রোগী ও চিকিৎসকের সুরক্ষায় আলাদা আইন প্রয়োজন: বিশেষজ্ঞরা
দেশের হাসপাতালগুলোতে প্রায়ই চিকিৎসায় অবহেলা, ভুল চিকিৎসাসহ বিভিন্ন অভিযোগে হাসপাতাল ভাঙচুর, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর হামলা, চিকিৎসক গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটে। এতে ব্যাহত হয় স্বাস্থ্য সেবা, রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কে দেখা দেয় আস্থাহীনতা। এসব সমস্যা সমাধানে ডাক্তার ও রোগীর সুরক্ষার জন্য আলাদা আইন প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০১৫ সাল থেকে স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা-সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের চেষ্টা চললেও এখনও তা চূড়ান্ত হয়নি। ২০১৫, ২০১৮ ও ২০২৩ সালে খসড়া প্রণয়ন হলেও তা পূর্ণাঙ্গতা পায়নি।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর 'স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৪'-এর খসড়া মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রস্তাবিত স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনে রোগী বা চিকিৎসক কারও সুরক্ষার কথা নেই। এটি ১৯৮২ সালের 'দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেজ্যুলেশন) অর্ডিন্যান্স'-এর হালনাগাদ সংস্করণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অর্ডিন্যান্সে রোগী ও চিকিৎসকের সুরক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। রোগী ও চিকিৎসকের সুরক্ষার জন্য আলাদা আইন প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ টিবিএসকে বলেন, রোগীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রটোকলভিত্তিক সেবা প্রয়োজন।
উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, রোগীর অপারেশনের আগে কী কী পরীক্ষা করা প্রয়োজন তার চেকলিস্ট থাকবে; অপারেশনে কী কী যন্ত্রপাতি থাকবে, সেগুলো স্টেরিলাইজড করা কি না তার চেকলিস্ট থাকবে; পোস্ট-অপারেটিভে কী কী চিকিৎসা দেবে তার চেকলিস্ট থাকবে।
'নার্সরা ওষুধ ঠিকমতো দিচ্ছে কি না, তার চেকলিস্ট থাকবে। এগুলো সুনির্ষ্টিভাবে আইনে থাকতে হবে। রোগীদের হাসপাতালে বা সরকারকে অভিযোগ করার করার সিস্টেম থাকতে হবে,' বলেন আবদুল হামিদ।
তিনি আরও বলেন, 'স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও চিকিৎসকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এমন একটা ব্যবস্থা করতে হবে যাতে ডাক্তারের গায়ে হাত তুলতে না পারে, কেউ যেন কোনো হাসপাতাল ভাঙচুর করতে না পারে। ডাক্তারের ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুল হলে তার জন্য আলাদা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা করতে হবে, ফৌজদারী আইনে নয়।'
আবদুল হামিদ বলেন, 'স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষার অধ্যাদেশ ২০২৪ হাসপাতাল পরিচালনার আইন। এটি দিয়ে রোগীর নিরাপত্তা ও ডাক্তার বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। আলাদা আইন লাগবে।'
গত ১৬ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর গ্রিন রোডের গ্রিন লাইফ হাসপাতালে নেওয়ার এক ঘণ্টা পর আইসিইউতে মারা যান আজিজুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। এরপরই চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তোলেন তার পরিবার।
পরিবারের করা মামলায় বর্তমানে কারাগারে আছে আজিজুর রহমানকে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া ডা. সজীব নজরুল।
এদিকে গত ২৪ নভেম্বর যশোর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে যশোরের কেশবপুর মডার্ণ হাসপাতালের চিকিৎসক আবু বক্কার সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার অভিযোগ আনেন মনিরামপুর উপজেলার ঝাঁপা গ্রামের বাসিন্দা ফিরোজা বেগম।
সি-সেকশনের সময় তার মেয়ে জলির জরায়ু কেটে ফেলা ও অবহেলায় নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করেন ফিরোজা।
আজিজুর রহমান ও ফিরোজা বেগমের মতো রোগীদের অভিযোগ এবং ডা. সজীব নজরুলের মতো ডাক্তারদের জেল-জরিমানার সমাধানে রোগী ও ডাক্তারের জন্য আলাদা আইন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটিজ-এর উপদেষ্টা ডা. আব্দুন নূর তুষার।
তিনি বলেন, 'স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন ২০২৪-এর খসড়া বাতিল করে নতুন আইন করতে হবে রোগী ও ডাক্তারের জন্য। হাসপাতাল পরিচালনার জন্য আলাদা আইন করতে হবে।'
ডা. তুষার বলেন, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের তুলনায় তিনগুণ রোগী আসে। এ চাপ কমাতে চিকিৎসা ব্যবস্থায় রেফারেল সিস্টেম চালু করতে হবে, যাতে সব রোগী মেডিকেল কলেজে ভিড় না করে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন রোগের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। 'কোন রোগ বাড়িতে থাকলেই ভালো হয়, কোন রোগে জেনারেল প্র্যাকটিশনারকে দেখাতে হবে আর কোন রোগে হাসপাতালে যেতে হবে, সে সম্পর্কে রোগীদের অ্যাওয়ারনেস তৈরি করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে।'
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সদস্য মোজাহেরুল হক বলেন, রোগী ভুল চিকিৎসা বা অবহেলার অভিযোগ করলেই তা তদন্ত করে দেখতে হবে।
'এতে যদি হাসপাতালের চিকিৎসক বা কর্মীদের দায়ী পাওয়া যায়, তাহলে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। ডাক্তার রোগীর সুরক্ষা নিশ্চিতে এবং আস্থাহীনতা দূর করতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে আমরা সুপারিশ করব,' বলেন তিনি।