ফ্রান্সে স্বামীর সহায়তায় ১০ বছর ধরে স্ত্রীকে ধর্ষণে অভিযুক্ত ৫০ জন
তারা কেউ তরুণ, কেউ বৃদ্ধ, কেউ স্থূল, কেউ পাতলা, কেউ কৃষ্ণাঙ্গ বা কেউ শ্বেতাঙ্গ। তাদের পেশাও বিভিন্ন—দমকলকর্মী, গাড়িচালক, সেনা, নিরাপত্তারক্ষী; এমনকি একজন সাংবাদিক ও একজন ডিজেও রয়েছেন। এই ৫০ জন পুরুষ ভয়ংকর এক অপরাধে জড়িত।
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ৭২ বছর বয়সী ডমিনিক পেলিকোতের নির্দেশে তার স্ত্রী জিসেল পেলিকোতকে ধর্ষণ করেছেন।
৭২ বছর বয়সী ডমিনিক পেলিকোত তিনি দীর্ঘ এক দশক ধরে তার স্ত্রী জিসেল পেলিকোতকে নিয়মিত মাদক দিয়ে অচেতন করতেন। এরপর বিভিন্ন পুরুষকে বাড়িতে এনে তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করাতেন। এই ঘৃণ্য অপরাধের জন্য তিনি অনলাইনে লোক খুঁজতেন এবং তাদের এই কাজে প্ররোচিত করতেন।
১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ৯২ বার যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন জিজেল পেলিকোত। এই নৃশংস ঘটনায় ৭২ জন পুরুষ তাকে ধর্ষণ করেন বলে অভিযোগ।
ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর অ্যাভিগনোনে এই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় গত সেপ্টেম্বর থেকে ডমিনিক পেলিকোতের বিচার চলছে। আগামী সপ্তাহে মামলার বিচারকাজ শেষ হওয়ার পর রায় ঘোষণা হতে পারে। যদি অভিযুক্তরা দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে সম্মিলিতভাবে তাদের মোট শাস্তির মেয়াদ হবে ৬০০ বছরেরও বেশি।
অভিযুক্ত এই ৫০ জনের বেশিরভাগই এসেছেন জিসেলের গ্রাম মাজানের আশপাশের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত ছোট শহর ও গ্রাম থেকে। অভিযুক্তদের মধ্যে কয়েকজন নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন, তবে বেশিরভাগই বিচারকদের সামনে মাথা নিচু করে কথা বলেছেন।
তাদের মধ্যে একজন হলেন ৬৯ বছর বয়সী জোসেফ সি, যিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত ক্রীড়া কোচ। যদি তিনি দোষী সাব্যস্ত হন, তবে তার চার বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। কৌঁসুলিরা যে সাজা দাবি করেছেন, তার মধ্যে এটি সবচেয়ে কম।
অন্যদিকে, ৬৩ বছর বয়সী রোমেইন ভি-এর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তিনি এইচআইভি পজিটিভ ছিলেন জেনেও জিসেলকে ছয়বার ধর্ষণ করেছেন এবং কোনো ধরনের সুরক্ষা নেননি। যদিও তার আইনজীবী দাবি করেছেন, তিনি দীর্ঘদিন চিকিৎসার আওতায় ছিলেন, ফলে তার মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা কম। দোষী সাব্যস্ত হলে তার ১৮ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
কৌঁসুলিরা এই মামলার বিষয়ে এমন বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরতে পেরেছেন মূলত অভিযুক্ত ডমিনিক পেলিকোতের ভিডিও সংগ্রহের কারণে। তিনি এক দশকের বেশি সময় ধরে স্ত্রী জিজেল পেলিকোতকে ধর্ষণ করানোর প্রতিটি ঘটনার ভিডিও ধারণ করেছিলেন।
আদালতে ডমিনিক তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ স্বীকার করেছেন এবং দাবি করেছেন, তার সঙ্গে অভিযুক্ত ৫০ জনও সমানভাবে দোষী। এসব ভিডিও প্রমাণের কারণে অভিযুক্তরা ঘটনাস্থলে যাওয়ার কথা অস্বীকার করতে পারছেন না।
ফ্রান্সে ধর্ষণবিরোধী আইনে বলা হয়েছে, 'সহিংসতা, জবরদস্তি, হুমকি বা আকস্মিকতার' মাধ্যমে সংঘটিত যৌন নির্যাতনকে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা হবে। তবে এই সংজ্ঞায় ভুক্তভোগীর সম্মতির বিষয়টি উল্লেখ নেই।
এই আইনের ব্যাখ্যা ব্যবহার করে অভিযুক্তদের পক্ষের আইনজীবীরা যুক্তি দিয়েছেন যে জিসেল এমন অবস্থায় ছিলেন, যেখানে তিনি সম্মতি দিতে সক্ষম ছিলেন না—এ বিষয়টি অভিযুক্তরা জানতেন না। তাই তাদের কর্মকাণ্ডকে ধর্ষণ বলা যেতে পারে না। এক অভিযুক্তের আইনজীবী বলেছেন, 'ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্ষণ না করলে সেটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত নয়।'
মামলায় অভিযুক্তদের একজন স্বেচ্ছাসেবী দমকলকর্মী ক্রিশ্চিয়ান এল বলেন, 'আমার শরীর তাকে ধর্ষণ করেছে, কিন্তু আমার মস্তিষ্ক এতে সম্মতি দেয়নি।'
আরেক অভিযুক্ত, ৬৩ বছর বয়সী জেন-পিয়ারি, যাকে ডমিনিকের অনুসারী হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে, স্বীকার করেছেন যে ডমিনিকের কাছ থেকেই তিনি শিখেছেন কীভাবে স্ত্রীর অচেতন অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাকে অপব্যবহার করা যায়। তিনি পাঁচ বছর ধরে একই কাজ করেছেন।
জেন-পিয়ারি বলেন, 'ডমিনিকের সঙ্গে পরিচয় হওয়াটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। সে আমাকে নিজের ভাইয়ের মতো আপন করে নিয়েছিল।'
এই অপরাধের জন্য আইনজীবীরা জেন-পিয়ারির ১৭ বছরের কারাদণ্ড দাবি করেছেন।
'পেলিকোতের কৌশলে প্রতারিত ও প্রভাবিত'
৫৪ বছর বয়সী আহমেদ টি, পেশায় মিস্ত্রী। ছোটবেলার প্রেমিকাকে বিয়ে করে ৩০ বছরের সুখী দাম্পত্য জীবন তার। তিনি আদালতে বলেন, 'যদি ধর্ষণ করতেই চাইতাম, তাহলে ষাটোর্ধ্ব কাউকে কখনোই বেছে নিতাম না।'
৪০ বছর বয়সী বেকার রেদোয়ান এ বলেন, যদি তিনি জিসেল পেলিকোতকে ধর্ষণের উদ্দেশ্যে যেতেন, তাহলে তিনি কখনোই তার স্বামীকে ভিডিও করতে দিতেন না।
কিছু অভিযুক্ত অভিযোগ করেছেন যে তারা ডমিনিক পেলিকোতের দ্বারা ভয় দেখানো হয়েছিল। একজন আইনজীবী বিবিসিকে জানিয়েছেন, পেলিকোত ছিলেন একজন 'ঘৃণ্য চরিত্রের মানুষ'।
অভিযুক্ত পুরুষ নার্স রেদোয়ান ই আদালতে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, 'আমি এত ভয় পেয়েছিলাম যে শোবার ঘর ছেড়ে চলে যেতে পারিনি। হয়তো ভিডিওতে তা বোঝা যায় না, কিন্তু আমি সত্যিই ভীষণ আতঙ্কিত ছিলাম!'
অন্যরা দাবি করেছেন, তাদের পানীয়তে নেশা জাতীয় ওষুধ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যার ফলে তারা কিছুই মনে করতে পারেন না। যদিও ডমিনিক পেলিকোত এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
তবে বেশিরভাগ অভিযুক্ত দাবি করেছেন, ডমিনিক পেলিকোত তাদের প্রতারণা ও বিভ্রান্ত করেছিলেন। তিনি তাদের বিশ্বাস করিয়েছিলেন, এটি একটি সম্মতিপূর্ণ দম্পতির যৌন খেলা।
'তাদের এমন পরিস্থিতিতে ফেলা হয়েছিল যেখানে তারা প্রতারিত হয়েছে,' অভিযুক্ত জোসেফ সি-এর আইনজীবী ক্রিস্টোফ ব্রুসকি বিবিসিকে বলেন। 'তাদের বোকা বানানো হয়েছিল।'
কিন্তু ডমিনিক পেলিকোত বরাবরই দাবি করেছেন, তিনি পুরুষদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তার স্ত্রী এ পরিকল্পনার কিছুই জানেন না।
তিনি আরও বলেছেন, পুরুষদের এমনভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল যাতে তারা তার স্ত্রীকে ঘুম থেকে না জাগায় এবং তাদের উপস্থিতির কোনো চিহ্ন না রেখে যায়। এর মধ্যে ছিল তার স্ত্রীর স্পর্শ করার আগে হাত গরম করা, বা পারফিউম কিংবা সিগারেটের গন্ধ না রাখা।
'তারা সব জানত, তারা তা অস্বীকার করতে পারে না,' বলে মন্তব্য করেন ডমিনিক পেলিকোত।
পরিবারগুলো উত্তর খুঁজছে
সেপ্টেম্বর থেকে একের পর এক ৫০ জন অভিযুক্ত আদালতে হাজির হয়েছেন অ্যাভিগননে। ধর্ষণ মামলার তদন্ত সাধারণত কয়েক দিন সময় নেয়। তবে অভিযুক্তদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় এই মামলার শুনানি খুব দ্রুত সম্পন্ন করা হচ্ছে। দ্রুতগতির এই বিচার প্রক্রিয়ায় অভিযুক্তদের জীবনের নানা ঘটনা উঠে এসেছে—যা অনেক সময় নির্যাতন ও ট্রমার গল্পে ভরা।
৪৩ বছর বয়সী নির্মাণশ্রমিক সিমোনে এম আদালতে জানান, ১১ বছর বয়সে এক পারিবারিক বন্ধুর হাতে তিনি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। ওই ব্যক্তি তাকে গবাদিপশুর দেখভালের কাজ দিয়েছিলেন।
চার সন্তানের জনক জন-লুক এল, ৪৬, বলেন, ছোটবেলায় তার পরিবার ভিয়েতনাম থেকে নৌকায় পালিয়ে আসে। শরণার্থী শিবিরে কাটানোর পর তারা ফ্রান্সে স্থায়ী হয়।
৩৯ বছর বয়সী ফ্যাবিয়েন এস, যিনি এর আগেও মাদক ব্যবসা ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, জানান, ছোটবেলায় তিনি পালক বাবা-মায়ের হাতে মারধর ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন। তিনি বলেন, আদালতের মনোবিদের পরামর্শ নেওয়ার সময় বুঝতে পারেন যে তার অস্পষ্ট শৈশবের স্মৃতিগুলো আসলে নির্যাতনেরই চিহ্ন।
বিচারের অংশ হিসেবে অভিযুক্তদের পরিবারের সদস্যরাও আদালতে উপস্থিত হন। তারা স্তম্ভিত এবং প্রশ্ন করেন, কীভাবে তাদের প্রিয়জন এমন পরিস্থিতিতে জড়ালেন। এক নারীর ভাষায়, 'এটা ভাবতেই পারিনি, সে এমন কিছু করতে পারে। সে তো আমার জীবনের আনন্দ ছিল।'
'আমি সবসময় তার পাশে থাকব'
থিয়েরি পা, ৫৪ বছর বয়সী এক সাবেক নির্মাণকর্মীর প্রাক্তন স্ত্রী কোরিন বলেন, তিনি সবসময়ই তার প্রাক্তন স্বামীকে 'দয়ালু' এবং 'শ্রদ্ধাশীল' মনে করেছেন, এবং তাদের আবার এক হওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও কিছুটা আশা ধারণ করেছিলেন।
'যখন তারা আমাকে বলল তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনা হয়েছে, আমি বললাম: 'এটা অসম্ভব… আমি একেবারে বুঝতে পারছি না, সে এখানে কী করছে?' তিনি বিশ্বাস করেন, তাদের ১৮ বছর বয়সী ছেলে মারা যাওয়ার পর তার প্রাক্তন স্বামী গভীর বিষণ্ণতায় ডুবে গিয়েছিলেন, মদ্যপান শুরু করেছিলেন এবং শেষে ডমিনিক পেলিকোতের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন।
'আমি সবসময় তার পাশে থাকব, যা ঘটুক না কেন,' বলেন জোয়ান কে-র প্রাক্তন প্রেমিকা। ২৭ বছর বয়সী জোয়ান, গায়ানার বাসিন্দা, অভিযুক্তদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী। তিনি ফরাসি সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য।
তিনি দাবি করেছেন, তিনি জিসেল পেলিকোতকে দুইবার ধর্ষণ করেননি। তিনি জানতেন যে, জিসেল অচেতন থাকবে, তবে তিনি জানতেন না যে, সে সম্মতি দেয়নি।
সম্ভাব্যভাবে, তিনি আরও বলেন, তার ভেতরের 'অশুদ্ধ যৌনতা'ই এই ঘটনা ঘটিয়েছে।
জিসেল পেলিকোত: 'তারা সজ্ঞানে আমাকে ধর্ষণ করেছেন'
জিসেল পেলিকোতের স্বামীর কারসাজির শিকার কি না, তা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন উঠলেও তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তাকে ধর্ষণের ক্ষেত্রে কেউ অস্ত্রের মুখে জিম্মি করেননি। তিনি বলেন, 'তারা পুরোপুরি সচেতন অবস্থায় আমাকে ধর্ষণ করেছেন।'
অভিযোগের ভিত্তিতে অনেক বিবাদির বর্তমান ও সাবেক নারী সঙ্গীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল, তাদের অজান্তেও এমন কিছু ঘটেছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া। একজন নারী বলেন, এই ঘটনা তার মনে চিরকাল একটি তীব্র সন্দেহ জাগিয়ে রাখবে—'শ্রদ্ধাশীল, চিন্তাশীল ও মিষ্টি মানুষটি কখনো আমার অজান্তে এমন কিছু করেছেন কি না।'
মামলার শুনানি শুরুর পর থেকে আদালতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে একটি মিল খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা চলছে। গিস লে-এর আইনজীবীদের মতে, অভিযুক্তদের মধ্যে একমাত্র নিশ্চিত মিল হলো—তারা প্রত্যেকেই সচেতনভাবে পুলিশের কাছে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
৭৩ বছর বয়সী দমকলকর্মী জ্যাকস সি বলেন, 'ভাবছিলাম জানাব, কিন্তু জীবনের ব্যস্ততায় আর হয়নি।' ৫৫ বছর বয়সী প্যাট্রিস এন বলেন, 'পুলিশ স্টেশনে পুরো দিন নষ্ট করতে চাইনি।'
একজন অভিযুক্তও কোনোভাবে পুলিশকে জানায়নি। এমনকি একটি বেনামি ফোনকলও গিস লে-এর জীবন রক্ষা করতে পারত। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'কেন তারা পুলিশের কাছে যাননি? একটিমাত্র ফোনকলই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু কেউ তা করেনি'।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন