ন্যায়বিচার ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে
প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়। দিবসটি মানবিক মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং সমতার প্রতি বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতির প্রতীক। তবে এই দিনটি পালন করার সময়, বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের লঙ্ঘনের কঠিন বাস্তবতা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। ফিলিস্তিন এবং ইউক্রেনের মতো সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে যুদ্ধ শুধু অসংখ্য প্রাণই কেড়ে নিচ্ছে না, বরং মানুষের স্বপ্ন, আশা, বাস্তুভিটা ধ্বংস করছে। জীবন, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার অধিকার—যা মৌলিক মানবাধিকারের ভিত্তি—তা থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে।
বাংলাদেশেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতা আমাদের আত্মবিশ্লেষণ এবং সংস্কারের প্রশ্ন জোরেশোরে উদ্রেক করে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে সারাবিশ্বে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। ফিলিস্তিনিদের কয়েক দশকের দখল এবং সংঘাতের কষ্ট তাদের দুর্দশার প্রতি বৈশ্বিক সংহতির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। বেসামরিক লোকেরা সহিংসতার চক্রে আটকা পড়েছে, অহরহ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং প্রতিদিন জীবনের হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে।
একইভাবে, ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে, একটি মানবিক সংকট তৈরি করেছে এবং অগণিত শিশু ও পরিবারকে শোষণের ঝুঁকিতে ফেলেছে। এই অঞ্চলগুলোর সংগ্রাম আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, যুদ্ধ কখনো ভাল কিছু বয়ে আনে না। বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য মানবাধিকার রক্ষা করাই এজন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বিগত বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাস এবং নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি অর্জন করেছে, তবে একইসঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘন গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে। গত কয়েক দশক ধরে শাসনব্যবস্থা, ন্যায়বিচার, আইন প্রয়োগ এবং সামাজিক পরিষেবার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাগত সমস্যাগুলো নাগরিকদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। গণতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হুমকির সম্মুখীন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে প্রায় সমান্তরাল। সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মীরা প্রায়শই ভয়ভীতি, হয়রানি বা নিখোঁজ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছেন এই কয়দিন আগেও।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে নিচের দিকে অবস্থান করছে, যেখানে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো আইন সমালোচকদের চুপ করাতে ব্যবহৃত হয়েছে। নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য গঠিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রায়ই গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে বিগত সরকারগুলোর আমলে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হেফাজতে নির্যাতন এবং হয়রানির ঘটনা বিশেষ করে প্রান্তিক সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুলিশি দায়মুক্তির কারণে জনগণের আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক প্রভাব এবং দীর্ঘসূত্রতার কারণেও ব্যাপকভাবে সমালোচিত। বিচার প্রাপ্তিতে বিলম্ব এবং উচ্চ ব্যয় অনেককেই ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করছে। বাংলাদেশে নারীরা এখনও সহিংসতা, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক সুযোগের অভাবে ভুগছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দুইজন নারীর মধ্যে একজন তাদের জীবদ্দশায় লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার হন। মানসম্মত শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার অধিকার এখনও অনেকের কাছে অপ্রাপ্য। গ্রামীণ এলাকাগুলোতে স্কুল, শিক্ষক এবং চিকিৎসা সুবিধার অভাব রয়েছে। এই খাতে বিগত দিনগুলোতে কোন সরকার মনোযোগ দেয়নি যা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এক বড় অন্তরায় হয়ে দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন মোকাবিলায় একটি সামগ্রিক এবং বহুমুখী পন্থা প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে সংস্কার করতে হবে। স্বাধীন এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামীণ এলাকায় স্কুল-কলেজে দক্ষ শিক্ষক এবং মানবাধিকার-ভিত্তিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্তি করতে হবে এবং তা কীভাবে বাস্তবে চর্চা করা যায় সে ব্যাপারে ভাবতে হবে।
একইসঙ্গে স্বাস্থ্যসেবার বাজেট বাড়ানো, গ্রামীণ ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা এবং চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ বাড়ানো প্রয়োজন। কঠোর আইন প্রয়োগ এবং নারীদের অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করে নারীর ক্ষমতায়ন করতে হবে। বিশ্বজুড়ে যারা মানবাধিকার অগ্রাধিকার দেয় তারা শক্তিশালী অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের উদাহরণ।
যেমন নরওয়ে এবং ফিনল্যান্ড কিংবা জার্মানির মত দেশগুলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তার কারণে সবচেয়ে সুখী দেশ। এসব দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বিচারব্যবস্থা রয়েছে যা তাঁদের মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
গত ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর বাংলাদেশে মানবাধিকার পুনরুদ্ধার এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি এখন কেবল নৈতিক দায়িত্ব নয় বরং জাতীয় উন্নতির পথ। তাই আসুন আমরা প্রতিশ্রুতি নিই যে, আমরা সম্মিলিতভাবে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করব এবং প্রতিটি বাংলাদেশির অধিকার রক্ষায় কাজ করব। তাহলেই কেবল আমাদের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি ও কল্যাণ সম্ভবপর হতে পারে।
সাহারিয়ার রহমান রাজু: ডক্টরাল গবেষক ও একাডেমিক, ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া; সহযোগী অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।