সোশ্যাল মিডিয়া থেকে বিরতি নিলে মস্তিষ্কে যেসব পরিবর্তন ঘটে
আপনি কি ফোনে স্ক্রল করতে গিয়ে খুব বেশি সময় ব্যয় করে ফেলছেন? তাহলে আপনি একা নন। একজন প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান প্রতিদিন গড়ে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যয় করেন। আর একজন কিশোর শুধু টিকটক ও ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মেই এর দ্বিগুণ সময় ব্যয় করছে।
বিশেষজ্ঞরা এ সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির বিষয়ে সতর্ক করেছেন এবং এ অভ্যাস থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছেন। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে গুগলে 'সোশ্যাল মিডিয়া ডিটক্স' বিষয়ে অনুসন্ধানের হার ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এ সংখ্যাই প্রমাণ করে মানুষও এ থেকে মুক্তি পেতে চাইছে।
কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকা কি সত্যিই কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করে? গবেষকরা এর উত্তর দিয়েছেন, হ্যাঁ। তারা বলেন, "সোশ্যাল মিডিয়া থেকে বিরত থাকলে মস্তিষ্ক এবং মানসিক স্বাস্থ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা আপনাকে চমকে দিতে পারে।
মস্তিষ্কে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব
আমরা অনেকেই মনে করি যে আমরা ফোনে স্ক্রল করতে অনেক বেশি সময় ব্যয় করছি। আর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের ২০২৪ সালের সবচেয়ে আলোচিত শব্দ 'ব্রেইন রট' এই উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে এ অভ্যাস থেকে মুক্তি লাভের উপায় খুঁজে পাওয়া সহজ কাজ নয়, কারণ সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের মস্তিষ্কের পুরস্কার ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়েই তৈরি করা হয়েছে।
অ্যাডিকশন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ডোপামিন ন্যাশন: ফাইন্ডিং ব্যালেন্স ইন দ্য এইজ অব ইন্ডালজেন্স বইটির লেখক অ্যানা লেম্বকি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, "মানুষ যেভাবে মাদক বা অ্যালকোহলে আসক্ত হয় ঠিক সেভাবে ডিজিটাল মিডিয়ায় আসক্ত হয়ে পড়তে পারে। আমরা জানি মাদক এবং অ্যালকোহল মস্তিষ্কে যেভাবে প্রভাব ফেলে, ঠিক তেমনই সোশ্যাল মিডিয়া চেক করার সময় একই প্রক্রিয়া ঘটে। প্রতিটি লাইক, কমেন্ট বা আকর্ষণীয় বিড়ালের ভিডিও মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক 'ভালো লাগার' রাসায়নিকের স্রোত তৈরি করে।
তবে আমাদের মস্তিষ্ক একটি সামগ্রিক ডোপামিন ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য তৈরি যা লেম্বকি 'টিটার-টটার' প্রক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অবিরাম স্ক্রল করার ফলে এই ভারসাম্য ব্যাহত হয়, যার ফলে মস্তিষ্ক ডোপামিন উৎপাদন কমিয়ে দেয় বা এর প্রবাহ ধীর করে। ধীরে ধীরে এটি আমাদেরকে একটি 'ডোপামিন ঘাটতি'র দিকে ঠেলে দেয়, এর ফলে স্বাভাবিক অনুভূতিতে ফিরে আসার জন্য আমাদের আরও বেশি সময় অনলাইনে কাটানোর প্রয়োজন হয়।
লেম্বকে বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় 'বিরতি' দেওয়ার মাধ্যমে এ ডোপামিন চক্রকে পুনরায় আগের অবস্থায় আসার সুযোগ দেয়। এর মাধ্যমে আমরা সেই বাধ্যতামূলক অতিরিক্ত ব্যবহারের অভ্যাস থেকে মুক্ত হতে পারি। আর এটি আমাদের মস্তিষ্ক 'ব্রেইন রট' হওয়া থেকে মুক্ত হতে পারে।
৩১ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর দুই সপ্তাহ সোশ্যাল মিডিয়া ডিটস্কের স্বাস্থ্যগত প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেন পেইজ কয়েন। তিনি বলেন, "সোশ্যাল মিডিয়া ডিটক্সের ক্ষেত্রে একক কোনো সমাধান নেই। তবে অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের অর্থ মানুষ ভেদে ভিন্ন হতে পারে।"
কয়েন আরও বলেন, "মূল বিষয় হলো, আমাদের নিয়মিত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের পরিমাণ কমানোর জন্য বাস্তবসম্মত লক্ষ্য স্থির করা। কেউ হয়ত এটি সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দিতে চাইবেন, আবার কেউ তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটানো সময় অর্ধেকে নামিয়ে আনতে চাইবেন।"
লেম্বকের মতে, মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড পাথওয়েগুলো পুনরায় সাজাতে যতটা সম্ভব বেশি সময় বা কমপক্ষে চার সপ্তাহ সোশ্যাল মিডিয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন। তবে স্বল্প সময়ের বিরতিও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে বলে জানান তিনি।
১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৬৫ জন মেয়ের উপর চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র তিন দিনের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া থেকে বিরত থাকায় তাদের আত্মসম্মান ও আত্ম-সহানুভূতি বেড়েছে এবং শরীর নিয়ে লজ্জাবোধ কমেছে।
সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকার মানসিক চাপ সামলাবেন যেভাবে
আপনি কয়েক সপ্তাহের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার বন্ধ করে দেন অথবা প্রতিদিনের ব্যবহারের সময় কমিয়ে আনুন। প্রথম কয়েকদিন আপনার জন্য সবচেয়ে কঠিন হতে পারে বলে জানিয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়া ডিটক্স নিয়ে গবেষণার সহলেখক সারাহ উডরফ।
লেম্বকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন বলেন, "মস্তিষ্ক কম ডোপামিনের মাত্রার সঙ্গে মানিয়ে নিতে মস্তিষ্কে 'উইথড্রয়াল সিম্পটম' যেমন তীব্র আকাঙ্ক্ষা বা উদ্বেগের প্রবণতা বাড়িয়ে দিকে পারে। তবে এই অস্বস্তিকর অনুভূতিগুলো সহ্য করলে মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড পাথওয়েগুলো পুনর্গঠিত হতে পারে এবং আকাঙ্ক্ষা-ভিত্তিক ব্যবহারের চক্র বন্ধ হয়ে যাবে।"
উডরফ বলেন, "যত দিন পার হতে থাকে, মানুষ ডিটক্সকে তাদের কল্পনার চেয়ে সহজ বলে মনে করেছে। একবার অভ্যাসে পরিণত হলে বেশিরভাগ মানুষ এটি উপভোগ করেছে।"
দুই সপ্তাহের সোশ্যাল মিডিয়া ডিটক্স শেষে, যেখানে ব্যবহার দৈনিক ৩০ মিনিটে সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল, অধিকাংশ অংশগ্রহণকারী মানসিক স্বাস্থ্যে উল্লেখযোগ্য উন্নতির কথা জানিয়েছেন। তাদের জীবনে সন্তুষ্টি বেড়েছে, মানসিক চাপ কমেছে এবং ঘুমের মান উন্নত হয়েছে, যা গবেষণার আগের সময়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্য।
এই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করা সহজ হতে পারে যদি আপনি একজন বা একাধিক ডিটক্স সঙ্গীর সঙ্গে যুক্ত হন। কিশোরী মেয়েদের উপর পরিচালিত এক গবেষণায়, কলোরাডো কলেজের মনোবিজ্ঞান অধ্যাপক টমি-অ্যান রবার্টস অংশগ্রহণকারীদের প্রতিদিন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
রবার্টস বলেন, "আমরা দেখেছি, মেয়েরা বিচ্ছিন্নতা এবং কিছু মিস করার ভয়ের মতো অনুভূতির সম্মুখীন হয়েছে। তবে তারা তাদের অভিজ্ঞতা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পেরেছে, ফলে তারা কম একাকিত্ব অনুভব করেছে।"
সোশ্যাল মিডিয়া থেকে অস্থায়ী বিরতি নেওয়া কেবল আমাদের মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড পাথওয়েগুলোকে পুনরায় সাজিয়ে তোলে না, এটি আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েও সচেতন করে তোলে। গবেষক সারা উডরফ বলেন, "এই সময়ে আমরা পেছনে ফিরে তাকিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারি যে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা আসলে কী করি এবং এটি আমাদের জন্য কতটা উপকারী।"
তিনি আরও বলেন, "যেমন, আমি কি দিনের সব প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করতে পারি, নাকি সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে সরাসরি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ হারাচ্ছি? এ ধরনের সচেতনতা আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ধরন পরিবর্তন করতে সহায়তা করতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে আরও ভারসাম্যপূর্ণ ও ফলপ্রসূ হতে পারে "
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে ভারসাম্য বজায় রাখা
ডিটক্সের সময়কাল শেষ হওয়ার পর, সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার থেকে পরিত্রাণ পেতে নির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে চলা জরুরি, বলে জানালেন আন্না লেম্বকে। তিনি পরামর্শ দেন, "আমাদের এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্যে শারীরিক বা মানসিক বাধা তৈরি করা উচিত। যেমন ফোনকে শোবার ঘরে না রাখা বা নোটিফিকেশন বন্ধ রাখা।"
তাড়াতাড়ি আনন্দ পাওয়ার বদলে ধীর গতিতে আনন্দদায়ক অভ্যাস গড়ে তোলা মস্তিষ্কের পুরস্কার-পথগুলো ভারসাম্যপূর্ণ রাখতে সাহায্য করতে পারে বলে পরামর্শ দেন লেম্বকে। তিনি বলেন, "স্বাস্থ্যকর ডোপামিনের উৎসগুলোর খোঁজ পেতে কিছুটা পরিশ্রম করতে হবে।"
তিনি উদাহরণ হিসেবে বাদ্যযন্ত্র বাজানো বা রান্না করার পরামর্শ দেন। তার মতে যেসব কাজে বেশি মনোযোগ প্রয়োজন সেগুলোতে লেগে থাকলে মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে ডোপামিন নিঃসরণ করে এবং এতে ডোপামিনের সামগ্রিক ভারসাম্য বজায় থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বছরের মধ্যে নির্দিষ্ট সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ডিটক্স করার পরিকল্পনা করার পরামর্শ দিয়েছেন। সারাহ উডরাফ বলেন, "আমরা পুরোপুরি সোশ্যাল মিডিয়া ত্যাগ করতে পারি না, তবে মাঝে মাঝে বিরতি নেওয়া আমাদের এই প্ল্যাটফর্মগুলো কীভাবে ব্যবহার করছি এবং সেগুলো আমাদের কীভাবে প্রভাবিত করছে তা পুনর্মূল্যায়ন করতে সাহায্য করে।"