সবুজ সেই বুনো হাঁসের কথা
একসময় শীতলক্ষ্যা নদীতে নানা জাতের জলচর পরিযায়ী পাখি আসত। এদের মধ্যে একটা বিরাট অংশ ছিল বিভিন্ন জাতের বুনো হাঁস। গ্রামের ঐতিহ্যবাহী পরিবারগুলোর বন্দুকধারী লোকজন শীতের সময় বুনো হাঁস শিকারকে ঐতিহ্যের অংশ বলে মনে করত। আমার পিতা এবং পিতামহ শীতের সময় ব্যস্ত হয়ে পড়তেন শিকারে। কালচক্রে সেই নেশা আমাকেও পেয়ে বসে। কার্তিকের হিমেল হওয়া বইতে শুরু করলেই পরিযায়ী পাখিরা আসা শুরু করত। আর তখনই বেড়ে যেত শিকারিদের তৎপরতা। নৌকা নিয়ে সেই ভোরে বেরিয়ে পড়তাম। এসব কথা এখন ভাবলে নিজেকে খুবই অন্যায়কারী একজন মনে হয়।
শীতের সময় নদীর বুকে নৌকা নিয়ে ঘুরতে গিয়ে কত জাতের বুনো হাঁসের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত: সাদা রাজহাঁস, ধূসর রাজহাঁস, ছোট-বড় সরালী, চখাচখি, পিনটেইল বা লেঞ্জা হাঁস, নীলশির, মেটে হাঁস ইত্যাদি। শিকারের নেশার পথ ধরেই আমার সঙ্গে এদের প্রথম পরিচয়। কিন্তু কখনো যদি কোন পাখিকে চিনতে না পারতাম, সেটাকে জানার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যেতাম। কারণ, তখন পাখি কিংবা বন্য প্রাণীবিষয়ক তেমন কোনো ধরনের বই-পুস্তক ছিল না বাজারে। যাক সে কথা। ডিসেম্বরের এক শীতল বিকেলে শিকার শেষে নৌকায় করে বাড়ির দিকে ফিরছিলাম। তখনই চোখে পড়ে নদীর চরে ছোট্ট একটি বুনো হাঁস বসে আছে। আমি তখন শটগানের ৮ নম্বর কার্তুজ দিয়ে হাঁসটিকে গুলি করলাম। সেটি সাথে সাথে বালুচরে লুটিয়ে পড়ল। মাঝি নৌকা নিয়ে হাঁসটির কাছাকাছি গেল। তারপর মৃত বুনো হাঁসটিকে নৌকায় তুলে হাতে নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। এ ধরনের হাঁস আগে কখনো দেখা হয়নি। তাই বাড়িতে এসে মৃত বুনো হাঁসটির কয়েকটি ছবি তুলে রাখলাম।
কালচক্রের আবর্তে বন্য প্রাণিজগতের সূত্র ধরেই আমার সঙ্গে পরিচয় ঘটে দেশের খ্যাতনামা পাখি বিশারদ শরীফ খানের সঙ্গে। আজ আমাকে অনেকেই একজন বন্য প্রাণী সংরক্ষক হিসেবে চেনে, এটা মূলত ওই মহৎ মানুষটিরই অবদান। তার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তিনি আমাকে বলেন, 'শিকার নয়, দেশের জন্য এখন বন্য প্রাণী সংরক্ষণ খুবই জরুরি একটি বিষয়। বন্দুক ছেড়ে ক্যামেরা হাতে তুলে নাও। হত্যা কিংবা মৃত্যু নয়, বরং এদের বাঁচিয়ে রাখার কাজে মন দাও। এরা বেঁচে না থাকলে পৃথিবীও ভালো থাকবে না। বন্য প্রাণী সম্পর্কে তোমার যেটুকু জ্ঞান আছে, সেটাকে সঠিক পথে কাজে লাগাও।' আমি আজ পর্যন্ত তার প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছি। এই পাখি বিশারদের কাছে আমি একদিন সেই সবুজ পাখার বুনো হাঁসের ছবিটি নিয়ে যাই। ছবি দেখে প্রথম দিন তিনি কিছু বলেননি। দু-তিন দিন পর তার সঙ্গে দেখা হলে জানান, ছবিটি হচ্ছে আট-নয় মাস বয়সী একটি বালিহাঁসের।
বালিহাঁস হচ্ছে বুনো হাঁসদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট প্রজাতির হাঁস। ইংরেজি নাম Cotton teal এবং বৈজ্ঞানিক নাম Nettapus Coromandelianus. একসময় বাংলাদেশের নদী-বিল-হাওরে অনেক বালিহাঁস দেখা যেত। কিন্তু ক্রমাগত শিকারের পাশাপাশি আবাসস্থল এবং আশ্রয়স্থল বিনষ্টের কারণে এই প্রজাতির হাঁসের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। তবে এখনো বাংলাদেশের কিছু স্থানে বালিহাঁসের দেখা পাওয়া যায়।
একসময় নরসিংদী এবং গাজীপুর অঞ্চলেও প্রচুর বালিহাঁস ছিল। আসলে আমি সেই হাঁসটিকে চিনতে পারিনি সেটি কম বয়সী হওয়ার কারণে। কারণ, ডিম থেকে ফোটার পর পূর্ণবয়স্ক হওয়ার আগপর্যন্ত পাখিদের শরীরে রঙের অনেক ধরনের পরিবর্তন আসে। কিন্তু শরীফ খানের অভিজ্ঞ চোখ ঠিকই বিষয়টা ধরতে পেরেছিল। আমাদের এলাকায়, অর্থাৎ নরসিংদীতে বালিহাঁস আঞ্চলিকভাবে 'কটগাই' নামে পরিচিত ছিল। এদের আরও বহু ধরনের আঞ্চলিক নাম রয়েছে।
বালিহাঁসকে বলা হয় বর্ষাকালের পাখি। কারণ, এই সময়টাতেই প্রকৃতিতে এদের সবচেয়ে বেশি আনাগোনা লক্ষ করা যায়। আর এটাই ওদের প্রজননের সময়। এরা সাধারণত মরা তালগাছ বা খেজুরগাছের মাথায় বাসা বানাতে পছন্দ করে। তবে পুরোনো দালানের ফাঁকফোকরেও এরা বাসা তৈরি করে থাকে।
বালিহাঁসের ডিম হয় ৭ থেকে ১৩টি। বাবা এবং মা পাখি পালা করে ডিমে তা দেয়। এখানে একটি মজার ব্যাপার আছে। ডিম তো সব এক সময়ে পাড়ে না। তাই প্রথম ডিমটি আগে ফোটে। তাই অনেক সময় দেখা যায় মা হাঁস আগে ফুটে যাওয়া বাচ্চাকে ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে বিলের জলে রেখে আসে। এভাবে একেক করে সব বাচ্চাকে চারণক্ষেত্রে নিয়ে যায় তারা। বালিহাঁসের বাচ্চা দেখতে খুবই সুন্দর হয়। এরা ডুবসাঁতারে খুবই পটু।
এই হাঁসের ছোট ছোট বাচ্চারা কিন্তু বাবা-মার মুখ থেকে খাবার খায় না। নিজেরাই নিজেদের খাবার সংগ্রহ করে। জন্মের পর থেকে এরা প্রকৃতির কাছ থেকেই আত্মরক্ষার কৌশল শিখে নেয়। কারণ, মানুষ ছাড়াও অনেক ধরনের প্রাণী সর্বদা বিপদের কারণ হয়ে ওদের আশপাশে অবস্থান করে।
বর্তমান সময়ে শুধু বালিহাঁস নয়, প্রতিটি প্রজাতির জলচর পাখির জীবন এক বিশেষ হুমকির সম্মুখীন। বিগত সময়ে আগ্নেয়াস্ত্রের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি বালিহাঁসের মৃত্যু ঘটত এয়ারগানধারী শিকারিদের হাতে। তবে আইন করে এয়ারগানের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা খুবই আশার কথা। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কারণটি রয়েছে, তা হলো পরিবেশ বিপর্যয়। উন্নত জাতের মাছ চাষের নামে একের পর এক প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো পরিষ্কার করে উন্নত জাতের মাছ চাষ করা হচ্ছে। নদীগুলো নষ্ট হয়েছে শিল্পবর্জ্যের প্রবল দূষণে। তাই নদী কিংবা বিল-হাওর কোথাও আজ বালিহাঁসের নিরাপদ আশ্রয় নেই। প্রকৃতিতে এদের আবার স্বাভাবিক সংখ্যায় ফিরিয়ে আনতে দরকার জনসচেতনতা এবং শক্তিশালী একটি পরিবেশ আন্দোলনের। আর এ জন্য এগিয়ে আসতে হবে সকল সচেতন নাগরিককে।