ঠোঁট সেলাই, কান ও অণ্ডকোষে বৈদ্যুতিক শক: ভিকটিমদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছে তদন্ত কমিশন
গুমের পর ভিকটিমদের গোপন স্থানে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সময় চালানো হতো অবর্ণনীয়, লোহমর্ষক নির্যাতন– এমন চিত্র উঠে এসেছে গুম সম্পর্কিত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে।
কমিশনের তদন্তে উঠে এসেছে নির্যাতনের পাশবিক সব পদ্ধতি, ভুক্তভোগীদের ঠোঁট সেলাই করে দেওয়া এবং কান ও অন্ডকোষে বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার মতো ঘটনা।
গতকাল (১৪ ডিসেম্বর) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত কমিশন। এটি তাঁদের প্রথম অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন। নির্যাতনের পদ্ধতিগুলোকে বীভৎস ও পরিকল্পিত বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
যেভাবে নির্যাতন করা হতো– তার প্রকৃতি ও তীব্রতা তুলে ধরতে দুটি ঘটনার উদাহরণ দিয়েছে কমিশন। যেমন '২০১০ সালে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে এ্ক যুবককে তুলে নিয়ে যায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। তিনি জানান, তাঁকে একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে কোনোপ্রকার ব্যথানাশক ছাড়াই ঠোঁট সেলাই করে দেওয়া হয়। এসময় যে তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন সেটি বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেন, যেন গরুর চামড়া সেলাই করছে– এমনভাবে আমার ঠোঁট সেলাই করা হয়।'
আট বছর পরের আরেকটি ঘটনায় এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তির অণ্ডকোষ ও কানে বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার ঘটনাও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। এই নির্যাতন তাঁকে করা হয়েছিল র্যাবের একটি স্থাপনায়।
নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা কমিশনকে জানান, যেখানে তাঁদের ওপর অত্যাচার চালানো হতো তাঁর কাছাকাছি জায়গাতেই ডেস্কে কাজ করতেন কর্মকর্তারা; নির্যাতিতদের আর্তচিৎকারে তাঁদের বিন্দুমাত্র বিকার হতো না— রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনীর অফিসগুলোতে এ ধরনের নির্যাতন যে 'স্বাভাবিক বিষয়ে' পরিণত হয়েছিল এ বর্ণনার মধ্যে দিয়ে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, এ দুটি ঘটনার ক্ষেত্রে নির্যাতনের মাত্রা ও ঘটনাস্থলের মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব থাকলেও নির্যাতন পদ্ধতির ধারাবাহিকতা থেকে বোঝা যায়– নির্যাতনকে কেবল নিয়মতান্ত্রিকই নয়, বরং নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছিল।
তদন্তে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিকটিমরা যখন বাড়িতে বা রাস্তায় ছিলেন তখন রাতে তাঁদেরকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। অপহরণকারীরা সাদা পোশাকে থাকতেন, এবং নিজেদের 'প্রশাসনের লোক' বলে পরিচয় দিতেন।
'ভুক্তভোগীদের কাউকে ফেরি থেকে, কাউকে বা রাস্তার পাশ থেকে বা কোনো পাবলিক প্লেস থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথমে তাঁদের নাম ধরে ডেকে নিয়ে তারপর জোর করে অপেক্ষমাণ গাড়িতে ওঠানো হতো, সাধারণত হাইয়েস মডেলের গাড়ি একাজে বেশি ব্যবহার হতো' - উল্লেখ করেছে প্রতিবেদনটি।
ভিকটিমদের জিজ্ঞাসাবাদের সময়সীমায় কমবেশি ছিল, কাউকে কাউকে ৪৮ থেকে ৬০ ঘণ্টা পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো, কিছুক্ষেত্রে তা চলতো কয়েক সপ্তাহ বা মাস ধরে।
এদের বেশিরভাগকেই গোপন সেলে রাখা হতো জনমনে এমন ধারণা থাকলেও – বেঁচে ফেরাদের জবানবন্দি থেকে জানা গেছে, প্রায় সময়েই যেসব সেলে তাঁদের আটক রাখা হতো সেখানে বৈধভাবে গ্রেপ্তারকৃতরাও ছিলেন। গুমের তদন্ত কমিশন বলেছে, এই ঘটনায় অবৈধভাবে আটকের ঘটনাকে লুকানোর প্রচেষ্টা উঠে এসেছে, যেকারণে এবিষয়ে আরও তদন্ত করা প্রয়োজন।