যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেশি ফিতে ইংরেজিতে দুর্বল বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করছে: বিবিসির প্রতিবেদন
ইয়াসমিন (ছদ্মনাম) নামের এক নারী শিক্ষার্থী ইরান থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশোনা করতে যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন। তবে এখানে এসে তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, তার বহু সহপাঠীই ইংরেজিতে বেশ দুর্বল। আর মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র এক থেকে দুইজন ব্রিটিশ।
বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইয়াসমিন বলেন, "ব্রিটিশ উচ্চারণ কিংবা ইংরেজি সঠিকভাবে না বুঝে এই কোর্সওয়ার্ক চালিয়ে যাওয়া কীভাবে সম্ভব?"
ইয়াসমিন জানান, বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা তাদের কোর্সওয়ার্ক অন্যদের অর্থ দিয়ে করিয়ে নেন। কেউবা আবার নিজেদের উপস্থিতির নিশ্চিত করতেও অন্যদের অর্থ দিয়ে থাকেন।
ইয়াসমিনের অভিজ্ঞতা অবশ্য যুক্তরাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগকে তুলে ধরে। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড কলেজ ইউনিয়ন (ইউসিইউ) জানায়, কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উচ্চ ফি নিয়ে ভাষাগত দক্ষতার বিষয়টিকে উপেক্ষা করছে। একজন অধ্যাপক জানান, তার সাম্প্রতিক মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের ৭০ ভাগেরই যথাযথ ইংরেজি দক্ষতা নেই।
যদিও ১৪১টি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে থাকা 'ইউনিভার্সিটি ইউকে' অবশ্য উচ্চ ফি নিয়ে কম ভাষাগত দক্ষতার শিক্ষার্থীদের ভর্তি নেওয়ার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা জানায়, বিদেশ থেকে আগত শিক্ষার্থীদের জন্য ভালোভাবে ভাষাগত দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
ইউসিইউ-এর অধীনে রয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ। প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল সেক্রেটারি জো গ্রাডি বলেন, "এটা একটা ওপেন সিক্রেট যে, ইংরেজিতে দক্ষতা না থাকা শিক্ষার্থীরাও যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করতে আসার উপায় খুঁজে বের করে।"
জো গ্রাডি বলেন, "আমরা শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বললে শুনতে পারি যে, তারা সংশ্লিষ্ট ভাষা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে এবং কোর্সে ভর্তি হতে নানা কৌশল অবলম্বন করেছে।"
থিংক ট্যাংক হায়ার এডুকেশন পলিসি ইনস্টিটিউটের রোজ স্টিফেনসন বলেন, "যুক্তরাজ্যে মাস্টার্স কোর্সে অধ্যয়নরত ১০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় সাতজন এখন বিদেশ থেকে আগত। যা অন্য উচ্চ শিক্ষার কোর্সের তুলনায় অনেক বেশি।"
ইংল্যান্ডের স্থানীয় স্নাতক শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি ৯,২৫০ পাউন্ড। যা ২০২৫-২৬ সেশনে বেড়ে ৯,৫৩৫ পাউন্ড হয়েছে। যুক্তরাজ্যের প্রতিটি অঞ্চলে তাদের নিজস্ব ফি নির্ধারণ করে। কিন্তু ইংল্যান্ডে অধ্যয়নরত বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য এই ফি এর কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই।
স্টিফেনসন বলেন, "আপনি বিদেশ থেকে আগত একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে যত ইচ্ছা তত টিউশন ফি নিতে পারেন।"
স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ফি এরও কোনো সীমা নেই। তাই অনেকের একটি নামকড়া অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য ৫০ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত খরচ হয়ে যায়।
স্টিফেনসন বলেন, "ইংল্যান্ডের স্থানীয় শিক্ষার্থীদের জন্য স্নাতক পর্যায়ের ফি মুদ্রাস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্য করে বৃদ্ধি করা হয়নি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তহবিলে ঘাটতি রয়েছে। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের থেকে বেশি ফি নিয়ে তা স্থানীয় শিক্ষার্থীদের খরচে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে।"
বিবিসির সাথে নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক এক ব্যক্তির সাথে কথা হয়; যিনি কি-না বিদেশি শিক্ষার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রে আনতে কাজ করা এজেন্সিগুলোর মধ্যে অন্যতম স্টাডি গ্রুপের সাথে কাজ করেছেন। এটি প্রায় ৯৯টি দেশে ৩৫০০ এজেন্টের মাধ্যমে কাজ করে থাকে।
ঐ ব্যক্তি বলেন, "এজেন্টরা এমন সব পরিবারকে টার্গেট করেন যারা কি-না মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত।"
যদিও স্টাডি গ্রুপের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করা হয়েছে। বরং তাদের দাবি, বিদেশি শিক্ষার্থীরা মেধার ওপর ভিত্তি করেই সুযোগ পেয়ে থাকেন।
স্টাডি গ্রুপের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, "শিক্ষার্থীদের ভর্তি নেবার বিষয়টি পুরোপুরি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে। এক্ষেত্রে কোন বিশেষ ছাড়ের সুযোগ তাদের কাছে নেই।"
সাউদার্ন ইংল্যান্ডে অবস্থিত ঐ বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য ইয়াসমিন ১২ হাজার পাউন্ড ফি দিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি জানতে পারেন যে, তার শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ সহপাঠীরা অর্থের বিনিময়ে অন্যকে দিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট করিয়ে নেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থায় এটিকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে মনে করা হয়।
ইয়াসমিন বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জানিয়েছিল। কিন্তু তারা কোনো ধরনের ব্যবস্থাই নেননি। এমন পরিস্থিতিতে ইয়াসমিন মনে করেন যে, তার স্নাতকোত্তর ডিগ্রিকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে।
রাশেল গ্রুপ ইউনিভার্সিটির আরেকজন অধ্যাপক ইয়াসমিনের মতো একই ধরণের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি জানান, গত পাঁচ বছর ধরে তার অধীনে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করা ৭০ ভাগ শিক্ষার্থীর ইংরেজিতে ভালো দক্ষতা ছিল না।
ঐ অধ্যাপক বলেন, "এমনও হয়েছে যখন আমি একজন শিক্ষার্থীকে খুবই সরল একটা প্রশ্ন করেছি। কিন্তু ঐ শিক্ষার্থী ঐ প্রশ্ন বুঝতেই পারেননি।"
এতে করে এই শিক্ষক নিজের পড়ানোর কৌশলে পরিবর্তন এনেছেন। এমনকি শিক্ষার্থীরাও ক্লাসে ট্রান্সলেশন করার অ্যাপগুলো ব্যবহার করেন। তবে বিদেশি শিক্ষার্থীদের একতরফা দোষ দিতে তিনি রাজি নন। বরং এই শিক্ষার্থীরা মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে বলে জানান তিনি।
এই শিক্ষক জানান, ভাষাগতভাবে দুর্বল থাকা শিক্ষার্থীরা তবুও পাশ করেন। কেননা এক্সাম ছাড়া কোর্সগুলোর অ্যাসাইনমেন্টে নম্বর থাকে। এক্ষেত্রে কেউ আবার এআই থেকে শুরু করে অন্যদের অর্থ দিয়েও অ্যাসাইনমেন্ট করিয়ে নেন।
জো গ্র্যাডি বলেন, "এটি খুব অবাক করার মতো কিছু নয় যে, ইংরেজিতে দুর্বল থাকা শিক্ষার্থীরা অন্যজনের সাহায্য নেন। এমনকি 'হতাশ' হয়ে তারা কাজে এআই ব্যবহার করেন।"
জো গ্র্যাডি জানান, তারা খুব ভালো করেই বোঝান যে, ইংরেজিতে দুর্বল থাকা শিক্ষার্থীদের ভর্তি না নিতে। কেননা এতে করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ই নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হবেন। তবে অর্থ ও আয়ের দিকটি বিবেচনা করে সেটিকে আমলে নেওয়া হয় না।"
গ্র্যাডি আরও জানান, কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিক সংকটে রয়েছে। এক্ষেত্রে তারা বিদেশি শিক্ষার্থীদের মোটা অঙ্কের ফি এর ওপর নির্ভর হয়ে পড়ছে।
গ্র্যাডি বলেন, "প্রতিষ্ঠানগুলো টাকার পেছনে ছুটছে। তারা ভালো প্রার্থী খুঁজছে না। এটি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দুর্নীতি।"
এদিকে ইউনিভার্সিটিজ ইউকের চিফ এক্সিকিউটিভ ভিভিয়েন স্টার্ন এমন অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি দাবি করেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ন্যূনতম ভাষাগত দক্ষতাসহ কঠোরভাবে নিয়মনীতি মানা হয়।
ভিভিয়েন স্টার্ন বলেন, "শিক্ষার্থীদের যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করতে ফি বহন করতে হয়। কিন্তু এর বাইরে কে আবেদন করতে পারবে এবং যোগ্যতা কী সেটির একটি মানদণ্ড থাকে৷ এটি এমন একটি কেন্দ্রীয় বিষয় যা মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য।"
স্টার্ন মনে করেন, বিদেশি শিক্ষার্থীরা যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পড়ালেখার মানের জন্য আকৃষ্ট হয়। সেক্ষেত্রে দেশীয় শিক্ষা ও গবেষণায় অর্থায়নের জন্য বিদেশি শিক্ষার্থীদের থেকে আয় করা 'অবিবেচনা প্রসূত' হবে।
এদিকে যুক্তরাজ্যে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে। এই বছরের প্রথমার্ধে দেশটিতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আবেদনের হার ১৬ ভাগ হ্রাস পেয়েছে।
দেশটির এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট বিবিসিকে বলেছে, "বিদেশি শিক্ষার্থীদের উপর আর্থিক নির্ভরতা একটি ঝুঁকি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ব্যবসায়িক মডেল পরিবর্তন করতে হবে। সরকার সতর্কতার সাথে অভিবাসন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।"
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান