পাপিয়ের মাশে: মেক্সিকান উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ
উত্তর আমেরিকার দেশ মেক্সিকোতে ওলমেক, মায়া, এজটেকের মতো সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল। মেক্সিকান সংস্কৃতি তাই নানান বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। হাজার বছরের কুসংস্কার ও রীতিনীতির সাথে আধুনিকতার চমৎকার মেলবন্ধন দেখা যায় মেক্সিকান উৎসবের নানা অনুষঙ্গে।
আমরা রাস্তায় বেরোলে মানুষ আর গাড়িঘোড়া ব্যতীত কী দেখি! মেক্সিকোর রাস্তায় আপনার দেখা হয়ে যেতে পারে পাপিয়ের- মাশের (papier-mâché) সাথে! নিজেদের ভেতর প্রাণের অস্তিত্ব না থাকলেও, কাগজের তৈরী এসব ভাস্কর্য মেক্সিকোর সব উৎসবকে জীবন্ত করে তোলে।
মেক্সিকোতে কোন পার্টিতে যাবেন, আনন্দ-মিছিলে যোগ দিবেন বা ছুটির দিনে ঘর সাজাবেন- পাপিয়ের-মাশের (papier-mâché) মুখোমুখি হতেই হবে। এরা কার্তোনেরা (cartonería) হিসেবেও সুপরিচিত। স্প্যানিশ ভাষায় কার্ডবোর্ড শব্দের সমার্থক cartonería। শিশুদের জন্মদিন, বিয়ের মত সামাজিক উৎসব কিংবা হ্যালোউইনের মেক্সিকান সংস্করণ হিসেবে পরিচিত মৃতদের দিন (Día de los Muertos)- সকল উৎসবের অপরিহার্য অংশ সদলবলে এই পাপিয়ের-মাশে!
ধারণা করা হয়, লাতিন আমেরিকান অন্যান্য সংস্কৃতির মতো, কার্তোনেরা'র (cartonería) শিকড়ও ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ এবং ক্যাথোলিক ধর্মীয় রীতির মাঝে প্রথিত। অর্থহীন নির্জীব পুতুল হয়ে নয়; মেক্সিকোর এই কাগুজে শিল্পকর্মগুলো সময়ের প্রতিচ্ছবি মেলে ধরে। লিকলিকে খুলির ঠোটঁজুড়ে কখনো থাকে বিদ্রূপাত্মক হাসি, কখনো ব্যানার-পোস্টারে তুলে ধরা হয় সমসাময়িক ডার্ক হিউমার।
"কার্তোনেরা হলো দেয়ালচিত্রের মত, আপনি একে আঁকবেন ঠিকই তবে পাঁচ বছর পরে এসে একই জায়গায় একে দেখতে পাবার আশা করবেন না, - কাগজের তৈরী বর্ণিল শিল্পকর্মের চলমানতা সম্পর্কে এভাবেই বলেন মেক্সিকান লেখক লে অ্যান থেলমাদেটার।
"এটি শিল্প গড়ার সাথে সম্পর্কিত, শিল্প সবসময় স্থির নয়"।
পাপিয়ের-মাশের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন ধারণা শোনা যায়। মেক্সিকানরা পাপিয়ের- মাশে প্রথম সৃষ্টি করেনি। ফরাসীরাও না বরং তাঁরা এর যা নামকরণ করে তা অনুবাদ করলে হয় 'চিবোনো কাগজ'। আঠালো কাঠের মন্ড থেকে প্রস্তুতকৃত প্রাচীনতম পাপিয়ের- মাশের টুকরাগুলি চীনের হান রাজবংশ থেকে আসে। চীনা উদ্ভাবিত আদি কাগজ, পাতলা ও অনমনীয় হলেও, বার্নিশ এবং জল-ময়দার মিশ্রণে কঠোর হয়ে মূর্তি বা আদলে রূপান্তরের দৃঢ়তা লাভ করে।
১৬শ থেকে ১৮শ শতকের মধ্যে পাপিয়ের-মাশে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু মানুষের আকৃতির পুতুল বা মাথার খুলি নয়, বাক্স, ট্রে, খেলনা এবং এমনকি আসবাবেও রূপান্তরিত হয়েছিল সে সময়ের দৃঢ় কাগুজে মণ্ড।
'ঔপনিবেশিক যুগে পাপিয়ের-মাশে সম্ভবত প্রথম মেক্সিকোতে আসে", এমন ধারণা মোগিগাঙেস (mogigangas) তৈরীর কারিগর হার্মেস অ্যারোইও এর। যে দানবাকারের বড় বড় পুতুলগুলো মেক্সিকোর সকল ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানে মানুষের মাঝে অবস্থান করে নেয় সেগুলোই এই মোগিগাঙেস।
এমন বৃহদাকার মূর্তি সাধু এবং যীশুর আদলে স্পেন ও ঔপনিবেশিক মেক্সিকোর ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে দেখা যেত বলে অ্যারোইওর এমন ধারণা। আধুনিক মোগিগাঙেস এর কারকরা ১৬ হতে ২০ ফুটের কাছাকাছি পুতুল তৈরী করে থাকেন যার ভেতরে মজার সব পোশাক পরা বর-কনে থেকে, পাগলাটে দৃষ্টির শয়তান, ডে অফ দ্য ডেড উৎসবের অস্থিপাঁজর সবই থাকে!
কাঁধের কাছে সাঁটা কাঠের বর্মটিকে ঘুরিয়ে এবং আবার কখনোবা মুচড়ে পাপেটিয়াররা এগুলোকে সামনে চালিয়ে নেয়। অনেকটা আমাদের দেশের পুতুলনাচ যেভাবে পরিচালনা করা হয় তেমনি।
পিনেটাসে পাপমোচন
রঙিন গোল বল, আর তার চারপাশ থেকে ছড়িয়ে পড়া সাতটি চোখা তারার অগ্রভাগ। স্প্যানিয়ার্ডদের কাছে এগুলো দেখতে আনারসের (স্প্যানিশ ভাষায় pineapples এর প্রতিশব্দ piñas) মত হওয়ায় তারা নাম দেয় পিনেটাস (piñatas) ।
একসময় নৈবেদ্যতে পূর্ণ মাটির হাঁড়ি ভাঙ্গার চর্চা ছিল ইতালি এবং স্পেনে। ষোড়শ শতকে পিনেটাস পৌঁছায় মেক্সিকোতে। মাটির হাঁড়ি গুঁড়িয়ে দিয়ে মানুষের পাপমোচনের যে প্রথা ছিল তাই কিছুটা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের টিস্যু পেপারে মোড়ানো পিনেটাসের মধ্য দিয়ে মেক্সিকোর অনেক জায়গায় এখনো টিকে আছে। ঘর সাজাতে জন্মদিন ও ক্রিসমাসে পিনেটাসের কদর শীর্ষে।
ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, পিনেটাসের সাতটি তারা সাতটি পাপের নির্দেশক। পিনেটাস ভাঙার মধ্য দিয়ে মানুষ নিজেকে অন্যের সেবার উদ্দেশ্যেতে নিয়োজিত করার অঙ্গীকার করে।
২০১৭ সালে মেক্সিকোর ন্যাশনাল হিস্পানিক কালচারাল সেন্টারের অভ্যন্তরীণ যাদুঘরে ১৫০টি পিনেটাসের প্রদর্শন করা হয়। রঙিন পিনেটাসগুলোর মাঝে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও হিলারি ক্লিনটনের প্রতিমূর্তিও ছিল। রাজনীতি, সিনেমা, পপ কালচার যেখানে যা ট্রেন্ডিং পিনেটাসে সবসময় তা ফুটিয়ে তোলার একটা প্রয়াস থাকে।
ডে অফ দ্য ডেড
মেক্সিকোয়ের পাপিয়ার- মাশে (papier-mâché) নির্মাতাদের জন্য সবচেয়ে প্রাণবন্ত এবং ব্যস্ততম সময় হলো প্রতিবছরের অক্টোবর ৩১ থেকে ২রা নভেম্বর পর্যন্ত তিনটা দিন। এ সময়ই উদযাপিত হয় 'Día de los Muertos' বা মৃতদের দিন। অদ্ভুত শোনালেও এ দিনগুলোতে মেক্সিকানরা অত্যন্ত জাঁকজমপূর্ণভাবে তাদের মৃত আত্মীয়দের স্মরণে উৎসবে মেতে ওঠে ।
পূর্বপুরুষ এবং মৃত আত্মীয়স্বজনের ঘরবাড়ি এবং সমাধিক্ষেত্রকে সাজিয়ে তোলা হয় মোমবাতি, কাগজের ব্যানার (প্যাপেল পিকাদো) এবং কাগজের তৈরী কঙ্কাল দিয়ে।
খেলনাকৃতির নয়, একেবারে জলজ্যান্ত ক্যালাকাস (খুলি) ঝুলিয়ে রেখে, কখনোবা মস্তক আকৃতির মুখোশে সোনালী কারুকাজ এঁকে, পাত গলিয়ে বিশেষ এক রুটির সাথে ফলফলাদি জুড়ে দিয়ে প্রতীকি নৈবেদ্য অর্পণ করা হয় মৃতদের উদ্দেশ্যে।
পাঁচ পুরুষ ধরে মেক্সিকোর এ ঐতিহ্য লালন করে আসা শিল্পী (cartoñero) লিওনার্দো লিনারেস ভার্গাস বলেন, "কঙ্কালকেই অজস্র উপায়ে সাজিয়ে প্রদর্শন করতে পারি আমরা"।
ভয়ংকর সুন্দর রূপকথার প্রাণীরা
ঐতিহ্য আর সৃজনশীলতার সন্নিবেশ ঘটিয়ে মৃতের দিন বা ডে অফ দ্য ডেড উৎসবে প্রতিবছরই যুক্ত হচ্ছে অভিনব সব মূর্তি আর কল্পনাশৈলী। গত কয়েক বছরের উৎসবের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে যেমন কাল্পনিক প্রাণিসদৃশ এলব্রাজেস (alebrijes) এর প্রদর্শন। মোটামুটি কম্প্যাক্ট গাড়ির সমান একটি প্রাণীর ভেতরেই মিলতে পারে ঈগলের নখর, প্রজাপতির পাখনা, চিতার পা, আবার খরগোশের কানদুটোও।
রামন এস্পিনোজা নামক এক শিল্পী বলেন, "আমাদের কল্পনা যতদূর প্রসারিত করা যায় ততখানি ভেবেই এলব্রাজেস তৈরী করি আমরা"।
এলব্রাজেস তৈরীর প্রচলন বেশিদিন আগে শুরু হয়নি এবং এরা যে সবসময় যে বৃহদাকার তা নয়। মেক্সিকোর অন্যান্য কাগুজে ভাস্কর্যের (papier-mâché sculptures ) মতই এর ভেতরে সংমিশ্রণ ঘটেছে ঔপনিবেশিক ক্যাথলিকতাবাদ এবং মেক্সিকান সৃজনশীলতার।
লিওনার্দো লিনারেস ভার্গাসের দাদা পেড্রো লিনারেসকে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের চমৎকার এবং কাল্পনিক এসব প্রানীর মুখশ্রী ভাবনার কৃতিত্ব দেওয়া হয়।
"আমি হয়তো একটা পাখির দেহে ধড়টি এনে বসাব সাপের, মাথাটায় জুড়ে দেব ছাগলের শিং, আবার একই প্রাণীর অক্ষিকোটরে দেখা মিলবে ব্যাঙের স্ফীত চোখের"- বংশপরম্পরায় দাদার নিপুণ চিত্রকলার চর্চা করা ভার্গাস এভাবেই নিজের কল্পনার প্রাণীর বর্ণনা দিয়ে যান।
যদি ডে অফ দ্য ডেড উৎসব চলাকালীন সময়ে অথবা মেক্সিকান রাজসিক পার্টিগুলোতে ল্যাটিন আমেরিকার সুন্দর, বিচিত্রতায় ভরা সংস্কৃতির দেশটিতে না যাওয়া হয় তবে কি এসব শিল্পকর্ম দেখার সৌভাগ্য হবে না?
ভ্রমণকারীরা মেক্সিকোর দ্য মিউজিও দে আর্তে পপুলার, দ্য মিউজিও কাসা এস্তুদিও ডিয়েগো রিভেরা প্রভৃতি যাদুঘরে গেলেই বছরের যেকোন সময় এসব কাগুজে ভাস্কর্য, কাঠের মুন্ডু, কারুকাজ করা মুখোশ, কদাকার কাল্পনিক প্রাণী প্রভৃতির দেখা পাবেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান্তা ফে'জ মিউজিয়াম অফ ইন্টারন্যাশনাল ফোক আর্টের গ্যালারিতেও মেক্সিকান এসব মুখোশ, এলব্রাজেস এবং একেবারে রক্ত হিম করা কঙ্কালের খুলি প্রদর্শিত হয়ে থাকে। জীবনে একবার হলেও এসব বিচিত্রতার স্বাদ নিতে ভুলবেন না যেন।
সূত্রঃ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক