বাণিজ্যিক। নগরীর প্রায় ৩২ লাখ মানুষ সংস্থাটির সেবার আওতায় রয়েছে। তবে সংযোগ থাকা অন্তত ১০ শতাংশ মানুষ নিয়মিত পানি পান না।
সংস্থাটি দৈনিক পানি উৎপাদনের সক্ষমতা ৫০ কোটি লিটার। এরমধ্যে শেখ রাসেল পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে দৈনিক ৯ কোটি লিটার, শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার প্রকল্প ০১ ও ০২ থেকে ১৪.৩ কোটি লিটার করে মোট ২৮.৩ কোটি লিটার এবং মোহরা পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে ৯ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করা হয়।
মূলত কর্ণফুলী ও হালদা নদী থেকে পানি সংগ্রহ করে পরিশোধন করা হয়। এছাড়া, গভীর নলকূপ থেকে আসে ৪ কোটি লিটার পানি। ভান্ডাল-জুড়ির পানি সরবরাহ প্রকল্প সম্পন্ন হলে ৬ কোটি লিটার সুপেয় পানি উৎপাদন বাড়বে।
সংস্থাটির সমীক্ষা অনুযায়ী, বর্তমানে পানির দৈনিক চাহিদা ৫৬ কোটি লিটার; ২০৩২ সালে হবে ৭০ কোটি লিটার; আর ২০৪০ সালে হবে ১২২ কোটি লিটার।
ওয়াসার উৎপাদিত পানির অ-রাজস্বভুক্ত পানির হার ২৫-৩০ শতাংশ। অথচ বৈশ্বিক মানদণ্ডে এর স্বাভাবিক হার ৫ শতাংশের কম। মাসে ১৪-১৭ কোটি টাকার পানির হিসেব পাওয়া যায় না। রাজস্ব শাখার মিটার পরিদর্শকসহ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে সংস্থাটি বড় অংকের রাজস্ব হারায় বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ। ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি ও দুর্বলতার কারণে সংকট নিরসন করতে পারছিল না সংস্থাটি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন প্রকল্পের অধীনে ৮৭ হাজার অটোমেটেড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হবে। আরেকটি পাইলট প্রকল্পের অধীনের তিন হাজার স্মার্ট মিটার বসানো হচ্ছে। এছাড়া, সংস্থাটির প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালীকরণ ও তথ্যনির্ভর ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে জাইকা সহায়িতায় মিটার রিডিং অ্যাপ, ম্যানেজম্যান্ট ড্যাসবোর্ড এবং এনআরডব্লিউ মনিটরিং টুল বাস্তবায়ন করছে। ফলে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, অবৈধ পানি সরবরাহ বন্ধ এবং অ-রাজস্বভুক্ত পানির হার কমানো সম্ভব হবে।
নতুন প্রকল্পটির অধীনে ১৯টি লো ইনকাম কমিউনিটি (এলআইসি) এলাকার প্রায় ৪০ হাজার নাগরিকের কাছে পানি পৌঁছে দেওয়া হবে। বস্তিবাসী প্রায় ৫০ হাজার নাগরিকের জন্য স্যানিটারি ল্যাট্রিন, উন্নত সেপ্টিক ট্যাঙ্ক, ডিসেন্ট্রালাইজড ওয়েস্টওয়াটার টিটমেন্ট সিস্টেম (ডিইডব্লিউএটিএস) এর মাধ্যমে উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন সেবা প্রদান করা হবে।
এছাড়া আধুনিক গ্রাহকবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার লক্ষ্যে ইউটিলিটি লেভেল ইনস্টিটিউশনাল সিস্টেম অ্যান্ড ক্যাপাসিটিস উন্নতিকরণ, পানি উৎপাদন, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, হিসাব ব্যবস্থাপনা, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাসহ সংস্থাটির সকল কার্যক্রমের একীভূত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আনার লক্ষ্যে এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং (ইআরপি) সিস্টেম প্রবর্তন এবং ৩ বছর কর্মস্থলে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উক্ত সিস্টেম প্রবর্তন; পানি শোধনাগার, পাইপলাইনসহ সকল সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে জিআইএস বেজড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম; আধুনিক স্টোর কাম ওয়ার হাউজ নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে প্রকল্পে।
সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম টিবিএসকে বলেন, "নতুন পাইপলাইন স্থাপন ও ডিএমএর আওতায় আসলে প্রয়োজন অনুসারে পানির প্রেশারও নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করা যাবে। গ্রাহকরা নিয়মিত পানি পাবেন। অ-রাজস্বভুক্ত পানির হারও কমবে।"
কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পে ১,৪০০ কোটি টাকা সাশ্রয়
চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-০২ মোট ১,৪০৭ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। প্রকল্পটির প্রক্কলিত ব্যয় ছিল প্রায় ৪,৪৮৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ৩,০৮২ কোটি ৮৬ লাখ টাকার মধ্যে প্রকল্পটি সম্পন্ন করেছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।
প্রকল্পটির অধীনে দৈনিক ১৪.৩ কোটি লিটার উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন পানি শোধনাগার নির্মাণ, ৬৯২ কিলোমিটার ডিস্ট্রিবিউশন পাইপলাইন, ৫৯টি ডিএমএ ও ৩৫.৩ কিলোমিটার কনভেন্স ও ট্রান্সমিশন পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। ২০২৩ সালের জুনে প্রকল্পটি সমাপ্ত হয়।
চলতি বছরের জুনে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ণ বিভাগ প্রণীত সমাপ্ত প্রকল্পের মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রকল্পের আকস্মিক ব্যয়ের জন্য কন্টিঞ্জেন্সি খাতে ৫২৭ কোটি টাকা বরাদ্দকৃত ছিল। যার এক টাকাও ব্যয় হয়নি।
এর বাইরে সিডি ভ্যাট খাতে ২৭৭ কোটি টাকা, ক্ষতিপূরণ খাতে ১৯ কোটি টাকা, পিআইএসইউ খাতে ৯ কোটি, মেরামত সংরক্ষণ ও পুনর্বাসন খাতে প্রায় ৫ কোটিসহ বেশ কয়েকটি খাতে ব্যয় সাশ্রয় হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, "সরকারি অর্থের কোনো অপচয় করা হয়নি। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় করা হয়নি। এ কারণে সাশ্রয় হয়েছে।"