বিলাসবহুল বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন আসাদ সহযোগীরাও, যা যা রেখে গেছেন তারা
সিরিয়ার প্রাক্তন শাসক বাশার আল-আসাদের অন্যতম সহযোগী জামিল হাসান, তার বিরুদ্ধে রয়েছে অসংখ্য নিরীহ নাগরিককে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ। সিরিয়ার বিমানবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হিসেবে তিনি মেজ্জা কারাগারের মতো বেশ কয়েকটি ভয়ঙ্কর বন্দিশালা পরিচালনা করতেন, যেখানে বন্দীদের নিয়মিতভাবে নির্যাতন করা হতো।
আসাদের পতনের পর, ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় তাকেও তার দামস্কের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে পালাতে দেখেন তার প্রতিবেশীরা।
৭২ বছর বয়সি হাসান তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য এবং হাতে গোনা কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে একটি ছোট কনভয়ের গাড়িতে ওঠেন। তাদের সঙ্গে ছিল কেবল কিছু স্যুটকেস।
হাসানের প্রতিবেশী এবং তার কিশোর ছেলে এ দৃশ্য দেখে মন্তব্য করেন, 'আমি সেদিনই বুঝেছিলাম যে আসাদের পতন হয়েছে।'
কয়েক দিন পর, হাসানের অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করলে সেখানে তার তাড়াহুড়ো করে পালানোর চিহ্ন স্পষ্ট দেখা যায়। রেফ্রিজারেটরে একটি অর্ধেক খাওয়া গাজরের কেক প্লেটে ছুরি সহ পড়ে ছিল। বিছানায় ছড়িয়ে ছিল জামাকাপড় ও খালি জুতার বাক্স। ডাইনিং রুমে ফুলগুলো শুকিয়ে গিয়েছিল এবং রান্নাঘরের সিংকের পাশে কাপ ও প্লেট শুকানোর জন্য রাখা ছিল।
হাসানের পড়ার কক্ষে একটি ছবিতে হাসিমুখে হাসান এবং আসাদকে দেখা যায়, যার নিচে লেখা, 'আমাদের আকাশ শুধু আমাদের জন্য, অন্যদের জন্য নিষিদ্ধ।'
প্রতিবেশীদের কাছে 'কসাই' নামে পরিচিত আসাদের সহযোগী হাসান অন্যতম ভয়ঙ্কর নির্যাতনকারী ছিলেন।
হাসান এবং তার মতো অন্যান্য সিনিয়র নেতারা, যাদের অনেকেই আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছেন, দামেস্কের বিলাসবহুল এলাকাগুলো থেকে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছেন। তাদের খুঁজে বের করা এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে ধারণা করছেন যে তারা বিদেশে রাজনৈতিক চুক্তি করে বিচার এড়িয়ে যেতে পারেন।
সিরিয়ায় হাসানের মতো অনেক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা খুঁজে বের করার শপথ করেছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। এই গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত বিদ্রোহীরা বর্তমানে হাসানের অ্যাপার্টমেন্ট দখল করেছে। অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় হাতে লেখা একটি নোটে সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে: 'ভেতরে প্রবেশ নিষেধ।' বিদ্রোহীরা হাসানের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে একজন বলেন, 'জানি না—নরকে চলে গেছে হয়তো।'
'কুকুর মেরে ফেলার হুমকি'
হাসানের নির্জন দামেস্কের রাস্তায় এখন বেশিরভাগ অ্যাপার্টমেন্টের জানালাগুলো বন্ধ। দরজায় কড়া নাড়লেও ভেতর থেকে কোনো সাড়া মেলে না।
যারা কথা বলতে সাহস পান, তারা জানালেন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর প্রতিবেশী হয়ে বসবাস করার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। এক নারী, যিনি হাসানকে পালিয়ে যেতে দেখেছেন, বললেন, 'আমরা কথা বলতে খুব ভয় পেতাম। তাদের পাশেই বসবাস করা ভয়ানক ছিল।'
যুক্তরাষ্ট্রে হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তিনি 'বেসামরিক বন্দিদের, এমনকি মার্কিন নাগরিকদেরও, নির্মম এবং অমানবিক আচরণের ষড়যন্ত্রে' জড়িত ছিলেন। এ বছর ফ্রান্সে তাকে দুই সিরিয়ান-ফরাসি নাগরিককে আটক, গুম এবং নির্যাতনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। একইসঙ্গে জার্মানিও তাকে খুঁজছে। ইন্টারপোলের একটি রেড নোটিসে হাসানের ছবি এবং 'যুদ্ধাপরাধের ষড়যন্ত্র' অভিযোগে তাকে খোঁজার বিবরণ রয়েছে।
বেসামরিক বিক্ষোভকারীদের দমনে তার ভূমিকার কারণে তার ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি এবং সম্পদ জব্দ করা হয়। ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে, দামেস্কসহ বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভরত জনতার ওপর এয়ার ফোর্স ইন্টেলিজেন্সের সদস্যরা টিয়ার গ্যাস এবং গুলি ছোড়ে, এতে কমপক্ষে ৪৩ জন মারা যায় বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
প্রতিবেশীরা হাসানকে এক ভয়ঙ্কর ব্যক্তিত্ব হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি সবসময় দেহরক্ষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতেন এবং তার কাছে যাওয়ার সাহস কারও ছিল না।
তার অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সামনে একটি অস্থায়ী নিরাপত্তা চৌকি সবসময় সামরিক কর্মীদের দ্বারা পাহারা দেওয়া হতো। তবে শাসনের পতনের আগের রাতে, সেই নিরাপত্তাকর্মীরা ইউনিফর্ম খুলে ফেলে এবং তাদের অস্ত্র ত্যাগ করে, জানালেন আরেক প্রতিবেশী।
২৭ বছর বয়সি চলচ্চিত্র নির্মাতা আমর আল-বাকরি, যিনি পাশের ভবনে পরিবার নিয়ে থাকেন, বললেন, 'সেই চৌকি প্রথমবারের মতো আলোহীন, নিস্তব্ধ, এবং জনশূন্য অবস্থায় দেখেছিলাম।'
আমর জানালেন, সবাই জানতো হাসান দামেস্কের ভেতরে এবং বাইরে সিরিয়ানদের কী করেছে, কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস করতো না। 'শুধু সকালে সালাম দিয়ে বলতাম "সুপ্রভাত স্যার"। কিন্তু তিনি কোনো উত্তর দিতেন না।'
একবার তাদের পোষা কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করলে, হাসানের দেহরক্ষীরা সেটিকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। পরবর্তীতে তারা বাধ্য হয়ে কুকুরটি অন্যত্র দিয়ে দেয়। এমনকি তারা নিরাপত্তা চৌকি সরানোর অনুরোধ জানালে, দেহরক্ষীরা তাদের বাড়ি পরিবর্তনের পরামর্শ দেয়।
হাসানের দেহরক্ষীরা নিয়মিত পুরো রাস্তায় তল্লাশি চালাত এবং অতিথিদের ব্যাগ পরীক্ষা করত।
'কখনও যদি আমার বাড়িতে কোনো মিস্ত্রি বা কারিগর কিছু মেরামত করতে আসত, দেহরক্ষীদের একজন এসে দেখত সত্যিই কিছু মেরামত করতে হচ্ছে কি না,' বললেন হাসানের ভবনে বসবাসকারী এক নারী।
প্রতিবেশীরা আরও জানালেন, হাসানের অ্যাপার্টমেন্টে একটি 'বিশেষ বিদ্যুৎ লাইন' ছিল, যার কারণে তার পরিবারের বাড়িতে সবসময় বিদ্যুৎ থাকত, অথচ আশপাশের বাড়িগুলো অন্ধকারে ডুবে থাকত।
অ্যাপার্টমেন্টের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে যিনি ডাক পেতেন, সেই ইলেকট্রিশিয়ান জানালেন, বহু বছর ধরে তিনি হাসানকে চিনতেন, তবে সেটা দূর থেকে। তিনি বলেন, 'হাসান খুবই কঠোর ছিলেন—একজন সামরিক মানসিকতার মানুষ। তিনি ছিলেন একজন কসাই—তার ভেতরে কোনো দয়া ছিল না।'
বিবিসিকে তিনি জানান, তিনি নিজেও একবার জেলে ছিলেন, যদিও সেটা মেজ্জে কারাগারে নয়। সেখানেও তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।
স্থানীয় দোকানদার মোহাম্মদ নৌরা বললেন, তিনি হাসানকে পছন্দ করতেন না, তবে বাইরে থেকে সমর্থন দেখানোর ভান করতে হতো।
'আমরা এখন খুশি,' বললেন তিনি। 'কেউ কখনো ভাবেনি এমন কিছু ঘটবে।'
বিলাসবহুল জীবন
হাসানের অ্যাপার্টমেন্টের নিচেই থাকতেন প্রভাবশালী গোয়েন্দা কর্মকর্তা হুসাম লুকা। নির্মম ও চতুর প্রকৃতির জন্য অনেকের কাছেই তিনি পরিচিত ছিলেন 'মাকড়সা' নামে।
সিরিয়ার জেনারেল সিকিউরিটি ডিরেক্টরেটের প্রধান লুকার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি হেফাজতে থাকা বিরোধীদের নির্যাতন করেছেন এবং হোমস শহরে গণহত্যা চালিয়েছেন।
লুকার বাড়িতে বিদ্রোহীরা তার এবং বাশার আল-আসাদের ছবি, রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া পুরস্কার এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নথি পেয়েছে। তার নাম উল্লেখ করে একটি সনদে লেখা ছিল, 'দক্ষতা ও কঠোর পরিশ্রমের জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হলো।'
বিদ্রোহীদের একজন জানায়, লুকার মতো শাসকদের এই বিলাসবহুল জীবনযাপন আসাদের শাসনের নির্মম চিত্র তুলে ধরে। প্রতিবেশীরা জানান, এই ভবনে কেউ কারও সঙ্গে মেশেনি, এবং লুকা ও তার মতো ব্যক্তিদের ব্যাপারে তারা খুব কমই জানতেন।
হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, নিখোঁজ মার্কিন সাংবাদিক অস্টিন টাইসের বিষয়ে তথ্য থাকতে পারে এমন অল্প কয়েকজন কর্মকর্তার মধ্যে লুকা একজন।
লুকা এবং আসাদের ছবি এখনও তার অ্যাপার্টমেন্টে রয়ে গেছে, বিভিন্ন আকার ও স্টাইলে ছাপানো। সঙ্গে ছিল নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা সংক্রান্ত নথি, এবং রাশিয়ার বিদেশি গোয়েন্দা সেবা থেকে প্রাপ্ত পদক ও সনদপত্র। আসাদ বর্তমানে রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন।
একটি সনদে লেখা ছিল, 'এটি দক্ষিণ সিরিয়ার গোয়েন্দা পরিষেবার সমন্বয়কের জন্য দেওয়া হয়েছে, যিনি অত্যন্ত পেশাদারিত্ব দেখিয়েছেন এবং সিরিয়ার জনগণের কল্যাণে কঠোর পরিশ্রম করেছেন।'
যখন বিদ্রোহীরা অ্যাপার্টমেন্টটি খালি করছিল, এক প্রতিবেশী এসে জানতে চাইলেন কী হচ্ছে।
লুকা সম্পর্কে তার ধারণা জানতে চাইলে তিনি বললেন, 'আমরা নিজেদের মতো থাকি, তারা নিজেদের মতো থাকে। এখানে কেউ কারও সঙ্গে মেশত না'।
অন্য একটি বিলাসবহুল বাড়িতে বিদ্রোহীরা জানায়, তারা চাঁদনি ঝাড়বাতির নিচে মার্বেলের মেঝেতে কম্বল পেতে ঘুমাচ্ছে। আধুনিক রান্নাঘরে তারা ক্যাম্প স্টোভে রান্না করছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে সোফা এবং আর্ম চেয়ারে তাদের অস্ত্রগুলো রাখা।
এক বিদ্রোহী বলেন, 'আমাদের এসবের (আসবাবপত্র) কিছুই দরকার নেই।'
অন্য এক বাড়িতে, একটি বড় পরিবার আউটডোর সুইমিং পুলসহ একটি সুবিশাল গ্রাউন্ড-ফ্লোর অ্যাপার্টমেন্টে অবস্থান করছে।
এই এলাকার সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন বাড়ি হতে পারে দেশের একজন অন্যতম পরিচিত ব্যবসায়ী খোদর তাহের বিন আলী, যিনি আবু আলি খোদর নামেও পরিচিত।
বিন আলীকে সিরিয়ান শাসনের সমর্থন ও লাভের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইইউ দ্বারা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
তার বাড়িতে একটি লিফট, সম্পূর্ণ আকারের জিম, ইনডোর সুইমিং পুল, হট টাব এবং সাওনা, এবং একটি অভিজাত রান্নাঘর রয়েছে।
বিন আলীর শোবার ঘরে দুটি সোনালী রঙয়ের সেফ রয়েছে, যেখানে অনেক ঘড়ি রাখা যেতে পারে। একটি ড্রয়ারে বিলাসবহুল ব্র্যান্ড অডেমারস পিগুয়েতের একটি ওয়ারেন্টি কার্ড পাওয়া যায়। আলমারিতে একটি অস্ত্রের কেস এবং অলংকারের বাক্সগুলো খালি ছিল।
শিশুদের শোবার ঘরে এখনও খেলনা এবং একটি লুই ভুইটন হ্যান্ডব্যাগ মেঝেতে রাখা। স্কুলের কাজ এবং প্রতিবেদন আলমারিতে রাখা ছিল। একটি কোরআন কাজের টেবিলে রাখা ছিল, যার ওপর লেখা ছিল "উপহার হিসেবে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ থেকে।"
বিন আলীর বাড়ির কাছেই আলি মামলুকের বাড়ি। তিনি আসাদের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং শাসন সরকারের শীর্ষ সদস্য। তাকে 'ব্ল্যাক বক্স' নামে ডাকা হতো কারণ তিনি সংবেদনশীল তথ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন।
ফ্রান্সের আদালত তাকে হাসানের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করেছে এবং ২০১২ সালে ত্রিপোলিতে বিস্ফোরণে আহত ও নিহতদের জন্য লেবাননে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
'এখানে কেউ চলাফেরা করত না, কেউ এই জায়গায় আসতে পারত না। আজকে আমি প্রথমবার এই জায়গাটি কাছ থেকে দেখছি,' বলে ১৭ বছর বয়সি মো রাসমি তাফতাফ, যাদের পরিবারের একটি বাড়ি এখানে রয়েছে।
'সে যখন আসত বা বের হত, নিরাপত্তা রক্ষীরা রাস্তাগুলো বন্ধ করে দিত,' বলেন একজন প্রতিবেশী।
বিদ্রোহীরা বর্তমানে এই নেতাদের খোঁজে রয়েছে। সিরিয়ার মিডিয়া ও ফ্রিডম সেন্টার বিবিসিকে জানিয়েছে, এই নেতারা হয়তো মিত্র দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন বা নতুন পরিচয় ব্যবহার করে পালিয়েছেন। তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন।
'কিছু হয়তো মিত্র দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে, যা ভবিষ্যতে তাদের ফেরত পাঠানো কঠিন করতে পারে, আবার কিছু হয়তো সিরিয়াতেই গোপনে অবস্থান করছে।'
হাসানের প্রতিবেশীরা যারা কথা বলেছেন, তারা আশা করছেন, একদিন হাসান শাস্তি পেতে সিরিয়ায় ফিরে আসবে।