বাস্তবায়নে অগ্রগতি না থাকায় স্বাস্থ্য খাতের এডিপি বরাদ্দ ৪৫ শতাংশ কমানো হবে
২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বরাদ্দের মাত্র ২ দশমিক ৯১ শতাংশ খরচ হয়েছে। চলমান প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি না থাকায় রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার এ বিভাগের উন্নয়ন তহবিল ৪৫ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করেছে সংশোধিত বাজেটে।
বিভাগের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের বাজেটে এডিপির অধীনে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য ১৩ হাজার ৭৪১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হলেও, তা কমিয়ে সাত হাজার ৬০০ কোটি টাকা করার প্রস্তাব উঠেছে।
এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে বরাদ্দ রাখা হয়েছে পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা, এবং প্রকল্প ঋণ বা অনুদান হিসেবে বরাদ্দ ধরা হয়েছে এক হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বরাদ্দ কাটছাঁটের তালিকায় রয়েছে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে নামকরণ করা কয়েকটি প্রকল্প। এর মধ্যে গোপালগঞ্জ জেলার একটি পরিকল্পিত প্রকল্প স্থগিত করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এডিপি বাস্তবায়নের অগ্রগতি বিশ্লেষণ করে বরাদ্দ কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাদের মতে, বিভাগের বরাদ্দকৃত তহবিল পুরোপুরি ব্যবহার করা সম্ভব হবে না, তাই সংশোধিত এডিপি বাজেট যৌক্তিকভাবে হ্রাস করা হয়েছে।
বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সরকার পরিবর্তনের কারণে অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে চলমান প্রকল্পগুলোতে কার্যত কোনো অগ্রগতি হয়নি।
'সংশোধিত বরাদ্দ অর্থবছরের বাকি মাসগুলোতে বাস্তবসম্মতভাবে ব্যবহারের লক্ষ্যে এ সমন্বয় করা হয়েছে,' বলেন তিনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে জিডিপির ৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের পরামর্শ দিলেও, বাংলাদেশে এ হার ১ শতাংশেরও কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য বাজেট আরও কমানোর এ সিদ্ধান্তে এ খাতে সরকারি ব্যয়ের রুগ্নদশা আবারও ফুটে উঠল।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা চিকিৎসা ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ নিজেদের পকেট থেকে পরিশোধ করছেন। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে এ ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন টিবিএসকে বলেন, বাজেটে স্বাস্থ্য খাত সবসময়ই উপেক্ষিত থেকে এসেছে। এ খাতে বরাদ্দ প্রকৃত চাহিদার তুলনায় কমই থাকে। এখন আরও কমানো হলে চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে।
তবে তিনি বলেন, 'কোন প্রকল্পগুলো কাটছাঁট করা হচ্ছে তা বিবেচ্য। যদি অবকাঠামো উন্নয়ন বা সরঞ্জাম সংগ্রহের ক্ষেত্রে ব্যয় হ্রাস করা হয়, তবে বর্তমান রাজস্ব পরিস্থিতিতে তা যৌক্তিক হতে পারে। তবে বিদ্যমান অবকাঠামো ও সরঞ্জামের কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ানো সম্ভব।'
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুসারে, চলতি অর্থবছরের জুলাই–অক্টোবর সময়ে সব মন্ত্রণালয়ে এডিপি বাস্তবায়নের গড় হার ছিল ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ।
আওয়ামী লীগ সরকার বাজেট বরাদ্দ করলেও জুলাই মাসজুড়ে চলা বিক্ষোভের কারণে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এ পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে হাসিনা সরকারের পতনের কারণ হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে চলতি অর্থবছরের বরাদ্দের জন্য দরপত্র আহ্বান করাও বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, প্রস্তাবিত বাজেট কাটছাঁটের বিষয়ে ইতোমধ্যে অর্থ বিভাগে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে বাজেট কমানো সত্ত্বেও সংশোধিত বাজেটে প্রকল্পের সংখ্যা ১৫ থেকে ১৯-এ উন্নীত করা হয়েছে।
আইএমইডি-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩–২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অধীনে ৪০টি প্রকল্পের জন্য নয় হাজার ৩৬০ কোটি ৬৮ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়। তবে এ বরাদ্দের কেবল সাত হাজার ১৭৫ কোটি টাকা, অর্থাৎ ৭৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ খরচ হয়েছে। মূল বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১২ হাজার ২০৯ কোটি টাকা।
২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের জন্য মোট ৪১ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য ৩০ হাজার ১২৫ কোটি টাকা এবং চিকিৎসা শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য বরাদ্দ ১১ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা তহবিল বরাদ্দ হয়।
যে-সব প্রকল্পে বরাদ্দ হ্রাস, স্থগিত
এডিপি বরাদ্দ থেকে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে দেওয়া হয়েছে দুই হাজার ৫৮৮ কোটি ২১ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৫০০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগার থেকে এবং দুই হাজার ৮৮ কোটি ২১ লাখ টাকা প্রকল্প ঋণ বা অনুদান হিসেবে বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার এ বরাদ্দ কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জানা গেছে, প্রকল্প ঋণ বা অনুদান থেকে ৪০০ কোটি টাকা এবং সরকারি কোষাগার থেকে আরও ২০০ কোটি টাকা কমানো হবে।
মানিকগঞ্জে এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) একটি প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য বরাদ্দ অর্ধেক করা হয়েছে। এ প্রকল্পের জন্য আগে বরাদ্দ ছিল এক হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা।
গোপালগঞ্জে ৫২১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা বরাদ্দের এসেনশিয়াল বায়োটেক অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার প্রকল্পটি বাতিল করা হয়েছে।
গোপালগঞ্জে ইডিসিএল-এর তৃতীয় কারখানা প্রকল্প (দ্বিতীয় সংশোধন) স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। যদিও চলতি অর্থবছরে এ প্রকল্পের জন্য কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি।
এ ছাড়া গোপালগঞ্জের শেখ লুৎফর রহমান ডেন্টাল কলেজের জন্য বরাদ্দ কমানো হবে। এ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল ৪১ কোটি ৪২ লাখ টাকা।
শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং জামালপুর নার্সিং কলেজ স্থাপন প্রকল্প আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে, যার ফলে ৫৬৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা সাশ্রয় হবে।
সুনামগঞ্জে শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রকল্পে ৫০১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ব্যয় (প্রথম সংশোধন) স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
স্ট্রেংদেনিং রেগুলেটরি সিস্টেম ফর ভ্যাকসিনস, ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড থেরাপিউটিকস প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ৯৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকাও বাদ দেওয়া হয়েছে। এ বছরের জানুয়ারিতে অনুমোদিত নতুন এ প্রকল্পে প্রথমবারের মতো তহবিল বরাদ্দ করা হয়েছিল।
আরও কিছু চলমান প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ কমানো হয়েছে বলেও জানা গেছে।
এর আগে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে নামকরণ করা নয়টি হাসপাতালের নাম পরিবর্তন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
স্বাস্থ্য বাজেট অপর্যাপ্ত
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অনুযায়ী, জাতীয় বাজেটের অন্তত ১৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়া উচিত। বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ডব্লিউএইচও-এর নির্দেশনার সঙ্গে মিল না থাকলেও, জাতীয় বাজেটের অন্তত ১০ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, 'স্বাস্থ্য খাতে বাজেট প্রকৃত চাহিদার তুলনায় খুবই কম। আরও কমানোটা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক।'
তিনি আরও বলেন, 'এ সীমিত তহবিল দিয়ে দেশের ১৭ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের উচিত জিডিপির অন্তত আড়াই শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা।'
তবে বাজেট বাড়ানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কার্যকরী সক্ষমতা বাড়ানোও জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি। 'শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, বরাদ্দ যথাযথভাবে কাজে লাগানোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে,' বলেন তিনি।