নতুন বই হাতে পেতে অপেক্ষা, এনসিটিবি’র ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহের পরামর্শ
পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর অভাবে ২০১০ সালের পর এবারই বছরের প্রথম দিন সবগুলো বই হাতে পায়নি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৭টি শ্রেণির শিক্ষার্থীরা।
প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বই ছাপানো শেষ হলেও সব স্কুলে তা পোঁছায়নি। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ওয়েবসাইটে আপলোডকৃত নতুন বইয়ের অনলাইন ভার্সন সংগ্রহের পরামর্শ দিয়েছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড জানিয়েছে— রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের কারণে পুনরায় নতুন বই ছাপানোর কার্যক্রম, কারিকুলাম পরিবর্তন ও পাঠ্যপুস্কক পরিমার্জনের কারণে বই ছাপানো শেষ হয়নি।
এদিকে, শিক্ষার্থীদের হাতে বই না থাকলেও শ্রেণি কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক (মূল প্রভাতি) মুসতারী সুলতানা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা আসলে বই উৎসবের কোনো নোটিশ না পেলেও ঘরোয়াভাবে চেষ্টা করেছি। আমরা ক্লাস এইট, নাইন ও টেন এর বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই দিতে পেরেছি।"
বই না পাওয়ায় শিক্ষা কার্যক্রমে অসুবিধা হবে কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "আমরা আশা করছি, ৩০ জানুয়ারির মধ্যে সব বই না পেলেও সমস্যা হবে না। কারণ জানুয়ারি মাসে সাধারণত এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস চর্চা হয় বেশি। ফেব্রুয়ারি থেকে পুরোদমে ক্লাস শুরু হয়।"
"আমরা ইতোমধ্যে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ও অভিভাবকদের বইগুলো অনলাইনে কালেক্ট করতে বলেছি। এছাড়াও, গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর প্রথম চ্যাপ্টার প্রিন্ট করে, অথবা পুরাতন বই সংগ্রহ করার পরামর্শ দিয়েছি," যোগ করেন তিনি।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান গণমাধ্যমকে বলেছেন, "এটা সত্য যে, মাধ্যমিকের বই দিতে আমাদের দেরি হবে। নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর আগেই এনসিটিবির ওয়েবসাইটে সব বইয়ের পিডিএফ আপলোড করা হবে। কেউ চাইলে সেখান থেকেও সহযোগিতা নিতে পারবেন।"
অধ্যাপক রিয়াজুল হাসান বলেন, "এখন সবার বাড়িতে কম্পিউটার, মোবাইল, ইন্টারনেট রয়েছে। বই পেতে যাদের কিছুটা দেরি হবে, তারা অনলাইন থেকে পিডিএফ ফাইল ডাউনলোড করে প্রাথমিকভাবে পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারবেন। প্রয়োজনে প্রথম দু-তিনটি অধ্যায় প্রিন্ট করেও পড়তে পারবে তারা। শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।"
তিনি আরো বলেন, "যে কারিকুলামটা বিদ্যমান ছিল ২০২৪ এর জন্য, সেটাতে না গিয়ে ২০২৫ সালের জন্য ২০১২ সালের কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক প্রণীত হচ্ছে, যেটা ২০২২ সালে সর্বশেষ গিয়েছিলে।"
স্কুলে পাঠ্যবই বিতরণের প্রথম দিন
বছরের প্রথমদিনে বই ছাড়াই স্কুল থেকে ফিরে গেছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী।
বিভিন্ন স্কুলে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বই বিতরণ হলেও রাজধানীসহ দেশের বেশকিছু স্কুলে সেটিও বিতরণ হয়নি।
ইস্পাহানি বালিকা বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া রূপা জানায়, "আমাদের তিনটি বই দিয়েছে। বাংলা, ইংরেজি এবং অংক। সায়েন্স, আর্টসের কোনো বই এখনও পাইনি।"
এছাড়া, অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীরা জানায়, তারা ইংরেজি, গণিত ও ইসলাম শিক্ষা বই পেয়েছে।
দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী সাবিনা আক্তার বলে, "আমি কোনো নতুন বই পাইনি। স্যারেরা বলেছে কয়েকদিনের মধ্যেই বই দেবে। আজকে বই না নিয়েই যাচ্ছি আমরা।"
পাঠ্যপুস্তকের পরিমার্জন
পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ে মেজর জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সব বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে শেখ হাসিনার ছবি ও ব্যাক কাভারে শেখ হাসিনার উক্তি বাদ দেওয়া হয়েছে।
এর আগে, এনসিটিবির চেয়ারম্যান রিয়াজুল হাসান বলেন, "কয়েকটি শ্রেণির নতুন বইয়ে জুলাই আন্দোলনের শহীদদের স্মরণ ও গ্রাফিতি যুক্ত করা হয়েছে।"
এনসিটিবি সূত্রে ও অনলাইন বই ভিজিট করে জানা গেছে, পঞ্চম শ্রেণির আমার বাংলা বইয়ে ছয়টি প্রবন্ধ, কবিতা বা ছড়া নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে 'আমরা তোমাদের ভুলব না' শীর্ষক একটি প্রবন্ধ জুলাই বিপ্লবের ওপর লেখা। বাকি পাঁচটি প্রবন্ধ বা কবিতা হলো— 'সবার আমি ছাত্র', 'জলপরী ও কাঠুরের গল্প', 'নোলক', 'কুমড়ো ও পাখির কথা' এবং 'দৈত্য ও জেলে'।
এই বই থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে সাতটি গল্প ও কবিতা। এগুলো হলো— 'ফেব্রুয়ারির গান', 'মাটির নিচে যে শহর', 'দেখে এলাম নায়াগ্রা', 'রৌদ্র রেখে জয়', 'মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী', 'শহিদ তিতুমীর' এবং 'অপেক্ষা'। এছাড়া এই বইয়ের 'স্মরণীয় যাঁরা চিরদিন' গল্পের শিরোনাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে 'স্মরণীয় যাঁরা বরণীয় যাঁরা'।
ষষ্ঠ শ্রেণির চারুপাঠ বইয়ে দুটি গদ্য যুক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে 'কার্টুন ব্যঙ্গচিত্র ও পোস্টারের ভাষা' নামে জুলাই বিপ্লবের ওপর লেখা একটি গদ্য রয়েছে। এছাড়া কামরুল হাসানের লেখা 'আমাদের লোকশিল্প' গদ্যটি নতুন করে যুক্ত করা হচ্ছে। আর বাদ দেওয়া হয়েছে সৈয়দ শামসুল হকের লেখা 'কত দিকে কত কারিগর' গদ্যটি।
সংযোজন–বিয়োজনের ফলে এখন এই বইয়ে গদ্যের মোট সংখ্যা হচ্ছে ৯টি। পুরোনো বইয়ে তা ছিল ৮টি।
একই পাঠ্যবই থেকে একটি কবিতা বাদ দিয়ে আরেকটি কবিতা যুক্ত করা হচ্ছে। বাদ দেওয়া হয়েছে রোকনুজ্জামান খানের লেখা 'মুজিব' কবিতাটি। তবে একই লেখকের 'চিঠি বিলি' নামে একটি কবিতা যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ফলে এই বইয়ে কবিতার মোট সংখ্যা আগের মতো ৯টিই থাকছে।
একই শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি বই থেকে 'জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান' প্রবন্ধটি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সপ্তম শ্রেণির 'সপ্তবর্ণা' বই থেকে সেলিনা হোসেনের লেখা 'রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন' গদ্যটি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই বইয়ে হাসান রোবায়েতের লেখা 'সিঁথি' নামে একটি কবিতা যুক্ত করেছে। এই কবিতা জুলাই বিপ্লবের ওপর লেখা।
অন্যদিকে, গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখা 'শোনো একটি মুজিবরের থেকে' এবং সুনির্মল বসুর লেখা 'সবার আমি ছাত্র' নামে দুটি কবিতা বাদ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া সপ্তম শ্রেণির আনন্দ পাঠ বইয়ে সেলিনা হোসেনের লেখা ভ্রমণকাহিনি 'সুইজারল্যান্ডের দিনগুলি' বাদ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, অষ্টম শ্রেণির সাহিত্য কণিকা বইয়ে দুটি গদ্য যুক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো মোতাহের হোসেন চৌধুরীর 'লাইব্রেরি' এবং জুলাই বিপ্লবের ওপর লেখা সংকলিত গদ্য 'গণ অভ্যুত্থানের কথা'। একই বই থেকে কামরুল হাসানের 'আমাদের লোকশিল্প' গদ্যটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন এই বইয়ে মোট গদ্যের সংখ্যা দাঁড়াল ১২টি; আগে ছিল ১১টি।
একই শ্রেণির আনন্দ পাঠ বই থেকে মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা 'আমড়া ও ক্র্যাব নেবুলা' উপন্যাসটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, ষষ্ঠ শ্রেণির ইংলিশ ফর টুডে বই থেকে 'সন অব দ্য সয়েল' এবং 'মুজিব ইন স্কুল ডেজ'সহ তিনটি লেসন বাদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া 'আওয়ার প্রাইড'সহ দুটি লেসন যুক্ত করা হয়েছে।
সপ্তম শ্রেণির ইংলিশ ফর টুডে বইয়ে জুলাই বিপ্লবের ওপর লেখা 'আ নিউ জেনারেশন' এবং 'আওয়ার উইনার ইন দ্য গ্লোবাল এরেনা' নামে দুটি নতুন লেসন যুক্ত করা হয়েছে।
অন্যদিকে, 'বঙ্গমাতা: আওয়ার সোর্স অব ইন্সপিরেশন', 'বঙ্গবন্ধু'স লাভ ফর স্পোর্টস' এবং 'বঙ্গবন্ধু'স রেসপন্স টু ন্যাচারাল ক্যালামিটিস' নামে তিনটি লেসন বাদ দেওয়া হয়েছে।
অষ্টম শ্রেণির ইংলিশ ফর টুডে বই থেকে 'বঙ্গবন্ধু অ্যান্ড বাংলাদেশ' নামে একটি লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে। আর দুটি লেখা নতুন করে যুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে একটি হলো জুলাই বিপ্লবের ওপর লেখা 'উইমেন'স রোলস ইন আপরাইজিং'। আরেকটি হলো 'হিউম্যানস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট'।