১০৩ দেশের মধ্যে বাংলাদেশে অপরিণত শিশু জন্মের হার সর্বোচ্চ
বাংলাদেশে প্রতিবছর ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৬০০ প্রিম্যাচিউর বা অপরিণত শিশু জন্ম নেয়— যা বিশ্বের ১০৩টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক।
অপরিণত ও কম ওজনে জন্ম নেওয়ার কারণে দেশে প্রতিঘণ্টায় মারা যায় ৩ নবজাতক।
এই প্রিম্যাচিউর মৃত্যুহার কমাতে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত যথাযথ নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তদারকি বাড়াতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। শনিবার (২৩ নভেম্বর) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) আয়োজিত এক কর্মশালায় এমনটিই জানিয়েছেন তারা।
'বাংলাদেশে অপরিণত শিশুর বোঝা, গৃহীত পদক্ষেপ ও উদ্ভাবন' শীর্ষক কর্মশালাটি যৌথভাবে আয়োজন করে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও বিএসএমএমইউ।
আইসিডিডিআর,বি-এর বিজ্ঞানী আহমেদ এহসানুর রহমান দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে 'বাংলাদেশে অপরিণত শিশুর বোঝা, গৃহীত পদক্ষেপ ও উদ্ভাবন' শীর্ষক উপস্থাপনায় জানান, বাংলাদেশে মোট জন্ম নেওয়া শিশুর মধ্যে ১৬.২ শতাংশই অপরিণত শিশু; ভারতে এই হার ১৩ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ১৪.৪ শতাংশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, ২,৫০০ গ্রামের কম ওজন নিয়ে কোনো শিশু জন্মালে তাকে এলবিডব্লিউ বা লো বার্থ ওয়েট শিশু বলা হয়। বাংলায় যাকে বলা হয় স্বল্প ওজন নিয়ে ভূমিষ্ঠ শিশু। বাংলাদেশে এই হার ২৩ শতাংশ।
২০২০ সালে ১৫৮টি দেশের মধ্যে এলবিডব্লিউ-এর সংখ্যায় বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
দেশে বছরে ৭ লাখ এলবিডব্লিউ এবং ৫ লাখ অপরিণত শিশু জন্মালেও মোটের উপর ৫ শতাংশেরও কম শিশু সুচিকিৎসা পায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহ আগে জীবিত জন্ম নেওয়া শিশুদেরকে প্রিম্যাচুরিটি বা অপরিণত শিশু বলে। এ ধরনের শিশুরা মূলত এলবিডব্লিউ হয় এবং বেঁচে থেকে এদের সুস্থ জীবনে ফেরার ক্ষেত্রে মারাত্মক ঝুঁকি থাকে।
চিকিৎসকদের মতে, সময়ের আগেই জন্ম নেওয়া এসব অপরিণত শিশুদের মৃত্যুর ঝুঁকির পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য জটিলতার ঝুঁকিও থাকে। অপরিণত শিশুরা সেরিব্রাল পালসি, মানসিক বিকাশে বিলম্ব, মৃগীরোগ-সহ অন্ধত্বের ঝুঁকিতে থাকে।
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ মেজর (অব.) ডা. লায়লা আরজুমান্দ বানু বলেন, অপরিণত শিশু জন্ম বিভিন্ন কারণে হতে পারে। বিশেষ করে, গর্ভকালীন সময়ে কোন ইনফেকশন, জরায়ু ছোট থাকলে বা জরায়ুতে কোনো টিউমার থাকলে অপরিণত শিশু হতে পারে। মায়ের উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্টের অস্বাভাবিকতা, কিডনির সমস্যা, গর্ভাবস্থায় যথেষ্ট ওজন বেড়ে যাওয়া, অত্যধিক ওষুধ সেবন করলে অপরিণত নবজাতকের জন্ম হতে পারে।
"তবে অনেক ক্ষেত্রে অপরিণত শিশু জন্মের কোনো কারণ থাকে না, উপসর্গ দেখে চিকিৎসা দিতে হয়। অপরিণত শিশু জন্ম প্রতিরোধে সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি," যোগ করেন তিনি।
পদক্ষেপ ও সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ
গত এক দশকে বাংলাদেশে ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (কেএমসি) এবং নবজাতকের জন্য বিশেষ সেবা ইউনিট (স্ক্যানু) এর মতো সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
বিএসএমএমইউ-এর নিওনেটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল মান্নান জানান, এই পদক্ষেপগুলো অপরিণত শিশু মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সহায়তা করেছে।
২০১৮ সালে দেশে নবজাতকদের জন্য ৫৭টি কেন্দ্রে কেমসি সুবিধা ছিল, যা ২০২৪ সালে এসে ৪৬৮টিতে বেড়েছে। ২০১৮ সালে কেএমসি কেন্দ্রগুলোতে ভর্তি হওয়া নবজাতকের সংখ্যা ছিল ১,৪৬২; সেখান থেকে ২০২৪ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯,১৭৮-এ। তবে, এই নবজাতকের মধ্যে মাত্র ১৬ শতাংশ মানসম্পন্ন যত্ন পেয়েছে।
সময়ের সাথে দেশে স্ক্যানু সুবিধাও প্রসারিত হয়েছে। ২০১১ সালে যেখানে মাত্র দুই জেলায় এই সুবিধা ছিল, সেখানে এখন দেশের ৬২টি জেলাতে এটি প্রসারিত হয়েছে। এরপরেও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই সুবিধায় এখনও কিছু অগ্রগতির প্রয়োজন রয়েছে।
নীতি এবং পদ্ধতিগত পরিবর্তনের জন্য আহ্বান
কর্মশালায় বিশেষজ্ঞরা স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ফাঁকগুলো মোকাবেলায় জোর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিএসএমএমইউ-এর পেডিয়াট্রিক্স বিভাগের অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার দে অপরিণত ও এলবিডব্লিউ শিশুমৃত্যু কমাতে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রচারণা চালানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচির প্রকল্প ব্যবস্থাপক ডা. মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, "ঢাকা বাইরের অধিকাংশ চিকিৎসা কেন্দ্রে গর্ভাবস্থায় কম ওজন ও অপরিণত শিশু শনাক্তের ব্যবস্থা নেই। দক্ষজনবলের অভাব রয়েছে। অনেক হাসপাতালে ওজন মাপার ডিজিটাল যন্ত্র নেই।
"আবার বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রের অবস্থা আরও নাজুক। তারা কোনো তথ্য দিতে চায় না," বলেন তিনি।
এদিকে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি, বিশেষজ্ঞরা পদ্ধতিগত পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন। প্রসব পূর্ববর্তী কর্টিকোস্টেরয়েড এবং সময়ের আগেই প্রসব হয়ে গেলে, সেক্ষেত্রে অপরিণত শিশুর সুচিকিৎসা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও সুবিধাসমূহ সহজপ্রাপ্য হওয়া জরুরি বলে মনে করেন তারা।
কর্মশালায় বিশেষজ্ঞরা আরও উল্লেখ করেন, অপরিণত শিশুরা প্রায়ই শ্বাসকষ্ট এবং মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ-সহ গুরুতর জটিলতার সম্মুখীন হতে পারে। জন্মের কিছুক্ষণ আগে স্টেরয়েড ইনজেকশন দিলে এই ঝুঁকিগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পরে বলে জানান তারা, যদিও দেশে এ ইনজেকশন এখনও অতটা সহজলভ্য নয়।
নবজাতকের চিকিৎসাক্ষেত্রে সাম্প্রতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোতে আরও বিনিয়োগ, দক্ষ কর্মী এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কর্মশালায় নীতিনির্ধারকদেরকে তারা এ বিষয়গুলোতে অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।