গণঅভ্যুত্থানে আহতদের মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসায় টাস্কফোর্স গঠনের তাগিদ, আহতদের পুনর্বাসনে নতুন হাসপাতাল তৈরির চিন্তা
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ২২ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে। স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে ৫৮৭ জন। দৃষ্টি হারিয়েছে হাজারের বেশি। তাদের অধিকাংশই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, নানারকম হতাশায় ভুগছেন। সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছেন না। আহতদের মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসায় অভিজ্ঞ পেশাজীবীদের সমন্বয়ে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা জরুরি বলে উল্লেখ করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটিতে 'মেন্টাল হেলথ ক্রাইসিস: ডিলিং উইথ পোস্ট জুলাই রেভ্যুলেশনারি অ্যাসপেক্টস' শীর্ষক সেমিনারের বক্তারা এসব কথা বলেন। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন এই সেমিনারের আয়োজন করে।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী।
তিনি মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন রিসোর্স ও তার সীমাবদ্ধতা এবং ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
ড. কামাল উদ্দিন বলেন, গণঅভ্যুত্থানে প্রায় ১ হাজার ৪২৩ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। আহতের সংখ্যা ২২ হাজারেরও বেশি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই ছাত্র-ছাত্রী, শিশু-কিশোর।
তিনি আরও বলেন, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পায় মানসিক স্বাস্থ্যের অন্যতম ও জটিল রোগ পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি)। তীব্র শোক বা মানসিক আঘাত থেকে এ সমস্যা দেখা দেয়। পিটিএসডির কারণে অনেকসময়ই মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, সামাজিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে, পড়াশোনায় অমনোযোগ বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, কর্মক্ষেত্রে কাজের পারফরম্যান্স খারাপ হয়ে যায়, এমনকি চাকরি বা ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার মতো কাজও করে ফেলে নিজেকে প্রতিরক্ষার জন্য। এমনকি অনেকে আত্মহত্যার চিন্তাও শুরু করতে পারেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক ও পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম. মুজাহেরুল হক বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতরা ছাড়াও আহত এবং নিহতদের পরিবারের সদস্যরাও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তারা নানারকম হতাশায় ভুগছেন। তারা একটি সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছেন না।
তিনি বলেন, তাদের আবারও সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হলে সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। তারা যে মানসিক অবসাদে ভুগছেন, তা কাটিয়ে উঠতে তাদেরকে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহী করতে হবে এবং তারা যেন সঠিক চিকিৎসা পায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য আলাদা একটি হাসপাতাল করা যেতে পারে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, গণঅভ্যুত্থানে আহতরা যে পক্ষের হোক, তারা চিকিৎসা পাবেন। তবে গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে আহতদের অর্ধেককে এখনও সহায়তার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে সব গুছিয়ে নেওয়ার।
'আমরা নিশ্চিত করছি তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও সার্বিক প্রয়োজনে সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে—যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়ক হবে। মুক্তিযুদ্ধের পর আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে হাসপাতালে তৈরি করা হয়েছিল। বর্তমানে সেটি পঙ্গু হাসপাতাল। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে আহতদের পুনর্বাসনে নতুন হাসপাতাল তৈরির ভাবনা রয়েছে সরকারের,' বলেন তিনি।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, 'গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে আহতদের অঙ্গহানির জন্য তাদের যারা তিরস্কার বা কটু কথা দ্বারা মানসিক আঘাত দেয় তারা মানুষের মধ্যে পড়ে না।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা দেখেছি আন্দোলনের পর থেকে অনেক মা-বাবারাও ট্রমাটাইজড। অনেক পরিবারের মেয়েরা আন্দোলনে ট্রমাটাইজড হয়ে লোকভয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হচ্ছেন না এই ভয়ে যে, যদি মানুষ জেনে যায় তাহলে তাদের বিয়ে দিতে সমস্যা হতে পারে।'
উপদেষ্টা জানান, বৃহস্পতিবার সকালে মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে আহত ও শহিদ পরিবারের আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।