সিনেমা হলের ভেতর দিয়ে
১
আমার কাছে চট্টগ্রাম শহরের মানচিত্রের পিনপয়েন্ট মানেই অনেক সিনেমা হল, অন্তত নব্বই দশকে। বড় পর্দা মানেই সিনেমা হল। পৃথিবীর মতো পর্দাও ছোট হতে হতে হাতের তালুতে চলে আসার পর বিপর্যয়ের শুরু। যৌথ পরিবারের আনন্দ-বেদনা ছিন্ন করে অণু পরিবারের শরিকি বাড়ি থেকে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার বর্তমান। সম্মেলনের একত্র মুহূর্ত বাতিল করে একক ফ্ল্যাটে। একা একা সব অনুভূতির আস্বাদন। যেন পটেটো স্টিকসের বিজ্ঞাপন—একা একা খেতে হয় দরজা বন্ধ করে খাও। বড়জোর ব্যক্তি ও তার পার্টনার আর ছানাপোনারা, আর কেউ নয়। বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডের নিচে আমাদের অতীত চাপা পড়েছে। এসব ইতিহাসের অনেক সমাজবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ আছে। আপাতত সেসবে না গিয়ে আমার শহরের সিনেমা হলগুলো নিয়ে কয়েকটা কথা লিখি। এই লেখার অবসরে, শৈশব-কৈশোরের আমির সঙ্গেও দেখা হয়ে যেতে পারে।
আমার কাছে সিনেমা হল মানে সিঙ্গেল স্ক্রিন। মাল্টিপ্লেক্সের দম আটকে আসা পশ প্রিভিলেজড ব্যাপার আমার পোষায় না। ঘাম নেই, বিদ্যুৎ চলে গেলে সম্মিলিত গালাগাল, খিস্তি—যাকে বলে প্রাণের আরাম নেই। রোমান্সের মুহূর্তে সিন কেটে নিলে আঞ্চলিকে 'সিন হডে' বলে হল্লা তৈরি নেই, সব সুখী সুখী ব্যাপার। যেন সাহেব বিবির বৈঠকখানা। খইভাজাকে পপকর্ন বলে, লোকে খাচ্ছে না সিনেমা দেখতে বসছে বোঝার উপায় নেই। নব্বই দশকের প্রথম দিকের রোমান্সেও ছিল ড্রেস সার্কেল বক্সের আড়াল, কান পাতলে আজও যেন নূপুরের আওয়াজ শুনি। ফিসফিস অস্ফুট ধ্বনি—যা দুষ্টু! জলসাঘরের প্রবল প্রতাপ জমিদারের উৎসব ফুরিয়েছে, ঝাড়লণ্ঠন চৌচির। ঘুমে ঢুলছিলাম... হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বেজে উঠল। আত্মাই ঘাড় ধরে দাঁড় করিয়ে দিল। তখনো দেশপ্রেম ছিল। সদ্য ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মিশনারি স্কুলে ভর্তি। সেই স্কুলের রোল তেইশ, ক্লাস ফোর বসে আছে খুরশিদ মহলে। জীবনের প্রথম সিনেমা হল, একা একা। চিত্রনায়ক রুবেলের দ্বৈত অভিনয়। 'অন্যায় অত্যাচার'। সিনেমা হলের উল্টো দিকেই জহুর হকার মার্কেট। আমরা আদর করে বলি, ন্যাংটা বাজার। সবার সব জিনিস পাওয়া যায় সুলভে। জামা জুতো শীতের সোয়েটার সব। তা খুরশিদ মহল থেকে একটু এগিয়ে গেলে সিনেমা প্যালেস—বিখ্যাত কৃষ্ণচন্দ্র দে, কেসি দে রোডের পাশ ঘেঁষে, হিন্দু-অধ্যুষিত হাজারী গলির একটা মুখ বেরিয়েছে এদিকে। সিনেমা প্যালেস তখন রমরমা দশা—এখনো আছে ভাঙা, টিমটিম করে চলে। খুরশিদ মহল সিনেমা হল আর মহল মার্কেট। মার্কেটের গলিতে সকাল সকাল ঢাকার সব দৈনিক আসে। নতুন পত্রিকার গন্ধে ভরে থাকে কিছু সময়। হয়তো তা শৈশবের গন্ধ।
সাধু মিষ্টি ভান্ডারের দোতলার বাসা থেকে নেমে লালদীঘির দিকে হাঁটলেই রঙ্গম সিনেমা। এক টিকিটে দুই ছবির প্রথম পাঠ। এখন কমিউনিটি সেন্টার। সিনেমা হলের পাশেই আব্দুর রহমান স্মৃতি পাঠাগার ছিল। দীনেন্দ্র কুমার রায়ের রবার্ট ব্লেক রহস্য সিরিজ আমার প্রথম পড়া ওই পাঠাগারে—যখন মেডিটেশন করি মাঝে মাঝে অতি ছেলেবেলার সেই রঙ্গম সিনেমার কাঠের চেয়ার, স্মৃতি পাঠাগারের টিমটিমে আলো আর সদাশয় গ্রন্থাগারিকের—'ওঠো খোকা, বাসায় যাও। সন্ধ্যা হয়েছে পড়তে বসো।' কানে ভাসে। আমি ক্লাস ফোর কি ফাইভ, হেসে বলছি—আমি তো পড়ছিই। তিনি হেসে ফেলতেন। বাসায় ঢোকার পথে কড়াই থেকে নামানো গরম রসগোল্লা মাত্র গামলায় ট্রান্সফার হয়েছে। হয়তো দুটো ধোঁয়া ওঠা রসগোল্লা প্লেটে নিয়ে খেয়ে ফেললাম ফুলো পাউরুটি দিয়ে। আমার দাদুর দোকান। আমি তো তখন হ্যাপি প্রিন্স।
২
একেক দিন তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে গেলে দূরে যেতাম বাসে। অল্প বয়সে আগ্রাবাদ মানে অনেক দূর। গোঁসাইল ডাঙ্গা কাকার বাসা। কয়েক বছর আগে সপরিবারে এখান থেকে ভারত চলে গেছেন, নানা কারণে। বনানী কমপ্লেক্স তখন শহরের অভিজাত সিনেমা হল। সবচেয়ে সুন্দর। বাংলা সিনেমাই দেখাত। একবার আলাদা করে টাইটানিক দেখানো হলো। টিকিটটা আলাদা করে ছাপানো সিনেমার ছবি দিয়ে। মনে পড়ে, শুরুতে জলের তলায় গ্র্যান্ড পিয়ানো দেখে একজন উত্তেজনায় বলে উঠল, দেখেছ কত বড় হারমোনিয়াম! বনানীর উল্টো দিকেও সিনেমা হল ছিল। যেমন আরেকটু এগিয়ে গেলে সাগরিকা। স্মৃতি মাঝে মাঝে প্রতারণা করে তবু নিউমার্কেটের পাশেই জলসা সিনেমায় সালমান শাহের মৃত্যুপরবর্তী শেষ পূর্ণাঙ্গ ছবি 'সত্যের মৃত্যু নেই' দেখা ভুলব না। এই ভিড়ের সাথে একমাত্র তুলনীয় হতে পারে ওয়াসা থেকে কাজীর দেউড়ি যাওয়ার পথে রাস্তার একেবারে ওপরে আলমাসে 'আগুনের পরশমণি' দেখার ভিড়ের সাথে। হুমায়ূন আহমেদ তখন প্রাণের দেবতা, রবীন্দ্রনাথকে অনেক দূরের মনে হতো। জলসা আর আলমাসে বিশেষ করে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষেরা যেতেন। আমি যখন একদম ছোট, দোলনায় দুলি, আমাকে বাবার কাছে দিয়ে মা-পিসিমণিরা মাঝে মাঝে যেতেন জলসা, বনানী বা আলমাসে। তখন প্রায় মধ্যবিত্ত পরিবারে নিয়মিত বাংলা ছবি দেখার অভ্যাস ছিল। আমার জেঠিমা ছোট ডায়েরিতে পত্রিকা থেকে সিনেমার নাম টুকে রাখতেন। পাড়ার দোকান থেকে ভিএইচএস ক্যাসেট নিয়ে এসে ভিসিআরে দেখতেন সবাইকে নিয়ে। নায়ক-নায়িকা হাত ধরে হাঁটলে মা আমার চোখে শাড়ির আঁচল ফেলে দিতেন। তখন তো অনেক ছোট। কোলে শুয়েই দেখা। প্রথম দেখা হিন্দি ছবি আনোখা বন্ধন। শাবানা আজমি ছিলেন। রামের সুমতি অবলম্বনে। প্রচুর কেঁদেছিলাম বলে আজও মনে আছে। শরৎ সাহিত্যে আমার অনুপ্রবেশ সিনেমার ভেতর দিয়ে।
আলমাস আর পাশের দিনার দুটোই ছিল মুক্তিযোদ্ধা ট্রাস্টের সম্পত্তি। এখন ভবন আছে কেবল। দিনারে চলত ইংরেজি অ্যাকশন ছবি নানা রকম। তখন ঈদ মানে মানুষের উপচে পড়া ভিড়, আনন্দ। সালমান শাহ, রুবেল খ্যাতির মধ্য গগনে। ওমর সানি উঁকি দিচ্ছেন। হুমায়ুন ফরিদী পর্দায় এলেই হল হাততালিতে ফেটে পড়ে। শহীদুল ইসলাম খোকন মানে ফর্মুলা ছবির বাইরে নতুন কিছু। থ্রিলার, ফাইটে নতুনত্ব। পোশাকশ্রমিকদের ছোট শিশুদের আলাদা যত্ন জরুরি, এই কথা প্রথম বললেন খোকন—'পালাবি কোথায়' ছবিতে। ছবিটা দর্শক নিল না, সুপার ফ্লপ। প্রযোজক ফরিদীর দেউলিয়া হবার দশা। সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা চলচ্চিত্র। নায়িকার মুখ নায়কের মাথার আড়ালে গেলেই ভেবে নিতাম চুমু। তখন কোথায় ত্রুফো! ক্লোজ আপ বা ফ্রিজ শট!
৩
উচ্চমাধ্যমিকের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ, চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র এই দুই সংগঠনের সূত্রে বিশ্বের নানা দেশের ভালো সিনেমা, সিনেমার তত্ত্ব নানা জিনিস দেখা বোঝা শুরু। তখন আরেক ধরনের সিনেমা হল। ভালো সব বিদেশি ছবি। খটকা লাগত, বিদেশি ছবির নগ্নতাকে বলছি শিল্প, দেশে সামান্য চুমুটাও নেই, ফুলের ঠোকাঠুকি দেখতে গিয়ে অলমোস্ট প্রথম কৈশোর গেল। পরে জানলাম, শিল্প কাকে বলে, প্রয়োগের নৈপুণ্য। চিত্রকলা, ভাস্কর্য আর সুরের সন্ধান পাওয়ার পর মনে হলো, চলচ্চিত্র আরেকটু বুঝতে পারছি। তখন সিডি, ডিভিডির যুগ। সহদেবদার 'পিজন' থেকে ভাড়া এনে দেখি নিজের কম্পিউটারে। আহা! তাঁর আত্মার সদগতি হোক। ঘরের ভেতর সেই প্রথম একধরনের সিনেমা হল। নিভৃত কান্নার পরিসর জুটল। কিন্তু সিঙ্গেল স্ক্রিন যাওয়া ছাড়িনি। 'সুস্থ' রুচির বিদেশি ছবি দেখতে গিয়ে আমার দেশের তথাকথিত অসুস্থ রুচিকে আমি ভুলিনি। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি যে কদিন টিকে ছিল, তাঁদের কারণেই। যে এক্সট্রা নারী বা পুরুষ নেচে অন্ন সংস্থান করতেন, তার মুখ তো আমরা মনে রাখিনি।
স্টেশন রোডের উজালা সিনেমা হল একদিন বন্ধ হয়ে গেল। আমরা নিয়মিত ছবি দেখতাম। একই নামে এক বইদোকান ছিল নিউমার্কেটে। নতুন রেলস্টেশনে ঢোকার মুখে উল্টো দিকে এখন যে নুপুর মার্কেটে পাঠ্যবইসহ নানা দুষ্প্রাপ্য বইয়ের বাজার, সেখানে ছিল দুটি সিনেমা হল—নুপুর আর মেলোডি। পরেরটাতে ইংরেজি ছবি চলত। চড়া দাম টিকিটের।
সদরঘাটের লায়ন সিনেমা তো ইতিহাস বিখ্যাত। এটি ছিল কমলবাবুর থিয়েটার। ১৯০৭ সালের জুনের সতেরো তারিখ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম আসেন। সোমবারের সকাল ছিল বৃষ্টিবিঘ্নিত। আগের রাত থেকেই বৃষ্টি। তাঁর প্রচুর শুভানুধ্যায়ী ছিলেন এই শহরে। সোমবার ভোরে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে গুণী নাগরিকেরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। 'ভাণ্ডারী' পত্রিকার সম্পাদক কেদারনাথ দাশগুপ্ত তো রবীন্দ্রনাথের সুহৃদ ছিলেন। পরদিন সকালে কর্ণফুলী নদী ঘুরে দেখেন তিনি। সেদিন বিকেলে কমলবাবুর থিয়েটারে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। বক্তৃতায় তিনি ঐক্যের প্রয়োজনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সেদিন উপস্থিত নগরবাসীর রবীন্দ্রকণ্ঠে গান শোনার বিরল সৌভাগ্য ঘটে।
গিউসেপ্পে তোরনাতরের ফিল্ম সিনেমা প্যারাডিসোর ছোট্ট ছেলেটার মতো আমার স্মৃতির মধ্যে আজও এই শহরের সিনেমা হলেরা উজ্জ্বল। অধিকাংশ হল আজ লুপ্ত। কাজীর দেউড়িতে পুরোনো ঝুমুর সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ এখন নতুন করে আবার চেষ্টা করছেন নতুন নামে। সুগন্ধায় গেলে ছেলেবেলা মনে পড়ে। ইচ্ছে করেই সিনেপ্লেক্সের আলাপ তুললাম না। অত সুখী সুখী জিনিস, যেখানে অতি সাধারণ মানুষ নেই, তাকে সিনেমা হল বলতে আমার বাধে। তবে সেই ভিএইচএস থেকে সিডি হয়ে সিনেমা যে মেমোরি কার্ডে ঢুকে যাবে, এতখানি ভাবিনি। নতুন সময়ে, কোনোভাবে সিঙ্গেল স্ক্রিন ফিরিয়ে আনা গেলে নাগরিকেরা সপরিবারে হলে ফেরার পরিসর পেত। অবশ্য তাদের হৃদয় স্পর্শ করার মতো ছবিও লাগবে ধারাবাহিকভাবে। বছরে একটা বা দুটো অত্যন্ত ব্যবসাসফল ছবি দিয়ে হলে দর্শক নিয়মিত আনা যাবে না। আমার বিশ্বাস, সবাই মিলে ভাবলে আর কাজে নেমে পড়লে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরবে। স্মৃতি আবার বর্তমান হয়ে উঠবে।