রোগীদের বিদেশমুখীতা ঠেকাতে স্বাস্থ্যখাতের সংস্কার ও বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান বিশেষজ্ঞদের
চিকিৎসার জন্য রোগীদের বিদেশমুখীতা ঠেকাতে অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেশের স্বাস্থ্যখাত সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
শনিবার (২১ ডিসেম্বর) রাজধানীর সিরডাপ অডিটোরিয়ামে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল প্র্যাকটিশনার্স এসোসিয়েশন (বিপিএমপিএ) আয়োজিত 'চিকিৎসা সেবায় বিদেশমুখীতা: আমাদের উত্তরণের উপায়' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তারা বলেন, মেডিকেল ট্যুরিজম (চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া) কেবল অন্য একটি দেশে সেবা নেওয়া নয়, এটি একটি দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার দুর্বলতার প্রতিফলন। মেডিকেল ট্যুরিজমের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার হারাচ্ছে— যার বেশিরভাগই ভারতের দ্রুত-বর্ধনশীল স্বাস্থ্যখাতকে শক্তিশালী করছে।
বক্তারা বলেন, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ মেডিকেল ট্যুরিজমের শিকারে পরিণত হয়েছে। ২০২৩ সালে ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৫৭০ জন বাংলাদেশি স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিদেশ ভ্রমণ করেছেন— যা আগের বছরের তুলনায় ৪৮ শতাংশ বেশি। এটি নিছক পরিসংখ্যান নয়, বরং এটি দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত নাগরিকদের চাহিদার সঙ্গে কতটুকু তাল মেলাতে পারছে, তার ইঙ্গিত দেয়।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল বলেন, "চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখীতার অন্যতম কারণ হলো আস্থাহীনতা। এর সাথে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অদক্ষতাও দায়ী। এছাড়া, আমাদের ব্যবহার ও অযত্নের কারণেও রোগীরা বিদেশি ছোটেন।"
"তবে আমরা রোগীরাও অধ্যাপক এবং খ্যাতিমান ডাক্তার ছাড়া চিকিৎসক দেখাতে চাই না; এমনকি আশা করি, একজন ডাক্তার ১৫ মিনিট ধরে রোগী দেখবেন, পরামর্শ দেবেন। আমাদের এই ধারণাও বদলাতে হবে।"
''স্বাস্থ্যখাতে বেসরকারি বিনিয়োগ কম। বর্তমানে চিকিৎসায় যে সংকট তৈরি হয়েছে এটি উত্তরণে বেসরকারি নিয়োগ বাড়াতে হবে। প্রতিবেশি দেশ চিকিৎসা বন্ধ করেছে, এটাকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে চিকিৎসা সক্ষমতা বাড়াতে হবে," যোগ করেন অধ্যাপক ডা. নাজমুল।
তিনি আরও বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলো ব্যয় কমালে ও চিকিৎসকদের ব্যবহারে উন্নতি হলে রোগীর আস্থা বাড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, স্বাস্থ্যখাতের মান উন্নয়নের জন্য একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন, সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক বিপণন প্রচারণা দরকার। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব এই উদ্যোগে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে। মেডিকেল ট্যুরিস্টদের বিদেশমুখী প্রবাহ ঠেকাতে প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা এবং শুরুতেই রোগ নির্মূলের ওপর জোর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
অনুষ্ঠানে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ বলেন, "ভারত ভিসা বন্ধ করে আমাদের উপকার করেছে। আমাদের সক্ষমতা বাড়তে সহযোগিতা করেছে।"
গোলটেবিলে বলা হয়, সরকারের উচিত স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোখাতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করা, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ করে বিশেষায়িত স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর উন্নয়নে অগ্রাধিকার দেওয়া, বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবা জায়ান্টদের সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতা এই অগ্রগতিকে দ্রুততর করতে পারে— যা নিয়ে আসবে দক্ষতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির সমন্বয়।
বক্তারা বলেন, স্বাস্থ্যখাতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দেশের চিকিৎসা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলোকে বৈশ্বিক মানে উন্নীত করতে হবে এবং মেধা ধরে রাখতে শক্তিশালী প্রণোদনা ব্যবস্থা প্রয়োগ করতে হবে, যাতে মেধাবীরা দেশে ফিরে আসেন।
বৈঠকে আরও বলা হয়— জনস্বাস্থ্য প্রচারণা, প্রাথমিক চিকিৎসা অবকাঠামো এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক কর্মসূচিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে অনেক রোগের স্থানীয় সমাধান করা যেতে পারে, এতে ব্যয়বহুল এবং রোগের শেষ পর্যায়ের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন কমে আসবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়— ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের সময়মতো শনাক্তকরণ এবং ব্যবস্থাপনা জটিলতা হ্রাস করা যেতে পারে— যা বর্তমানে রোগীদের বিদেশি হাসপাতালের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব ডা. মো. সারোয়ার বারী বলেন, "রোগীদের বিদেশগামীতার কারণে প্রতি বছর ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। চিকিৎসায় বিদেশমুখীতা কমাতে দেশে রোগ শনাক্তের খরচ কমিয়ে আনতে হবে।"