জুলাই-অক্টোবরে আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত ১ বিলিয়ন ডলার
ওভারডিউ রপ্তানি আয় দেশে আসায় এবং স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধ কমার কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে দেশের ব্যালান্স অভ পেমেন্টের (বিওপি) অন্যতম উপাদান আর্থিক হিসাবের উদ্বৃত্ত ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগের অর্থবছরের (২০২৩-২৪) একই সময় শেষে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ছিল ৮৭৩ মিলিয়ন ডলার।
আর্থিক হিসাবের মাধ্যমে একটি দেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের বিনিয়োগ, ঋণ ও আর্থিক সম্পদের প্রবাহ চিহ্নিত করা হয়।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন টিবিএস-কে বলেন, 'বিওপিতে নিট ট্রেড ক্রেডিট ডেফিসিট অনেক কমে এসেছে। এর মানে হলো আমাদের যেসব রপ্তানি আয় বিদেশে আটকে ছিল, সেগুলো দেশে আসছে। ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট সারপ্লাস (আর্থিক হিসাব উদ্বৃত্ত) হওয়ার এটি অন্যতম কারণ এবং পুরো বিওপির মধ্যে সবচেয়ে ভালো খবর।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ট্রেড ক্রেডিট ঘাটতি ৫০৪ মিলিয়ন ডলার থেকে কমে মাত্র ৩ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এ ঘাটতি কমেছে প্রায় ৯৯.৪০ শতাংশ।
তবে এ সময়ে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ১৯.৮ শতাংশ এবং মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৩৫ শতাংশ কমেছে।
জাহিদ হোসেন বলেন, 'এফডিআই আসার পথে যেসব প্রতিবন্ধকতা ছিল, সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর সেখানে এখনও উল্লেখযোগ্য সংস্কার হয়নি। এর জন্য কিছুটা সময় প্রয়োজন। এর বাইরে বাণিজ্য-সংক্রান্ত অর্থায়নও কমে এসেছে। নতুন বৈদেশিক ঋণ পাওয়া যাচ্ছে কম; সে তুলনায় পুরনো ঋণ পরিশোধের চাপ রয়েছে।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, মার্কিন ফেডারে রিজার্ভ তাদের নীতি সুদহার কমিয়েছে। ফলে বিদেশি ব্যাংক ও বিনিয়োগকারীরা অন্যান্য দেশে বিনিয়োগ যে হারে কমিয়ে নিয়ে আসছিল, সে গতি কমেছে।
বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে ১২ শতাংশ
রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হওয়ায় এবং আমদানি খুব বেশি না বাড়ায় গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময় শেষে বাণিজ্য ঘাটতি ১১.৭২ শতাংশ কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর শেষে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬.৬৬ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৭.৫৪ বিলিয়ন ডলার।
এই সময়ে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮.৩ শতাংশ এবং আমদানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ শতাংশ।
জাহিদ হোসেন বলেন, 'বাণিজ্য ঘাটতি কমে যাওয়াকে সোজা ভাষায় ভালো বা খারাপ বলা যাবে না। তবে জুলাই মাসজুড়ে অস্থিরতা থাকার পরও এই সময়কালের রপ্তানি প্রবৃদ্ধিকে ভালো বলতে হবে।'
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, 'আমাদের আমদানি প্রবৃদ্ধি কয়েক মাস আগেও নেগেটিভ ছিল, এখন সেটা অল্প হলেও পজিটিভ হয়েছে। তবে আমাদের দেখতে হবে আমদানিটা বেড়েছে কোথায়। জুলাই মাসের অস্থিতিশীলতা ও পরে বন্যার কারণে উৎপাদনে কিছুটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আমদানি কিছুটা বাড়তে পারে।'
বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, বাণিজ্য ঘাটতি কমে যাওয়া একদিক থেকে ভালো হলেও আমদানি খুব বেশি না বাড়া আমাদের মতো অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। কারণ, আমদানি কমে যাওয়ার মানে হলো বিনিয়োগ ও উৎপাদন কমে যাওয়া। বিনিয়োগ ও উৎপাদন চালু থাকলে আমদানিতে প্রবৃদ্ধি ভালো হতো বলে মন্তব্য করেন তারা।
চলতি হিসাবে ঘাটতি কমেছে ৭৬ শতাংশ
ঊর্ধ্বমুখী রেমিট্যান্স প্রবাহে ভর করে চলতি অর্থবছরের জুলা-অক্টোবর সময়ে দেশের চলতি হিসাবে ঘাটতি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৭৬ শতাংশ কমে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে দেশের চলতি হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭৫২ মিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময় শেষে এ ঘাটতি ছিল ১.১৬ বিলিয়ন ডলার।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৮.৯৪ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের এই চার মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ৬.৮৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২.০৬ বিলিয়ন ডলার বা ৩০ শতাংশ।
এ বিষয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, মূলত রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হওয়ার কারণে চলতি হিসাবের ঘাটতি কমে এসেছে। 'রেমিট্যান্স বাড়ার অন্যতম কারণ ক্যাপিটাল ফ্লাইট কমে যাওয়া এবং ফরমাল ও ইনফরমাল চ্যানেলের মধ্যে ডলারের রেটের পার্থক্য কমে আসা।'
অনানুষ্ঠানিক বাজারে ডলারের চাহিদা কমেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, চাহিদা কমায় ডলারের দামও কমেছে।
তবে এটা নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই উল্লেখ করে জাহিদ হোসেন বলেন, 'অতীতেও দেখেছি নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন নতুন অর্থপাচারকারী তৈরি হয়। এবার যেন এরকম না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।'
কমেছে সার্বিক বিওপি ঘাটতি
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টের সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২.১৪ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩.৮৩ বিলিয়ন ডলার।
এ ঘাটতির পেছনে মূল কারণ 'এরর অ্যান্ড অমিশন'-এর নেগেটিভ ব্যালান্স ২.১৪ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময় শেষে ছিল পজিটিভ ১৪৯ মিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, 'এরর অ্যান্ড অমিশন'-এর নেগেটিভ ব্যালেন্সের অর্থ হলো আনরেকর্ডেড আউটফ্লো।অর্থাৎ রিজার্ভ থেকে ডলার খরচ হয়ে গেছে, কিন্তু হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না।
জাহিদ হোসেন বলেন, সার্বিক বিওপি ঘাটতি কমায় বলা যেতে পারে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমেছে। একইসঙ্গে এটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারকেও কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে।
তবে 'এরর অ্যান্ড অমিশন'-এর পরিমাণ বড় হয়াকে বিওপির সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'এরর অ্যান্ড অমিশনের ফিগার বড় হলে সেখানে টাকা পাচারের গন্ধ পাওয়া যায়। টাকা পাচার আগের তুলনায় কমেছে, তার মানে এই নয় যে পাচার বন্ধ হয়ে গেছে। এখনো বাণিজ্যভিত্তিক মিসভ্যালুয়েশন হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবশ্যই এ জায়গাটিতে নজর দিতে হবে।'