আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনার মডেল হয়ে উঠছে রংপুরের নাগদাহ গ্রাম
ছোট্ট পাকা ঘরের মেঝেতে বেগুন বাছাই করছিলেন কৃষক শামসুজ্জামান। ঘরটি রংপুরের পীরগাছা উপজেলার নাগদাহ গ্রামের মানুষের কাছে 'ফার্মার্স হাব' নামে পরিচিত।
গ্রামের কৃষকরা উৎপাদিত সবজি এখানে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করেন। শামছুজ্জামান সেগুলো বিক্রি করেন বড় হাটে পাইকারদের কাছে। এরপর তা চলে যায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
ঘরটির পাশেই রয়েছে সবজির নার্সারি। নেট দিয়ে ঘেরা লম্বা শেডে মরিচ, পেঁপে, বেগুনসহ বিভিন্ন সবজি চারা পাওয়া যায়। ফসল সংগ্রহ এবং বেচা-কেনা ছাড়াও ফার্মার্স হাব থেকে বীজ, মাটিবিহীন চারা, কৃষি যন্ত্রপাতি ভাড়া ও বিক্রয় এবং কৃষি পরামর্শ পেয়ে থাকেন কৃষকরা।
গ্রামের গ্রামের কৃষক মঈনুল ইসলাম বলেন, "ফার্মার্স হাবের কারণে উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনা সহজ হয়েছে। আলাদাভাবে প্রতিদিন সবজি বিক্রির জন্য তাদের বাজারে যেতে হয়না। এখানে ভালো দাম পাওয়ার পাশাপাশি সময় এবং শ্রম দুটোই সাশ্রয় হচ্ছে। এছাড়া, কৃষি যন্ত্র ও উপকরণ স্বল্পমূল্যে এখানে পাওয়া যায়। ফলে উৎপাদন খরচ কমার পাশাপাশি তাদের পণ্যের উৎপাদনশীলতা এবং আয় বাড়ছে।"
শুধু ফার্মার্স হাবই নয়, ক্রপিং ইনস্যুরেন্স, সমন্বিত উৎপাদন ব্যবস্থা, ন্যাচারাল স্টোরেজ, সুষম সার ও কীটনাশক প্রদানসহ বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্য দিয়ে নাগদাহ হয়ে উঠছে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনার রোল মডেল। গ্রামটির প্রায় ৪৫৫ জন কৃষক এ উদ্যোগের মাধ্যমে মডেল ভিলেজের সাথে যুক্ত হয়েছেন।
স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকের সহায়তায় 'ফার্মিং স্মার্ট মডেল ভিলেজ' প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে 'সাস্টেনেবল অ্যাগ্রিকালচার ফাউন্ডেশন (এসএএফ)। নাগদাহর পাশাপাশি রংপুর সদর উপজেলার ধনতলায়ও মডেল ভিলেজ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে।
আলুর জন্য শস্যবীমা
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বোরো মৌসুমে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ফসলগুলোর একটি হলো আলু। টানা শৈত্যপ্রবাহ ও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকা, তাপমাত্রা নেমে যাওয়া ও বৃষ্টির কারণে লেটব্লাইট রোগে আক্রান্ত হয় আলু। এতে উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়। মডেল ভিলেজের অধীন কৃষকদের আলু চাষে শস্যবীমা চালু করেছে এসএএফ।
নাগদাহ গ্রামের প্রায় ২০০ কৃষক শস্যবীমা নিয়ে এবার আলু চাষ করেছেন। কৃষকরা জানান, এ বীমার আওতায় প্রতিবিঘা (৩৩ শতাংশ) জমির জন্য প্রিমিয়াম হিসেবে ১,১৫৫ টাকা জমা দিতে হবে। আলু ক্ষতিগ্রস্ত হলে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত শস্যবীমা পাবেন তারা। তবে টানা ৪ দিন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নামলে ১০-১৫ শতাংশ হারে এ বীমা তারা পাবেন।
এই গ্রামের কৃষক আলম মিয়া টিবিএসকে বলেন, "আমি ২ একরে আলুচাষ করেছি। এরমধ্যে বীমার আওতায় ১০ শতক। আমাদের এদিকে শীতে ৭-৮ ডিগ্রিতে তাপমাত্রা নেমে যায়। এতে প্রতিবছরই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হই। এ কারণে শস্যবীমার প্রতি আগ্রহী হয়েছি। এটা আমাদের কাছে নতুন। এ কারণে এবার পরীক্ষামূলকভাবে দেখছি।"
এসএএফ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ জামিল টিবিএসকে বলেন, "ফসলের ইন্সুরেন্স নিয়ে আমরা ২০১৬ সাল থেকে কাজ করছি। ২২টি জেলায় আমাদের এ কার্যক্রম রয়েছে। অনেকেই সাড়া দিচ্ছেন। কৃষককে নিরাপত্তা দেওয়ার স্বার্থে আমাদের এ উদ্যোগ।"
তিনি আরও বলেন, "ক্লাইমেট ভালনারেবল হওয়ার কারণে আমাদের দেশে কৃষকরা চাষ করতে গিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। একবার ফসল নষ্ট হলে তারা নি:স্ব হয়ে যান। এটা বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। আমাদের দেশেও জনপ্রিয় হচ্ছে।"
সুষম সার প্রয়োগের জন্য করা হয়েছে মাটি পরীক্ষা
এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে, সয়েল রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) সহায়তায় তারা গ্রামের কৃষকদের চাষের জমির মাটির স্যাম্পল পরীক্ষা করেছেন।
এসএএফের কর্মকর্তারা জানান, অধিক ফলনের আশায় জমিতে কৃষকরা অতিরিক্ত সার প্রয়োগ করে থাকেন। কিন্তু এতে জমির উর্বরতা আরও নষ্ট হয়। বাড়তি সার পরিবেশে মিশে জীববৈচিত্র্য নষ্ট করে ফেলে। এ কারণে জমির উর্বরতা ঠিক রাখতে সারের সুষম ব্যবহারের জন্য সবার মাটি পরীক্ষা করা হয়েছে।
এতে কৃষকরা পরিমাণ অনুযায়ী জমিতে সার দিতে পারবেন। কীটনাশকের ক্ষেত্রেও তাদের নির্ধারিত পরামর্শ রয়েছে। এতে কৃষকরা নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করতে পারবেন বলে জানান তারা।
আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ
গ্রামটিতে একটি সয়েললেস কোয়ালিটি সিডলিং অ্যান্ড স্যাপলিং নার্সারিস বা মাটিহীন উন্নমানের চারার নার্সারি তৈরি করা হয়েছে। কৃষকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে সিডলিং ট্রান্সপ্লান্টার; এতে সময় এবং খরচ সাশ্রয় হয়।
এছাড়াও চার-চাকার ট্রাক্টর, মিনি টিলার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ও রাইস সিডলিং ট্রে এবং কম্বাইন্ড হারভেস্টার বিনামূল্যে বা ভর্তূকি মূল্যে কৃষকদের দেওয়া হয়েছে।
এসএএফ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ জামিল আরও বলেন, "মূলত স্মার্ট এগ্রিকালচারের উপর ভিত্তি করে আমাদের এ মডেলটা সাজানো হয়েছে। কৃষি উপকরণ, উৎপাদন ও বিপণন সব পর্যায়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকদের খরচ কমানোর উদ্দেশ্যেই এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।"
"কৃষক হাই কোয়ালিটি বীজ সুলভমূল্যে পাচ্ছে। ছোট কৃষক হওয়ায় প্রত্যন্ত গ্রামে আধুনিক যন্ত্রের এক্সেস কম থাকে। আমরা কম খরচে কীভাবে এসব যন্ত্র সবাই ব্যবহার করতে পারে তার একটা মডেল দাঁড় করিয়েছি। এরপর সোলার বেজড ইরিগেশন এবং উৎপাদন পরবর্তী পর্যায়ে ফার্মার্স হাবের কারণে কৃষকের সময় এবং অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে। অর্থাৎ, সব পর্যায়ে কৃষক যেন উৎপাদন খরচ কমিয়ে এনে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করতে পারে, তার জন্যই আমাদের এ মডেল। এটা বাস্তবায়ন হলে সারাদেশে অনুসরণীয় হবে," যোগ করেন তিনি।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স, ব্র্যান্ড ও মার্কেটিং-এর কান্ট্রি হেড বিটোপি দাস চৌধুরী বলেন, "মডেল ভিলেজের আওতায় উন্নত জাতের বীজ ব্যবহার করে কীভাবে ভালো ফলন হবে– সে বিষয়ে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। একইসাথে সার, ভার্মি কমপোস্ট এসব বিষয়ে আমরা তাদেরকে সাহায্য করছি। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই আমরা এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছি।"