জিজ্ঞাসাবাদে যা বললেন ‘ক্যাসিনো’ খালেদ
“চিফ ইঞ্জিনিয়ারের সাথে খাতির আছে। যে টাকা বেশি দিতে পারে আর কি... সে-ই কাজ পায়। আমি টাকা দিয়ে কাজ নিছি। এই যেমন একটা কাজের জন্য প্রধান প্রকৌশলীকে দিলাম ১৯ কোটি টাকা।” অবৈধ উপায়ে টাকা উপার্জনের এমন বর্ণনাই দিয়েছেন ঢাকার ফকিরাপুলে একটা ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে বুধবার গ্রেপ্তার হওয়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া।
গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি বিশেষ ইউনিটকে এসব তথ্য জানিয়েছেন খালেদ।
জিজ্ঞাসাবাদে নিজের সম্পদ, অর্থ উপার্জন, ক্যাসিনো ব্যবসার তথ্য ‘অকপটে স্বীকার’ করেছেন তিনি। খালেদ মাহমুদের বর্ণনায় উঠে এসেছে টেন্ডার বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ, প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে অবৈধ আর্থিক লেনদেনের চিত্র।
জিজ্ঞাসাবাদে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন দুর্নীতিবাজ নেতার সম্পর্কেও তথ্য দিয়েছেন তিনি। খালেদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তালিকা প্রণয়ন এবং অ্যাকশন প্ল্যান তৈরির কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ক্যাসিনো ব্যবসার টাকা প্রভাবশালী মহলের অনেকের পকেটেই যেত। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা থেকে সরকারি কর্মকর্তারাও বাদ যেত না। কে কতো টাকার ভাগ পেতেন সে সম্পর্কেও জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য দিয়েছেন খালেদ মাহমুদ।
সূত্রটি আরও জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ মাহমুদ তাদের কাছে বলেন, “আমি গত আট বছরে ঢাকায় ৮০/৯০টি বহুতল ভবন নির্মাণ করেছি। এসব টেন্ডার আমি পেয়েছি। সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ থাকে অফিসের হাতে। কে টেন্ডার পাবে কে কি করবে এসব তো তারা নির্ধারণ করে। এতো পারসেন্ট দিতে হবে এমন একটি বিষয় থাকে। তাদের (সরকারের সেবামূলক একটি প্রতিষ্ঠান) একটি কাজ পেতে ৫ কোটি টাকা দিতে হয়েছে।”
কিভাবে তিনি টেন্ডার বাগিয়ে নিতেন সে বর্ণনা দেন এভাবে। “ক্যাপাবল লাইসেন্স থাকে যেগুলো তারা অংশ নেয়। আমার লাইসেন্স ক্যাপাবল। এখন ই-টেন্ডার। ই টেন্ডারের তথ্যও কর্তৃপক্ষ জানার সিস্টেম আছে। সেভাবেই তারা জানালে তারপর কাজ হয়। এটা তো ধরেন এখন ওপেন সিক্রেট।”
সূত্রটি জানায়, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের আগাঁরগাও অফিসের এক কর্মকর্তাকে ৫ লাখ টাকা দেন। কারণ তার ৫০ লাখ টাকার একটি বিল ‘আটকে রেখেছিলেন’ তারা। এমন প্রেক্ষাপটে এই টাকা না দিয়ে তার কোন ‘উপায় ছিল না’ বলে জানান তিনি।
সূত্র আরও জানায়, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের টেন্ডারে ব্যাপক আধিপত্য ছিল খালেদের। চট্টগ্রামের রেলওয়ের একটি টেন্ডার নিয়ম বর্হিভূতভাবে ঢাকায় আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন কাজে বিভিন্ন ধরনের কমিশন থাকে বলে জানান খালেদ। কোথাও ৫ শতাংশ কোথাও ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ওঠা নামা করে এই কমিশন।
সূত্রটি বলছে অস্ত্র সম্পর্কে খালেদ তাদের কাছে বলেছে, “আমার দুইজন বডি গার্ড মাত্র। একজন চলে যাওয়ায়, আরেকজনকে নিয়েছিলাম।”
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শনিবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় যুবলীগ নেতাদের অপকর্ম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী যুবলীগের কয়েকজন নেতাকে নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “যুবলীগ ঢাকা মহানগরের এক নেতা যাচ্ছেতাই করে বেড়াচ্ছে, চাঁদাবাজি করছে। আরেকজন দিনের বেলাতেই তিন গাড়ি ভর্তি অস্ত্রবাজসহ প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে চলে। সদলবলে অস্ত্র নিয়ে ঘোরে। এসব বন্ধ করতে হবে। যারা অস্ত্রবাজি করে, যারা ক্যাডার পোষে, তারা সাবধান হয়ে যান, এসব বন্ধ করুন। তা না হলে যেভাবে জঙ্গি দমন করা হয়েছে, একইভাবে তাদেরও দমন করা হবে।”
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলা বক্তব্য’র মিল পাওয়া যাচ্ছে খালেদ মাহমুদকে জিজ্ঞাসবাদে প্রাপ্ত তথ্যে।
নাম না প্রকাশের শর্তে র্যাবের এক কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “খালেদ অনেক ধরনের তথ্যই দিচ্ছে। সব তথ্য যাচাই বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
এদিকে রাজধানীর কমলাপুরে খালেদের ‘টর্চার সেলে’ পাওয়া গেছে নির্যাতন চালানোর অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি। কমলাপুর ইস্টার্ন টাওয়ারে অবস্থিত ওই টর্চার সেলে ইলেকট্রিক শক দেওয়ার অত্যাধুনিক মেশিনসহ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি পাওয়া গেছে। কেউ খালেদের কথার ‘অবাধ্য’ হলেই এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে নির্যাতন চালানো হতো বলে অভিযোগ উঠেছে।
বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর গুলশান-২ এর ৬৯ নম্বর রোডের বাসা থেকে খালেদকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এ সময় তার বাসা থেকে অস্ত্র, ইয়াবা, নগদ টাকা ও ডলার উদ্ধার করা হয়। পরে তাকে র্যাব-৩ এর কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
বৃহস্পতিবার বিকেলে খালেদকে গুলশান থানায় হস্তান্তর করে র্যাব। সেখানে খালেদের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও মুদ্রাপাচার আইনে তিনটি মামলা এবং মতিঝিল থানায় মাদকের একটি মামলা দায়ের করে র্যাব।
রাত সাড়ে ৮টার দিকে খালেদকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে গুলশান থানা পুলিশ।
মহানগর হাকিম মাহমুদা আক্তার অস্ত্র মামলার চার দিনের রিমান্ড এবং মহানগর হাকিম শাহীনুল ইসলাম মাদক মামলায় তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।