বছরের পর বছর ধরে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সংকটে ভুগছে মিরসরাই বিসিক শিল্পনগরী
ব্লাড ব্যাগ কারখানা নির্মাণের জন্য ২০২১ সালে মিরসরাই বিসিকি শিল্পনগরীতে ৬ হাজার স্কয়ার ফিটের দুটি প্লট বরাদ্দ নেয় চট্টগ্রামের রিলায়েন্স ক্যান ইন্ডাস্ট্রিজ।
১৪ কোটি টাকা বিনিয়োগে মেডিকেল ইকুইপমেন্ট তৈরির এ কারখানা থেকে উৎপাদিত পণ্যের ৭০ শতাংশ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে রপ্তানিরও পরিকল্পনা আছে প্রতিষ্ঠানটির।
তবে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস সংকটের কারণে রিলায়েন্স ক্যান ইন্ডাস্ট্রিজ তাদের এই কারখানার কাজ তিন বছরেও চালু করতে পারেনি।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, কারখানা করতে আরও ৬ হাজার স্কয়ার ফিটের একটি প্লট প্রয়োজন। কারখানা নির্মাণ হলে এতে ১৮০ জন লোকের কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু নানামুখী এসব সংকটের কারণে প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ ক্রমশ বিলম্বিত হচ্ছে। এসব সমস্যার সমাধান কখন হবে, সেটি নিয়েও সন্দিহান প্রতিষ্ঠানের মালিক।
শুধু রিলায়েন্স ক্যান ইন্ডাস্ট্রিজই নয়, দেশের ৭৫-তম বিসিক (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন) শিল্পনগরীতে প্লট বরাদ্দ নেওয়া বিভিন্ন দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান তাদের কারাখানা চালু করতে পারছে না একই সমস্যার কারণে।
এখনো গ্যাস সংযেগ আসেনি শিল্পনগরীতে। পল্লী বিদ্যুতের আবাসিক লাইনের সংযোগ থাকায় ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে করখানা স্থাপনের কাজ শুরু করছেন না বিনিয়োগকারীরা।
২০১৭ সালে ১৫ দশমিক ৩২ একর জায়গায় মিরসরাই বিসিক শিল্পনগরী প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। এরপর ৭ বছরে মাত্র ৮টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করতে পেরেছে এই শিল্পনগরীতে।
এতে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ৫৫ জনের। অথচ শিল্পনগরীতে ৮০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান ৮৮টি প্লট বরাদ্দ নিয়েছে। এটি পুরোপুরি চালু হলে কর্মসংস্থান হওয়ার কথা অন্তত ৫ হাজার লোকের।
বিসিক কর্মকর্তারাও বলছেন, গ্যাস ও নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না থাকায় উৎপাদনে যেতে পারছে না অনেকগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠান। মিরসরাইয়ে বর্তমানে দৈনিক ৪ বার লোডশেডিং হয়। এ বিষয়ে গত ২১ নভেম্বর চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে চিঠি দিয়েছে বিসিক কর্তৃপক্ষ।
রিলায়েন্স ক্যান ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একরামুল হক টিবিএসকে বলেন, "বিসিক শিল্প নগরীতে মেডিকেল প্লাস্টিক ইউনিট করার পরিকল্পনা আমাদের। বিদ্যুৎ গ্যাস, পানির সংকটের পাশাপাশি কারখানার আকার অনুযায়ী প্লট পাওয়াও এখানে একটি বড় সমস্যা।"
তিনি বলেন, "অনেকেই প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন কারাখানা করতে, নয়তো বিক্রির উদ্দেশ্যে। কিন্তু প্লট বরাদ্দ নেওয়ার পর ৫ বছরের মধ্যে হস্তান্তরের নিয়ম নেই। এসব সংকটে আমরা রীতিমতো হতাশ হয়ে যাচ্ছি।"
একরামুল হক আরও জানান, "এখানে অবকাঠামোগত উন্নয়নও সেভাবে হয়নি। আমরা দুই প্রতিষ্ঠানের নামে ২টি প্লট বরাদ্দ পেয়েছি। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ফ্যাক্টরি করতে আরও একটি প্লট প্রয়োজন। আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে পাশ্ববর্তী প্লট গ্রহীতার কাছ থেকে আমরা সেটি নিতে পারছিনা। দ্রুত এসব সমস্যার সমাধান না হলে বিনিয়োগকারীরা এই শিল্পনগরী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন।"
মিরসরাই বিসিক শিল্পনগরীটি মিরসরাই সদরের কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক লাগোয়া হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো। ২০২০ সালে এটির আয়তন বৃদ্ধি করতে মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠিও দেয় বিসিক। তবে সবগুলো প্রতিষ্ঠান চালু না হওয়ায় নতুন করে আয়তন বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না।
বিসিক মিরসরাই শিল্পনগরীর প্রমোশন অফিসার মোহাম্মদ তানজিলুর রহমান টিবিএসকে বলেন, মিরসরাইয়ে বর্তমানে দৈনিক ৪ বার লোডশেডিং হয়। এতে কারখানা চলাকালীন সময়ে ৩ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ থাকে না। এছাড়া কারখানাগুলোতে গ্যাস সংযোগও দেওয়া যায়নি। গ্যাস ও নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না পাওয়ায় আরও অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যেতে পারছে না।
"নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না পেলে ছোট কারখানা চালানো খুবই কষ্টদায়ক। তাই নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থার জন্য গত ২১ নভেম্বর মিরসরাই পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে চিঠি দিয়েছি," বলেন তিনি।
চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ এর আওতাভুক্ত এলাকার মধ্যে রয়েছে মিরসরাই উপজেলা ও সীতাকুণ্ড এবং হাটহাজারী উপজেলার কিছু অংশ। এই সমিতির অধীন বিদ্যুতের চাহিদা ৬৮ মেগাওয়াট। শীতকালে সেটি ৫০ মেগাওয়াটে নেমে আসে।
চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ এর জেনারেল ম্যানেজার মৃদুল কান্তি চাকমা টিবিএসকে বলেন, "একটি ফিডার লাইন চেয়ে বিসিক থেকে আবেদন করা হয়েছে। বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছি।"
অনুমোদন পেলে মিঠাছরা সাব স্টেশন থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার ফিডার সংযোগ দিতে প্রায় ছয় মাস সময় লাগতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বিসিক শিল্প নগরীতে বর্তমান উৎপাদনে থাকা ৮টি প্রতিষ্ঠান হলো— এয়াকুব অটো রাইস মিল, খাজা ভাণ্ডার, খান এক্সেসারিজ, নাছির ক্যামিকেল, আলিফ ফুড, মেঘনা ডাল মিল, ইনোভা টেক্সটাইল ও এবি কমোডিটিজ।
বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানে ৫৫ জন লোক কাজ করছেন। তবে ইনোভা টেক্সটাইল পুরোপুরি চালু হলে কয়েকশত মানুষের কর্মসংস্থান হবে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ২৫ জন লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।
সংকটে থাকা বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন, শিল্প নগরতে ৬০ ফিটের নিচেও সুপেয় পানি মিলছে না। এখানে কারখানার কাজ শুরুর আগে এসব সমস্যার সমাধান দেওয়া উচিত। বিসিক এসব ফ্যাসিলিটিজ যতক্ষণ পর্যন্ত সমাধান করতে না পারবে, বিনিয়োগ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
চীন-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইনটেক্স লিংক গার্মেন্টস (বিডি) লিমিটেডের পরিচালক এম ফজলে করিম লিটন টিবিএসকে বলেন, "এখানে প্লটের সাইজ কম থাকার কারণে করখানা করতে তিন থেকে চারটি প্লট প্রয়োজন। নিজেদের কোম্পানির নামে এক বা একাধিক প্লট পেলেও অন্যদের থেকে প্লট নিতে গিয়ে নানান জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "দুই বছর আগে দুটি প্লট বরাদ্দ পেলেও আরও দুটি প্লটের কারণে কারখানার কাজ শুরু করতে পারছি না। আরও দুটি প্লটের রেজিস্ট্রেশনের অপেক্ষায় আছি আমরা। সেটি নিশ্চিত হলে এখানে গার্মেন্টসসহ সোলার কারখানা তৈরির কাজ শুরু করবো। আমাদের কারখানায় ১ হাজারের বেশি লোকের কর্মসংস্থান হবে।"
বিসিক এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে মিরসরাইয়ে একটি বিসিক শিল্পনগরী স্থাপনের উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০১০ সালে মিরসরাইয়ের একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে বিসিক শিল্পনগরী স্থাপনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু মাটি ভরাটসহ নানান জটিলতায় আটকে যায় বিসিক শিল্পনগরী স্থাপনের কাজ।
মিরসরাই বিসিক শিল্প নগরীতে ব্যয় হয় ২৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা। প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ২০১৭ সালে। প্লটের প্রতি বর্গফুট জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৮০০ টাকা।
৫ বছরের মধ্যে নয়টি কিস্তিতে প্লটের টাকা পরিশোধ করতে পারবেন শিল্পোদ্যোক্তারা।