হোন্ডা ও নিসানের একীভূত হওয়ার আলোচনার পেছনে চীনের ইভি’র প্রভাব
চীনা গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর উত্থান বৈশ্বিক অটোমোবাইলে শিল্পে নতুন পরিবর্তন এনেছে। যার সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো হোন্ডা ও নিসানের একীভূত হওয়ার খবর। এমন প্রতিযোগিতামূলক অবস্থায় টিকে থাকতে কোম্পানিগুলো নতুন পথ খুঁজছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল মোটরস জানিয়েছে, এ মাসে চীনে তারা পাঁচ বিলিয়ন ডলারের লোকসান গুনেছে।
জার্মানিতর গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ভক্সওয়াগন কারখানা বন্ধের পাশাপাশি হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা করছে। এর একটি প্রধান কারণ হলো চীনে বাজার হারানোর কারণে ভক্সওয়াগনের মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
এ পরিবর্তনের পিছনে তিনটি মৌলিক কারণ রয়েছে। বর্তমানে চীনে বিক্রি হওয়া নতুন গাড়িগুলোর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক বা প্লাগ-ইন হাইব্রিড গাড়ি। চীনা ক্রেতাদের পাঁচজনের মধ্যে তিনজনই কিনছেন দেশীয় ব্র্যান্ডের গাড়ি। বিশ্বের গাড়ি বাজারে চীনের প্রবেশের পর এ হার এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
শিল্প সম্পর্কিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে চীনের যাত্রীবাহী গাড়ি রপ্তানি পাঁচগুণ বেড়ে গত বছর ৪.১ মিলিয়ন ইউনিটে পৌঁছেছে।
গাড়ির বাজারে চীনের উত্থানের পাশাপাশি বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও পরিবর্তন এনেছে চীন।
তবে গাড়ির বাজারে এই প্রভাব আসতে বেশ সময় লেগেছে। কারণ চীনের স্থানীয় গাড়ি প্রস্তুতকারকদের মধ্যে অধিকাংশই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। আর এগুলো প্রযুক্তি, গুণমান এবং নকশার ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল।
নিসান, হোন্ডা, জেনারেল মোটরস (জিএম), ভক্সওয়াগন এবং অন্যান্য পশ্চিমা ও জাপানি ব্র্যান্ড কয়েক দশক ধরে চীনের বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে এবং সেখান থেকে বিশাল মুনাফা অর্জন করেছিল। এসময় চীন তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে তারা এটা চিন্তাই করতে পারতো না। এসময় জিএম তাদের বার্ষিক মুনাফায় প্রায় আরও দুই বিলিয়নস ডলার যোগ করতে চীনের ওপর নির্ভর করতো।
বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো চীনে বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি) এবং তাদের প্লাগ-ইন হাইব্রিড সংস্করণের মাত্র চার বছরের উত্থান দেখে হতবাক হয়ে পড়েছে। টেসলা চীনে বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রতি ভোক্তাদের আগ্রহ উসকে দেওয়ার পর, আক্রমণাত্মক বেসরকারি কোম্পানিগুলো, বিশেষত বিওয়াইডি দ্রুতই বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি, কম খরচে উৎপাদন এবং সংযুক্ত গাড়ির প্রযুক্তিতে শীর্ষস্থান দখল করে ফেলে।
এখন চীনা কোম্পানিগুলো ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার বাজার দখলের দিকে নজর দিচ্ছে।
বিক্রিতে শীর্ষস্থানে থাকা বিওয়াইডি এখন আগ্রাসীভাবে কমদামি প্লাগ-ইন হাইব্রিড গাড়ি বাজারে নিয়ে আসছে, যেমন- তাদের কিন প্লাস মডেলের গাড়িটি। গাড়িটির বিজ্ঞাপনে ভর্তুকির মাধ্যমে মাত্র ৭,০০০ ডলারে বিক্রি হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কোম্পানিটি থাইল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ব্রাজিলসহ অন্যান্য দেশের কারখানায়ও বিনিয়োগ করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের এই প্রবল প্রতিযোগিতার জবাব দিতে হোন্ডা ও নিসান একীভূত হওয়ার পরিকল্পনা করছে। তাদের লক্ষ্য হলো, বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রযুক্তি, স্বয়ংক্রিয় ড্রাইভিং এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে যৌথভাবে কাজ করে জাপানি গাড়ি নির্মাতাদের অবস্থান শক্তিশালী করা।
যদি হোন্ডা ও নিসান একীভূত হয়, তাহলে বৈশ্বিক গাড়ি বিক্রিতে টয়োটা ও ভক্সওয়াগনের পর তৃতীয় স্থানে উঠে আসবে বলে মনে করেন মিজুহো ব্যাংকের সিনিয়র গবেষক জিন ট্যাং। তবে তিনি মনে করেন এতে তাদের বিক্রির হার যথেষ্ট নাও হতে পারে।
তিনি বলেন, "বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি) বা স্মার্ট গাড়ির প্রযুক্তিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ছাড়া, কেবল এই একত্রীকরণের মাধ্যমে তারা গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলোতে প্রতিযোগিতা করতে পারবে বলে আমি মনে করি না।"
দশকের শুরুতে হোন্ডা ও নিসান তাদের বৈশ্বিক বিক্রির এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি চীনের ওপর নির্ভর করত। কিন্তু এই বছর তাদের চীনের বিক্রি পাঁচ বছর আগের তুলনায় প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
নিসানের সমস্যাগুলো আরও গভীর। কারণ এটি যুক্তরাষ্ট্রেও ভালো ব্যবসা করতে পারেনি। গত মাসে, প্রতিষ্ঠানটি ৯ হাজার ছাঁটাই ও বৈশ্বিক উৎপাদন ক্ষমতা পাঁচভাগের একভাগ হ্রাস করার ঘোষণা দিয়েছে।
নভেম্বরে, সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি অ্যাকটিভিস্ট বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এফিসিমো ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট জানায়, তারা নিসানের একটি বড় শেয়ার কিনেছে।
নিসানের বিনিয়োগকারীরা সম্ভাব্য নতুন অংশীদারের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন যা এই সমস্যাগ্রস্ত গাড়ি নির্মাতার জন্য সহায়ক হতে পারে।
বুধবার টোকিওর শেয়ারবাজারে নিসানের শেয়ারের মূল্য ২৩.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে হোন্ডার শেয়ারমূল্য তিন শতাংশ কমে গেছে।
বুধবারের এই উত্থানের আগে নিসানের বাজার মূলধন প্রায় আট বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল।
তাইওয়ানে অ্যাপলের আইফোনের চুক্তিভিত্তিক নির্মাতা হিসেবে পরিচিত ফক্সকন নিসানের অধিগ্রহণের বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়ার জন্য আলোচনা করেছে। তাদের লক্ষ্য হলো নতুন বৈদ্যুতিক যানবাহন (ইভি) ব্যবসার সম্প্রসারণ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ফক্সকন বিশেষভাবে নিসানের গাড়ি উৎপাদন ও নকশা সংক্রান্ত সম্পদে আগ্রহী।
যদিও এ বিষয়ে নিসান কোনো মন্তব্য করেনি এবং ফক্সকনের একজন মুখপাত্রকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
হোন্ডা ও নিসানের মধ্যে চলমান আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি জানান, নতুন প্রযুক্তির প্রসারে দুই প্রতিষ্ঠানই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কারণ তারা এখনও প্রতি বছর লক্ষাধিক গ্যাসচালিত গাড়ি উৎপাদন করছে যেগুলোর নিয়মিত আপগ্রেড প্রয়োজন।
বিশ্লেষকদের মতে, হোন্ডা ও নিসানের মতো একচেটিয়া ব্যবসা করে আসা কোম্পানিগুলোর জন্য এমন স্মার্ট যানবাহন এবং বৈদ্যুতিক প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা কঠিন।
তবে, একীভূত হয়ে তারা নিজেদের মধ্যেও সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে। যেমন দুটি কোম্পানির মধ্যেই নিজস্ব সংস্কৃতি ও প্রতিযোগিতামূলক পণ্য থাকতে পারে যা সমস্যা তৈরি করতে পারে।
হোন্ডা ও নিসান তাদের গাড়ি বিক্রির অধিকাংশই আসে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও চীনের বাজার থেকে। ইতোমধ্যে হোন্ডার সিআর-ভি মডেলের স্পোর্ট-ইউটিলিটি ভেহিকেল (এসইউভি) গাড়িটির প্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানে আছে নিসানের রগ।
এছাড়া তারা শেয়ার বাজার পুনরুদ্ধার করবে নাকি সংকুচিত অবস্থানে পুনরায় ফিরে আসবে এটা এ দুই কোম্পানির মধ্যে বিরোধের কারণ হতে পারে।
এদিকে ভক্সওয়াগন স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, তার সবচেয়ে বড় বাজার চীনে তারা বিনিয়োগ ও পুনর্গঠন অব্যাহত রাখবে। যদিও তারা বাড়তি খরচ কাটাতে কঠিন পদক্ষেপও নিয়েছে। গত এক বছর ধরে ভক্সওয়াগন চীনের স্থানীয় সরবরাহকারীদের থেকে চীনা উপাদান ব্যবহার করতে শুরু করেছে। এছাড়াও, এটি চীনের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি অর্জনের জন্য স্থানীয় কোম্পানিগুলোতে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগও করছে।