একান্নবর্তী রান্নাঘর: চুলার ধোঁয়ায় সম্পর্কের উষ্ণতা, খাবারের চেয়ে যা ছিল বেশি কিছু
আমাদের বাড়ির রান্নাঘরটা ছিল মূল ঘরের বাইরে। ঘর থেকে তিন চার কদম পেছনদিকে ছিল এ ঘর। মাথার ওপরে ছিল টিনের ছাদ আর চারদিকে সিমেন্টের দেওয়ালের বাউন্ডারি দেওয়া। প্রায় দশ বাই পনেরো ফিট সমান এ ঘরের পূর্ব পশ্চিম এবং উত্তর, তিনদিকেই জানালা। দরজাটা ছিল দক্ষিণপাশের কোণাকোণিতে। সেই প্রাচীন কাঠের খড়খড়িওয়ালা একটি দরজা।
পুরো বাড়ির মধ্যে এ রসুইঘরটাই ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। খেলাধুলা বাদে বাকি সময়টুকু ওখানেই বসে থাকতাম। বিশেষ করে নাইন-টেনে ওঠার পর ছোটো ভাইবোনরা উঠোনে বা ছাদে উঠে খেললেও, আমি বসে থাকতাম মোড়ায় করে দাদুর পাশে। কখনো দাদু, কখনো বা দিদি, কখনো বা চাচি, মা — যে-ই আসত, পাশে বসে থাকতাম। রান্না দেখতাম।
সে যে কী রান্না দেখতাম তা-ও জানিনা, কিন্তু তাকিয়েই থাকতাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে দুপুরে রান্না শেষ হওয়া পর্যন্ত টানা ওখানেই বসে থাকতাম।
তবে বেলা বাড়তে থাকলে আমার মতো দর্শকসংখ্যাও বাড়তে থাকতো এ ঘরের। তখন দেখা দিত মোড়া-পিঁড়ি সংকট। বাড়িতে যে কয়জন সদস্য, সে কয়টা মোড়া তো আর ছিল না। ফলে বড়রাও এ ঘরে এলে আমরা পেপার বিছিয়ে মাটিতেই বসে পড়তাম।
আমাদের ভাইবোনদের দলে ভাগ বসাতো ছোটো ফুপু আর চাচ্চু। কারণ তারাও বয়সের ভিত্তিতে সে মোড়া পায়নি! ঠিক এগারোটা থেকে বারোটা বাজলেই এ ভিড় শুরু হতো।
যেমন দুপুর বারোটা বাজলেই আমরা অপেক্ষায় থাকতাম চাচ্চুর। কারণ দুপুর বারোটা মানেই চাচ্চুর হাত ভর্তি শিঙ্গারা নিয়ে আসার পালা। ভেতরে বোম্বাই মরিচ দিয়ে মাখানো মশালাদার ঝাল আলু আটার ঐ দলাটা মুখে পুরে দিয়েই সঙ্গে সঙ্গে আরেক হাত দিয়ে দিতাম কাঁচা পেঁয়াজে কামড়। সে যে কী অমৃত!
এ রান্নাঘর তখন হয়ে উঠতো একটা কফিহাউজ। যেন গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসলো এবার সবাই। সে গল্পে দৈনন্দিন গাল্গপ্প থেকে শুরু করে বিয়ের সম্বন্ধ, স্মৃতিচারণ, ভবিষ্যতের ছককষা সবই চলত।
সবাই একযোগে যেভাবে পারে আসন নিলেও, দাদুর জন্য থাকত আলাদা জায়গা। সবসময় তিনি কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত। হয় হাতে নাড়ু গোল করছেন বা রসগজা পিঠেতে টুথপিক দিয়ে নকশা দিচ্ছেন, বা চাল বাঁচছেন, কিছু না কিছু করছেনই।
তবে যা কিছুই করেন না কেন, কান তার সবসময় সজাগ। রাজ্যের সবার সব আলাপ রানির মতো মন দিয়ে সব শুনছেন। আবার কে কয়টা খাচ্ছে, কার ভাগ্যে আরও কয়টা শিঙ্গারা আছে সেটাও দেখভাল করছেন।
ছোটো ভাইবোনদের দেখতাম ঐ রান্নাঘরের মধ্যেও বুমবুম পিপপিপ (গাড়ি) খেলছে। আর নাতি-নাতনীদের মাঝে আমি সবার বড় হওয়ায় এবং কাছাকাছি বয়সের কেউ না থাকায় বড়দের কথাগুলোই হা করে গিলতাম। কিংবা দাদু আর দিদির (আমাদের বাড়িতে যিনি কাজ করেন) কাজের সঙ্গে হাত মেলাতাম।
এ আড্ডা চলত প্রায় দু ঘণ্টা, যতক্ষণ না দাদু হেঁকে উঠবে, 'এ তোরা গোসলে যাচ্ছিস না কেন!! পরে সব একসঙ্গে লাইন ধরবি!' এ শুনে ছেলেরা সব উঠে যাবে, মায়েরা ছেলেপুলেদের খেলনার আসর থেকে তুলে নিয়ে ঢোকাবে গোসলখানায়। ব্যাস, রান্নাঘর আবার স্ত্রীলোকদের দখলে।
এদিকে মাটির চুলোয় রান্না হয়েই যাচ্ছে। দিদি সামলাচ্ছেন সে উনুন। কাঠের তক্তাগুলো পুড়ে পুড়ে মাটির চুলার ফাঁক দিয়ে সে ধোঁয়া উড়ে চলে যাচ্ছে পূবের জানালার শিক ধরে। মাটির ঢাকনার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসছে টমেটো, আলু, ধনেপাতা দিয়ে তেলাপিয়া মাছের তরকারির গরম ধোঁয়া।
সকালে এ চায়ের আসর আবার বসতো বিকেল সন্ধ্যেবেলায়। চায়ের সঙ্গে থাকত তখন পিঠে, মুড়ি মাখানো, পুরি পেঁয়াজুর আড্ডা। আর কোনো অতিথি বা পাড়াপ্রতিবেশীরা এলে তো কথাই নেই, শুধুই কি আড্ডা? তর্ক… ঝগড়া — সবই চলতো সমানতালে।
সত্যিই ঈদের ছুটিতে বাড়িতে গেলে এমনই থাকতো বাড়ির চেহারা। শুধু আমাদের বাড়ি না, অন্যান্য বাড়ি থেকেও ফুপি-চাচিরা ছুটে আসত এ আড্ডায় যোগ দিতে। আর সে সময়টাও হতো দুপুর এগারোটা কি বিকেল সন্ধ্যা। কত যে ঐতিহাসিক শলা-পরামর্শ, কত বিয়ের সম্বন্ধ পাকাপাকি হয়েছে এ তিন দেওয়ালের ঘরে বসে!
শীতের ছুটিতে বাড়িতে গেলে সে আড্ডা যেন ভোর থেকেই শুরু হতো। ঘুম থেকে উঠেই গরম গরম পিঠে খাওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে হাতমুখ ধুয়ে সবাই এসে পিঁড়ি নিয়ে বসে পড়ত সে হেঁশেলেই। উঠোনে শিশিরভেজা মাটি, কুয়াশায় ঢাকা সকাল আর ঘরের মধ্যে কাঠের উনুনের ধোঁয়া — সে এক রোমাঞ্চকর সকাল ছিল বৈকি!
পৌষ সংক্রান্তির দিন দেখতাম, চাচি, মা, দাদু, দিদি, পাশের বাড়িরও কেউ কেউ এসে সক্কলে মিলে ময়দা, চালের গুড়ো, নারকেল, গুড়, দুধ নিয়ে বসেছে। আর গোটা রান্নাঘরের আশপাশ ম-ম করছে পিঠেপুলি আর পায়েসের গন্ধে।
পুলিপিঠের মধ্যে থাকত মুগের পুলি, ভাজা পুলি, দুধ পুলি, চন্দ্র পুলি আর সেদ্ধ পুলি। অন্য ধরনের পিঠে বলতে পাটিসাপটা, রসগজা, রোড পিঠে, নারকেল পুলি, সেয়ওই পিঠে, পাতসিজার মতো পিঠে।
এখানেই সুযোগ মিলত শক্তি আর ক্ষমতা প্রদর্শনের
গ্রামবাংলা বলি আর শহুরে, আগের দিনের একান্নবর্তী রান্নাঘর মানে সে তেল–চিটচিটে ভাব, কাঠ, ঘুঁটে, উনুনের ধোঁয়া আর লঙ্কা ফোড়নের ঝাঁজ। সে রান্নাঘরের পাশের উঠানজুড়ে শিশুদের খেলাধুলা, পাটি পেতে মা-খালা ফুপুদের কাঁথা সেলাই করা আর পরিবার–প্রতিবেশীর হরেক রকম গল্পের ডালা।
আর কোনো রান্না শেখা মানেই চলে যাও ঠাকুমা, দাদি, মা-কাকিমা-জেঠিমাদের কাছে। কেননা হেঁশেল যে সামলাতে হতো তাদেরই। আর তদারকি করতেন ঠাকুমা বা দাদিরাই।
আবার এ হেঁশেল সামলানোর ফাঁকে ফাঁকেই চলত পারিবারিক রাজনীতির চাল। এখানেই সুযোগ মিলত শক্তি আর ক্ষমতা প্রদর্শনের। বাড়ির সকলে যে সমান না, যার রোজগার বেশি তার বউয়ের গুরুত্বও বেশি। অপরপক্ষে যার রোজগার তুলনামূলক কম, সে মাথা নিচু করেই থাকবে—এমন ঘটনাও তো কম নয়!
এ রান্নাঘরের চারকোণা দেওয়ালের মধ্যেই ছোটর ভেতর দিয়ে অনেক বড়কে বুঝিয়ে দেওয়া যেত, সে কে!
তবে দিন ফুরিয়ে যায়, মানুষও হারিয়ে যায়। রয়ে যায় স্মৃতিগুলো। অনেকেই তাই ফেসবুকে নিজের দেওয়ালে স্মৃতিচারণ করে লেখেন শৈশব, কৈশোরের ফেলে আসা সে পরিচিত মাঠঘাট, বাড়ি, আড্ডা, মানুষের কথা।
সেদিন পরিচিত একজনের লেখাটা খুব মনে ধরে। তিনি লিখেছেন:
'সকাল থাকতেই মা, মেজো কাকিমনি, সেজো কাকিমনি, ছোট কাকার বিয়ে হলে ছোট কাকিমনি ঘুম থেকে উঠেই স্নান সেরে তারপর রান্নার কাজে হাত দিতো। কাজগুলো ভাগ করাও থাকত। মেজো কাকিমনি আমিষ রান্না আর মা নিরামিষ। সেজো আর ছোট কাকিমনি কুটনো আর বাটনা বাটাতে। সুধা দিদি'র কাজ ছিল হাতে হাতে সব এগিয়ে দেওয়া। সকাল নটার মধ্যে সব রান্না যে কমপ্লিট করতে হবে। বাড়ির পুরুষেরা কেউ অফিস, কেউ ব্যবসার কাজে, কেউ বা স্কুলে, কেউ বা কলেজে দৌড়াতো।
'খাবার ঘরে সার দিয়ে আসন পেতে দিতো সুধা দিদি। ছোট বড় মিলিয়ে কুড়ি জন বসতে পারে খাবার ঘরের আকৃতি ছিল তেমনি। সকলে বসে পড়লে মা আর কাকিমনিরা পরিবেশন করে যেত কাঁসার থালা আর বাটিতে পরিপাটি করে নানা পদের রান্না সাজিয়ে।'
আরেকজন লিখেছেন: 'শ্বশুরবাড়িতে এসে এটা দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম... সত্যিই আলাদা অনুভূতি... সকালে কতরকমের চা হতো... সকালের জলখাবার শেষ হতে না হতেই দুপুরের রান্নার কাজ জোর কদমে শুরু হয়ে যেত... কত বড় বড় হাঁড়ি কড়াই... অবাক হয়ে দেখতাম... কাকুরা পাসে গেলে কত মাছ আসতো... পৌষ-পার্বণে সবাই একসঙ্গে বসে পুর পিঠে বানানো হতো... খুব আনন্দের ছিল ওই একটা বছর... পরিবার ছোট হলে হয়তো কাজের ভার হালকা হয়... কিন্তু এ আনন্দগুলো আর পাওয়া যায় না।'
কিছু অলিখিত নিয়ম…
এ একান্নবর্তী রান্নাঘরের কিছু অলিখিত নিয়মই ছিল। যেমন কাজগুলো থাকত একপ্রকার ভাগ করাই। তাই সকাল হলেই, বাড়ির বউ, ঝি'রা সব যার কাজে হাত লাগাতে বসে যেত।
শিল নোড়ার ভার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাড়ির সবচেয়ে পুরোনো গৃহকর্মীর হাতে থাকতো। পুরো রান্নাই হতো বাঁটা মশালাতে। আবার নতুন বউদের আর বাড়ির মেয়েদের হাতে গিয়ে পড়ত সবজি কাটাকুটির দায়।
আবার আরেকটি পর্ব ছিল বাজার আসার। সকালে বাজার আসার আগ পর্যন্ত মোটামুটি ঢিমেতালেই কাজ চলত। বাজারের ব্যাগ বাড়ির কর্তা নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যেত তোরজোড়।
বউ, ঝি, মেয়েরা সব পিঁড়ি আর বড় বড় রূপোলি থাল নিয়ে বসতো আর বাজারের ব্যাগ থেকে বের হতো নানা শাকসবজি, ফলমূল। মাছ-মাংসের আলাদা ব্যাগ! যে যার ভাগেরটা নিয়ে বসে পড়ত কোটাকুটিতে।
'ডুমো সব এক মাপের না হলে স্বাদ কমে যায়'
"আমাদের বাড়ি তখন একান্নবর্তী ছিল। ঠাকুমা বলত, 'বাজার আসার সময় হয়ে গেল সকালের খাবারের পাট মিটলো না, তাড়াতাড়ি করো তোমরা।' স্কুল শিক্ষক দাদু তখন বাজার করে পাঠিয়ে দিতেন কোনো পরিচিত রিকশাওয়ালার হাতে। 'বাবা বাজার পাঠাইসে'—এ হাঁকেই ঠাকুমার মাটির উনুনে নতুন করে আগুন পড়ত।'
গল্পকার স্মৃতিভদ্র গোটা একটি বই লিখেছেন এ একান্নবর্তী রান্নাঘর নিয়ে। নাম দিয়েছেন, রসুইঘরের রোয়াক।
'স্নান শেষে সিঁদুর দিয়ে ঠাকুমা যখন উনুনে আগুন দিত, ততক্ষণে মা-কাকিরা সবজি আর মাছ কেটে কুটে রান্নাঘরের বারান্দায় গুছিয়ে রেখেছে। তবে কুমড়োটি ঠাকুমা নিজ হাতে কাটত। বলত, ডুমো সব এক মাপের না হলে স্বাদ কমে যায়।'
সৈয়দ মওলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শ্রেণির ছাত্র। তার বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে। এ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মওলার পরিবার যৌথ পরিবার। সেখানে তার বাবা-মা তো আছেই, আছে চাচা-চাচি, চাচাতো ভাই-বোন, ভাবি।
তাই ছুটি পেলেই বাড়ি চলে যান তিনি। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি সবার আগে উল্লেখ করেন, রান্নাঘরে বসে একসঙ্গে সন্ধ্যার চা খাওয়ার কথা।
'সকালে যার যার আলাদা পেশার জন্য একসঙ্গে খাওয়া হয় না। বাড়িতে সবাই একসঙ্গে রাতের আর সন্ধ্যার খাবারটা খাই আমরা। বিশেষ করে, সন্ধ্যাবেলা মোটামুটি উপস্থিত সবার হিসেবে কোনো একটা নাস্তা তৈরি হয়। এক্ষেত্রে একেকদিন মা-চাচিদের একেকজন এসব করতেন। কোনো কারণে কিছু তৈরি না হলে চা-টা সবার জন্য একসঙ্গে বানানো হতো,' তিনি বলেন।
শুরুতে তাদের রান্নাঘর ছিল ঘরের বাইরে একটি মাটির ঘর। ২০১১ সালের দিকে আলাদা করে একটি আধাপাকা দালান তোলা হয় সেখানে। 'আমাদের পাকঘরের তালা খোলা হয় ভোর ৬টার আশেপাশে। মা-চাচিরা তো ছিলই, প্রয়োজনভেদে ২-৪ জন নারী-পুরুষ ঘরের নানা কাজের জন্য রাখা হতো। অনেক সময় তাদের পরিবারসহ থাকতেন।
'দেখতাম কেউ রান্না করতেন, কেউ কোটাবাছা করতেন। একা একা রান্নার কাজ চালানো সম্ভব ছিল না। অন্তত দুজন থাকতেনই রান্নাঘরে প্রতিদিন। বাজার থেকে ছোট মাছ নিয়ে আসলে দেখতাম, সব চাচি-ভাবীরা মিলে পরিষ্কার করছেন,' বলেন মওলা।
'বাজারের জন্য নিজেদের একটা ভ্যানই ছিল'
'এ বাজারের লিস্ট করার সময়ও সবাইকে উপস্থিত থাকতে হতো। কার কোনটা আবদার, বা কোনটা সবার হিসেব করে কেনা হবে, সেসব তালিকা করা হতো।
যেহেতু আমাদের বাজার বেশি লাগত, তাই বাজারের জন্য নিজেদের একটা ভ্যানই ছিল। বেশিরভাগ সময় ছোট চাচা কাজের লোককে নিয়ে সপ্তাহে ২ দিন বাজারে যেতেন—মঙ্গলবার এবং শুক্রবার। তারপর ভ্যানভর্তি বাজার নিয়ে আসতেন। এবার প্রয়োজনভেদে রান্না ও ফ্রিজে রাখতেন আম্মু আর চাচিরা,' আরও বলেন তিনি।
তবে কয়েক মাস আগে থেকে যৌথ পরিবার ছেড়ে এখন তারা আলাদা থাকছেন। ফলে, একসঙ্গে খাওয়া ও রান্না হওয়ার জন্য 'অকেশন' দরকার হয় এখন, নতুবা হয় না।
এ চিত্র আজ অনেক পরিবারেরই। সময়ের প্রয়োজনেই যৌথ পরিবার আর নেই, পরিবারগুলো ভেঙে হয়ে গেল একক পরিবার। আর সে একক পরিবারে রান্নাঘরের একমাত্র ঘরনী হলেন ঘরের কর্ত্রী।
একা মানুষ, তাই রান্নাঘরটাও হয়ে গেল সব ঘরের মধ্যে সবচেয়ে ছোট্ট ঘরটি।
'যে বাড়ির রান্নাঘর যত জমজমাট, সে বাড়ি তত সুখের আলয়'
বাড়ির অন্যান্য ঘরের সাজসজ্জায় আমরা যতটা গুরুত্ব দেই, রান্নাঘরের বেলায় কেন জানি একটা অবহেলাই কাজ করে। আমাদের পুরো ঘর সুসজ্জিত, আলোঝলমলে থাকলেও, রান্নাঘরটিতেই যেন জমে থাকে সব ক্লান্তি, অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে ভাব।
হয়তো ভাবি, রান্নার কাজ আর কতটুকু! মেহমান আসলেও তো আর রান্নাঘরে ঢুকবে না। অথচ, রান্নাঘরই কিন্তু অন্যান্য ঘরের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
রেড ইন্ডিয়ানদের এক প্রজাতি নাভাহো ইন্ডিয়ানদের একটি কথা রয়েছে—কোন বাড়িতে কত সুখ তা তার রান্নাঘর দেখে বোঝা যায়।
এ রান্নাঘরেই বোনা হয় পরিবারের সব সদস্যের মধ্যে ভালোবাসার সুতো। যে কোনো গৃহের কেন্দ্রে থাকে রান্নাঘর। সেখানে তৈরি হয় গরম খাবার আর মানুষ ক্রমশ তার পরিবারকে ভালোবাসতে শেখে।
যে বাড়ির রান্নাঘর যত জমজমাট, সে বাড়ি তত সুখের আলয়। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, 'দ্য হোম ইজ হয়্যার দ্য হার্ট ইজ'। আর সুখ হল ছোট্ট বাড়ি, যার রান্নাঘরটি বৃহৎ — বলেছিলেন আলফ্রেড হিচকক।
লেখক লুইস প্যারিশ বলেছেন, রান্নাঘর গুছিয়ে রাখতে পারলে জীবনটাও গুছিয়ে রাখা যায়। একটি রান্নাঘরের প্রতিটি জিনিস থাকতে হয় হাতের নাগালে। খেয়াল রাখতে হয় পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যাপারে।
আগেকার দিনের বড় বিশাল ঘর যেহেতু নেই, তাই রান্নাঘরগুলো ছোট পরিসরের মধ্যেই সাজানো যায় ছিমছাম, আরামদায়ক আর পরিচ্ছন্ন রেখে। রান্নাঘরের দেওয়াল-মেঝে থেকে শুরু করে, কেবিনেট, স্টোরেজ, চুলোর অবস্থান, কাটাকাটির জায়গা, পরিষ্কার করার জায়গা — এমন অনেক খুঁটিনাটি বিষয় মাথায় রাখা দরকার রান্নাঘর সাজানোর সময়।
যেমন, ঘরের আলো হতে হবে উজ্জ্বল বা হালকা রঙের, যেন অন্ধকার না মনে হয়। একইভাবে মেঝের জন্য বর্ডার ও ডেকোর মাঝারি টাইলস ব্যবহার করা ভালো। আর যেহেতু এখন সব বৈদ্যুতিক মেশিনের ব্যবহার হয়, ফলে রান্নাঘরে বৈদ্যুতিক সংযোগ থাকাটিও খুব দরকার।
সময় বদলাচ্ছে
শহুরে রান্নাঘর সব সময়েই ঘরের একটি অংশে, নির্জন দ্বীপের মতো। সারা বাড়ির হইহল্লা থেকে যেন তা একেবারে বিচ্ছিন্ন। ফলে আগের মতো গল্প করতে করতেই রান্না সেরে ফেলার সুযোগ আর হয় না শহুরে একক পরিবারগুলোতে।
তবে সময় বদলাচ্ছে। ছেলে বা মেয়ে উভয়ই সচেতন হয়ে উঠছে। আগের দিনের রান্নাঘরের তেলচিটচিটে, কালো কালির জায়গায় এসেছে পরিষ্কার, উজ্জ্বল ঝকঝকে রান্নাঘরের চল।
গৃহিনীরাও যেহেতু ঘর এবং বাহির দুটোই সামলাচ্ছেন, তাই রান্নার কাজে সাহায্য করতে হাত এগিয়ে দিতে হচ্ছে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও।
পশ্চিমা দেশের আদলে আমাদের দেশেও একটু একটু করে ঢুকে পড়ছে ওপেন কিচেন ও মডিউলার কিচেনের ধারণা।
এ ধরনের রান্নাঘরে সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, রান্নাঘরে ঢুকলে নিজেকে আর বিচ্ছিন্ন মনে হয়না। ফলে মা যেমন রান্নার সময় সন্তানের দিকে খেয়াল রাখতে পারছেন, তেমনি, সন্তানও মা কে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে পারছে। যে সুযোগটা আলাদা রান্নাঘরগুলোতে বোঝার উপায় থাকেনা।
ওপেন মডিউলার কিচেন কনসেপ্টে রান্নাঘরটা যথেষ্ট দৃশ্যমান থাকে। সেখানে যেকোনো সহায়তায় বাড়ির অন্য সদস্যরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এগিয়ে আসতে পারে। অতিথি এলে অতিথিদের সঙ্গে গল্প করতে করেই সেরে নেওয়া যায় রান্নাঘরের কাজ।
রান্নাঘর ঘিরেই থাকে বসার ঘর ও খাবার গ্রহণের জায়গা। ফলে বাড়িরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে তখন এ ঘরটি।
তবে সমস্যাও আছে। যেহেতু আমাদের রন্ধন–সংস্কৃতিতে প্রধান দুটি গুরুতবপূর্ণ উপাদান মশলা আর তেলের ব্যবহার। ফলে পাশ্চাত্যের অনুকরণে তৈরি 'ওপেন কিচেন' নিয়েও কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়ে যায়। খাবারের গন্ধ ও ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ বেশ বড় অসুবিধা। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সমাধান দিতে পারে কিচেন হুড বা চিমনি। রান্নার ধোঁয়া আর গন্ধ খুব সহজে চিমনি শুষে নেয়। এতে ঘরের অন্যান্য অংশে রান্নার গন্ধ তেমন একটা যায় না।
বাড়ির গিন্নিদের থেকে এখন রান্নাঘর প্রসারিত হয়েছে ছেলেমেয়ে স্বামী সবার কাছেই। ওপেন কিচেন এখনো আমাদের দেশে সেভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি। তবে রন্ধন সংস্কৃতিতে এসেছে নারীর পাশাপাশি পুরুষেরও অংশগ্রহণ।
সামনে তা আরও বাড়বে। গালভরা নাম রসুইঘর থেকে সোজা কিচেনের যুগে আমরা এসে পৌঁছেছি। এতে হয়তো কেউকেউ আফসোস করেন রান্নাঘর আর ঘর নেই, হয়ে গেল বিদেশি ধার করা শব্দ 'কিচেন'। নেই মা কাকিদের সে একসঙ্গে রান্নার আয়োজন। নেই বারান্দায় বসে একসঙ্গে সবাইকে পাতে বেড়ে খাওয়ানো।
তবে যৌথপরিবারের রান্নাঘর মানেই যে তা সবসময়ই সুখ সাগরে ভেসে ছিল, তাও কিন্তু নয়।
'এমনও দেখেছি, গোটা ২২-২৫ জনের সদস্যের জন্য একজনই রান্না করে যাচ্ছেন কাজের লোকদের নিয়ে,' বলেন উন্নয়নকর্মী ও লেখক বাসন্তী সাহা। তিনিও বড় হয়েছেন ২২ জনের একটি যৌথ পরিবারে। যেখানে তার চাচা, পিসি ঠাকুমারাও বাদে থাকতেন আরও অনেক আত্মীয়স্বজন।
তিনি বলেন, 'যৌথ পরিবার বা একান্নবর্তী রান্নাঘর যে সবসময়ই খুব গ্ল্যামারাস আর আনন্দের ছিল তা না। পরিবারে যে ছেলের আয় কম, তার স্ত্রীকেই সারাজীবন ভাতের হাড়ি নাড়তে হয়েছে, আর যার স্বামীর বেতন বেশি সে পায়ের ওপর পা তুলে সেজেগুজে বেড়িয়েছে, এ চিত্রও কম নয়।'
সেই হতভাগিনী একজনের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, 'সকালে ঘুম থেকে যখন উঠি তখনো দেখি, সে রান্নাঘরে, যখন স্কুল থেকে ফিরি, তখনো সে চুলোর ধারে, আবার বিকেলে খেলা থেকে ফিরেও দেখতাম সে ঠায় বসে আছে চুলোর ধারেই। দুপুরের ভাত খেতে খেতে তার তিনটে চারটে বেজে যেত। এরপর সন্ধায় আবার চা বসাও।'
'ফলে, পরিবারের সে সকল সদস্যের জন্য হয়তো এ শহুরে ছোট পরিবারের কিচেন ধারণাটিই একধরনের মুক্তি!' বলেন তিনি।