মাছের কাঁটার দাম, চাহিদা দুটোই বেড়েছে
'আমি ইটা ভাইঙ্গা খাই, বাবা। গরীব মানুষ।' বললেন ফিরোজা বেগম। প্রশ্ন করেছিলাম, মাছ রেখে মাছের কাঁটা কিনছেন কেন, খালা? তাতেই এ উত্তর।
খবর ছিল, রাজধানীর অন্যতম বড় মাছের আড়ৎ যাত্রাবাড়ীতে বিক্রি হয় মাছের কাঁটা, আর নিম্ন আয়ের অনেকেই না-কি এসব কেনেন রীতিমতো ভীড় করে! বানানো ঘটনা নয়তো? প্রশ্ন ছিল অনেক, নানান সংশয়ও ছিল মনে।
নিজের চোখে দেখব বলে একদিন খুব ভোরে তাই পৌঁছে গেলাম ঢাকার অন্যতম বড় এ মাছের আড়তে। যাত্রাবাড়ীতে মাছের বাজার শুরু হয় ভোরের আলো ফোটার আগে। সকাল থেকেই ক্রেতা-বিক্রেতাদের আনাগোনায় মুখরিত থাকে এ বাজার।
কিন্তু কোথাও দেখা গেল না মাছের কাঁটা বিক্রির দৃশ্য। এর বদলে বড় বড় সব মাছের লাফানোর দৃশ্যই নজর কাড়ল বেশি। একপাশে তাজা তাজা রুই-কাতল, তো অন্যপাশে ভোরের আলোয় চিকচিক করা ইলিশ!
এসব দেখে দেখেই ঘণ্টা দুয়েক পার। তারপর হঠাৎ অবতারণা সেই কাঙ্ক্ষিত দৃশ্যের!
ঘড়িতে ঘণ্টার কাঁটা তখন নয়টার আশেপাশে। বড় একটি ঝুড়ি মাথায় নিয়ে রাস্তার পাশে এসে থামলেন মোহাম্মাদ সুলতান বেপারি। ঝুড়ি নামাতেই বোঝা গেল, তার জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন অনেক!
মাছের কাঁটাভর্তি ঝুড়িটা যেখানে রাখলেন তিনি, তার পাশেই বড় বড় পাত্রে লাফাচ্ছিল তাজা তাজা পাঙ্গাশ মাছ। তবুও ভিড় জমে গেল চারপাশে। শুরু হলো দরদাম, বেচাকেনা! আধাঘণ্টা যেতেই অর্ধেক শেষ।
বেশিরভাগ ক্রেতাই নিম্ন আয়ের মানুষ। অল্প কিছু ডাল অথবা শাকের সঙ্গে এ কাঁটা, সঙ্গে একটু নুন আর ভাত মিশে গেলে সেটাই হয়ে যায় অনেকের দুপুর কিংবা রাতের আহার!
এ যেমন ফিরোজা বেগম। সাইনবোর্ড এলাকায় ইট ভাঙ্গার কাজ করেন তিনি। সারাদিন কাজ করলে ৫০০ টাকা পান বটে, কিন্তু কাজ মেলে না সবদিন।
অনেক সময় দিনরাত এক করে কাজ করলেও টাকা দেয় না মালিক। ফলে বড় মাছ কেনার কথা ভাবতে পারেন না তিনি। জানালেন, ২৬০ টাকায় মাথাসহ পাঙ্গাশ মাছের কাঁটা কিনেছেন তিনি। দীর্ঘক্ষণ দামদর করে কিনে নিয়েছেন আট পিস কাঁটা। তাতে কিছুটা কমেই পেয়েছেন!
সংগ্রামী এ প্রৌঢ়া জানালেন, একটি মাথাসহ কাঁটা আলু দিয়ে ভুনা করলে কিংবা ডালের সঙ্গে রাঁধলে অনায়াসে হয়ে যায় তার দুবেলার আহার। ফিরোজা বেগমের মতো গল্প আরও অনেক নিম্ন আয়ের মানুষের।
এখান থেকে কিনে নেওয়া কাঁটাতেই আমিষের চাহিদা মেটে তাদের। তারা মাছের স্বাদ মেটান মাছের মাথা আর কাঁটার সঙ্গে লেগে থাকা সামান্য অংশটি দিয়ে!
মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ আড়তের পাশেই একটি দোকানের কর্মচারী। তিনি জানালেন, শুধু নিম্নবিত্ত নয়, অনেক মধ্যবিত্তও এখান থেকে কাঁটা কেনেন।
দেখাও গেল তা-ই। যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা ছত্তার খাঁ দুটি পাঙ্গাশ মাছ কিনেছিলেন আড়ৎ থেকে। যাওয়ার পথে ১২০ টাকার কাঁটাও কিনে নিলেন।
জিজ্ঞেস করাতে বললেন, 'দুইটা মাছ কিনছি। পোলাপানে মাথা খাইতে চায়। মাথা কিনলাম তিনটা। শাকপাতা দিয়ে ভাজি করলে খাইতে মজা। এগুলা কিন্তু খারাপ না, চাইনিজরা মাছ নিয়া যায়, মাথা এ জায়গায় আসে।'
কথা হলো বিক্রেতা মোহাম্মাদ সুলতান বেপারির সঙ্গে। জানালেন, রাজধানীর কাপ্তান বাজার থেকে এগুলো আনেন তিনি।
মন বা কেজি দরে নয়, তিনিও আনেন পিস হিসেবে। আকার ভেদে প্রতি পিস মাথা সহ কাঁটা বিক্রি করেন ৫০ টাকা, আকারে ছোট হলে দাম নেমে আসে ৪০ টাকায়। অবশ্য বেশি করে নিলে দাম আরও কিছুটা কমানো যায়।
গেল বছর ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ির মাছের বাজার ঘুরে দেখা যায়, সেখানে কাঁটাসহ মাছের মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত সম্পূর্ণ অংশ প্রতিটি ২০–৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসা কেমন চলছে জিজ্ঞেস করাতে সুলতান বেপারি বললেন, 'মানুষের চাহিদা আছে ভালো। তবে এহেক সময় এহেক রকম। সব দিন মাল পাই না। অর্ডার বুইজ্জা। কোনদিন ৪০টা আহে, কোনদিন ২০০ আহে। মাছ বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে বিক্রি হইয়া যায় আগেই। তারপর কাঁটা আমরা আনি।'
অবশ্য স্বীকার করলেন, জনসাধারণের কাছে যদিও বলা হয় চাইনিজ রেস্টুরেন্টগুলো থেকে আসে এ কাঁটা — সেখানে মাছ রেখে বাকিটুকু পাঠিয়ে দেওয়া হয় কাপ্তান বাজারে — আদতে দেশীয় বিভিন্ন হোটেলের জন্য নেওয়া মাছের কাঁটাই এখানে আসে। চাইনিজ বললে লোকে আশ্বস্ত হয় বলেই এমনটা বলেন তারা!
তবে এ ব্যবসা নতুন কিছু নয় বলে জানালেন আড়ৎ সংশ্লিষ্ট লোকজন। সুলতান বেপারি এ ব্যবসা করছেন প্রায় সাড়ে তিন বছর যাবত।
বললেন, সরকার পরিবর্তনের পর হঠাৎ করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে, এমনটি নয়। তিন বছর আগেও তিনি কাঁটা বিক্রি করেছেন, আজও করছেন।
'মানুষ আসলে মাছ কিনতে পারে না। মাছ কিনতে পারলে কেউ কি কাঁটা কিনে?' মন্তব্য করলেন সুলতান।
তার কথা শুনে হঠাৎই চোখ পড়ল মাছের কাঁটা কিনতে থাকা ক্রেতাদের মুখের দিকে। সে মুখে অসহায়ত্বের ছাপ স্পষ্ট। চারদিকে এত এত মাছ, অথচ তাদের কিনতে হচ্ছে কাঁটা! এর চেয়ে অসহায় মানুষ কখনো হয় কি?
ছবি: জুনায়েত রাসেল/টিবিএস